রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

 

                




শ্রাবণের ধারার মত



শেষ পর্ব

ঊশ্রীকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে এসে নিজেকে হঠাৎ অনাথ মনে হল দেবপ্রিয়ার। বাবা চলে গিয়েছিলেন যখন তখন সে সবে সেভেন, কষ্ট হয়েছিল কিন্তু মায়ের আঁচলের নীচে কখনোই অনাথ মনে হয়নি নিজেকে। অনুজ চলে গেলেও তেমন মনে হয়নি আর মা চলে গেলে ভীষণ ফাঁকা লাগলেও ঊশ্রী যেন জড়িয়ে নিয়েছিল সবটুকু। আজ সারা বাড়ি জুড়ে নৈঃশব্দ‍্য তাকে গিলতে আসছে। চলে যাবার আগে একটা সাংঘাতিক কাজ করেছে ঊশ্রী যার কোনো আভাস বা কল্পনা দেবপ্রিয়ার ছিলনা। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে ঝোড়ো কাকের মত মেয়ে ফিরেছে। চোখের জলের দাগ তখনো লেগে রয়েছে। দেবপ্রিয়া পড়ছিলেন। দ্রুত উঠে এসে মেয়ের কাছে আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

-সব আড়াল আজ ভেঙে দিলাম মা। সব আড়াল। এতদিন লড়াইটা আমাদের ছিল। এবার ওদের পালা।

-কী হয়েছেরে মুনিয়া? 

-আজ জোনাকমাসির কাছে গিয়ে নিজে সব বলে এসেছি। সাথে বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম। ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম যদি শুনিস বেশি চিৎকার চ্যাঁচ্যামেচি হচ্ছে এই বাড়িতে সোজা ঢুকে আসবি।

দেবপ্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে শুনে। কী করে করল মেয়েটা এমন! সব বলে দিল সব! সোফায় ডুবে রয়েছে। ঘোরের ভেতর বলেই চলেছে বিড়বিড় করে।

-মাসির জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব তবু বলে এসেছি। আর কতোদিন এভাবে ভয় পেয়ে বাঁচবো? ঐ বরুণ দত্তের চোখে চোখ রেখে বলেছি আমার ছবি ভাইরাল করুন আপনি, তারপর আমি পুলিশে জানাব সবটা। আমার মায়ের জীবন নিয়ে কী ভাবে খেলছেন সেটাও বলবো।

দেবপ্রিয়া আজ আর কাঁদতে চায়না। লবণস্রোতে জীবন যার তার নতুন করে আর কান্না আসে না। চুপ করে থাকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। ঊশ্রী হঠাৎ যেন ঝলমল করে ওঠে, 'মা আমি অনেক আগেই এটা করতে পারতাম, করা উচিৎ ছিল। আমার নিজেকে হালকা লাগছে মা। বোধহয় দীপ্তার্ককে এবার একটু স্পেস দিতে পারবো।' নতুন চরিত্রের আগমনে নড়ে বসে দেবপ্রিয়া। মায়ের কৌতূহল লক্ষ্য করে ঊশ্রী বলে, 'এমন কিছু না। হ্যাণ্ডসাম একটা ছেলে ঐ পুলিশেই চাকরী টাকরী করে। ডিজি ফিজি কিছু একটা হবে। ফেসবুক থেকেই আলাপ। একটু বেশি এ্যাটেনশান দিচ্ছে মাস ছয়েক তাই বললাম আরকি।' হেসে ফেলে দেবপ্রিয়া। যদিও ঊশ্রী কথা থামায়নি।

-মরুণকিশোর আছেন বলেই তুমি যাচ্ছো না মা! উনি কিন্তু আজো তোমায় ভোলেননি। কত বছর আগের কথা একবার ভেবে দেখো। আশ্চর্য জানো আমার চোখে উনি যেন তোমাকেই দেখছিলেন। তুমি আমার সাথে আসলে ভালো করতে মা। হয়ত একটু শান্তি পেতে, ভালো লাগত তোমার।

-মুনিয়া, মরুণ আমাকে কেন ভালোবেসেছিল? কতটা ভালোবেসেছিল আমি জানিনা। জানতে চাইওনা কারণ আজ আর তার কোনো মানেই হয় না। এই বয়েসে হৃদয় অপর কারো দুঃখের কারণ হবার দায় নিতে চাইবে না বোধহয়। তাছাড়া আমার এখানে কিছু কাজ আছে। সেসব না মিটিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। যদিও যাবনা কখনো একথা বলছি না।

-বেশ তোমার যা ইচ্ছে। তবে আমি বেশিদিন তোমায় ছাড়া থাকতে পারিনা এটা মনে রেখো।

মেয়েটা নিজেকে ঠিক সামলে নিল। চারিদিক কেমন যেন শান্ত হয়ে আসছে। এই ফাঁকা বাড়িতে একাই থাকতে হবে এখন থেকে। দিন কারো জন্য বসে অপেক্ষা করেনা। বয়ে যায়। ঊশ্রী যাবার পাঁচ ছদিন পর ছেলেটা এল। বেশ উঁচু লম্বা গায়ের রঙ ঈষৎ চাপা তবে তিক্ষ্ণ চোখ। বসার ঘরে কথা হল ছেলেটির সাথে। দেখা মাত্রই দুহাত তুলে নমস্কার জানাল বেশ কেতাদুরস্ত। বসতে বলল দেবপ্রিয়া।

-আমি দীপ্তার্ক সেন। ঊশ্রী আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বলেছিল। আমি কোলকাতায় এসেছি একটা বিশেষ কাজে। আজ এই বেলাটা অবসর আছে তাই এলাম।

-বেশ করেছো। আমাকে ফোন করেছিল মুনিয়া। তোমার পোস্টিং এখন কোথায়?

-কার্সিয়াং...

-বাহ্ সুন্দর জায়গা। মা বাবা কী তোমার সাথেই থাকেন?

-না মা বাবা থাকেন ব্যাঙ্গালোর। বাবা এখনো ইন সার্ভিস। মা প্রফেসার ওখানেই একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আছেন।

-বাহ্ খুব ভালো। 

ছেলেটি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। দেবপ্রিয়া ওকে দেখতে থাকতে মন দিয়ে। এরমধ্যে ধলিদি চা, কুকিজ, কেক, কাজুবাদাম রেখে যায়। 'তুমি কিছু বলবে?' দেবপ্রিয়ার প্রশ্নে একটু চমকে ওঠে ছেলেটি। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, 'আমি ঠিক জানিনা কী ভাবে কথাটা বলা উচিৎ। আসলে ঊশ্রী আমায় সবটা শেয়ার করেছে। সবটা। গত কয়েক মাসে ওর জীবনের সবটুকু আমায় বলেছে। আপনাদের সকলকেই আমি চিনি ওর কথা থেকে। দেখুন ম্যাম বরুণ দত্তের বাড়িতে যাবার সাজেশনটাও আমার। এখন বিষয় হল ঊশ্রীর ধারণা হয়েছে আপনার এই একা থাকাটা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। মানে বরুণ দত্ত মরিয়া হয়ে কিছু একটা করতেই পারে। ম্যাম আপনি ঊশ্রীর কাছে আপাতত কেন যেতে চাইছেন না সেটাও আমি জানি। এখন বিষয় হল আমি পরশু কার্সিয়াং ফিরে যাচ্ছি। আপনাকে এভাবে একা রেখে যেতে চাইছি না।' দেবপ্রিয়া অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কে এই ছেলে? এত মায়া দিয়ে একথা বলছে কী করে? অধিকারটাই বা কী? ঊশ্রী ওর বিশেষ বন্ধু যদি হয় তাতেও কী এতটা উদ্বেগ স্বাভাবিক?

-আমায় ভুল বুঝবেন না ম্যাম। আসলে ঊশ্রী এত চিন্তিত থাকলে কাজ কিছুই করতে পারবে না। ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয়েছে ও যে কোনো মুহূর্তে কাজ ছাড়তে পারে। রাতে তো ঘুমাচ্ছেই না। ওর রাত বাড়লে আতঙ্ক বাড়ছে।

-তোমায় বলেছে এসব ও?

-না ম্যাম বলেনি, তবে টেক্সট করেছে। আমি সকালে দেখেছি। আমি বলি কি আপনার তো নতুন লেখা শুরুর জন্য একটা চেঞ্জ দরকার চলুন না আমার সাথে। ভালো লাগলে ওখানে থেকে যান কয়েক মাস। প্রথমে আমার বাংলোয় উঠুন পরে নয় একটা ঘর ভাড়া করে নেবেন পছন্দ মতো। এতে মেয়েটা একটু স্বস্তি পায় এই আরকি।

-তুমি তো বেশিদিন ঊশ্রীকে চেনোনা দীপ্তার্ক। এতটা ওর জন্য ভাবছো কী করে?

-সন্তান গর্ভে আসা মাত্র মা তাকে ভালোবাসে, না দেখে না জেনে, দশমাস তাকে শুধু অনুভব করেই জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে গ্রহণ করে তবে একটা মানুষকে দেখে জেনে বুঝে সাতমাসে এটুকু ভালবাসা যায় না ম্যাম?

-কী সহজে বললে তুমি। তোমায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। বেশ আমি কাল তোমায় জানাচ্ছি। তুমি কখন ফ্রি হবে কাল?

-কাল ফ্রি হয়তো হব না তবে আমার লোক থাকবে আপনার এখানে।

-আমি যে ক্রমশ ভিআইপি হয়ে উঠছি।

-হওয়াই তো উচিৎ ছিল। এতদিন কেন হননি সেটাই ভাবছি। 


দীপ্তার্ক চলে গেলে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দেবপ্রিয়া। একটা ফোন করল খানিক পর।

-কেমন আছো?

-ভালো আছি। তুমি?

-আমি বোধহয় এবার ভালো থাকব। তোমায় একটা কথা জানাতে ফোনটা করেছি।

-হ্যাঁ বলো।

-আমি কোলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি অনুজ। একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি। দেখি জীবন নতুন কিছু শুরু করতে দেয় কিনা।

-কোথায় যাচ্ছ?

-সত্যি তুমি জানতে চাও? কিন্তু কেন?

-না ঠিক আছে না বললেও চলবে।

-আমি কার্সিয়াং যাচ্ছি। যে শহরে তুমি নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিলে।

-অথচ কখনো নিয়ে যাইনি। ভালো থেকো। ঊশ্রীর কাজে মন বসছে তো? ফোন করলে ধরো।

সত্যিই যে কোনদিন সব ছেড়ে যাওয়া যেতে পারে দেবপ্রিয়া ভাবিনি। কেয়ারটেকার রনেন ছাড়া সবাইকে দুমাসের মাইনে সহ ছুটি দিয়ে দিল। চলে এল অচেনা এক ছেলের হাত ধরে কার্সিয়াং। ছোট্ট বাংলোর ডানদিকে দীপ্তার্ক থাকে বাঁয়ে দেবপ্রিয়া। বাংলোর চারিদিকে পাইনঘেরা উঁচুনীচু জমি। নাম না জানা ফুলের সমারোহ। একটা পাহাড়ের প্রায় মাথার কাছাকাছি বাংলো। সামনে দিয়ে বড় রাস্তা চলে গিয়েছে। ওপাড়ে যতদূর চোখ যায় উঁচু নীচু পাহাড় আর তার মাঝেমাঝে গ্রাম। রোজ ভিডিও কলে কথা হচ্ছে মেয়ের সাথে। মেয়ে আনন্দে আটখান। গতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের কথা শুনেছে দেবপ্রিয়া।

-ম্যাডাম এবার নিশ্চিন্ত তো! আর কোনো হুকুম?

-ভাবছি ভেবে বলছি। 

-আমাকে নিয়ে কিছু ভাবলেন?

-হুম্! আমার মায়ের পাশে আপনাকে বেশ মানাচ্ছে। ফেসবুকের ছবি দেখে একটু পোড়া গন্ধ পেলাম নিজের দীর্ঘশ্বাসে। আসলে মহিলা এখনো বড্ড সুন্দরী।

-তা ঠিক তবে লেখিকার সাথে প্রেম করার মতো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান আমার হয়নি ম্যাডাম। তাছাড়া উনি একটু বেশিইই সুন্দরী । আমার আরেকটু কম সুন্দরী পছন্দ।

-মানেটা কী? আমি সুন্দর না?

-না না সুন্দর তবে একটু কম।

-যাও কথা বলবো না। তুমি বাজে জঘন্য। 

-একটা কথা বলবো ম্যাডাম? একদিনের জন্য আসবো আপনার ওখানে? আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরেই পরের প্লেনে ফেরৎ আসবো, পারমিশান দেবেন এই জঘন্য লোকটাকে। বড্ড ছুঁতে ইচ্ছে করছে ঊশ্রী। তোমার ঘাড়ের কাছের লালচে তিল আর...

আর দাঁড়ায়নি দেবপ্রিয়া ঘরে চলে এসেছে। সারা শরীর জুড়ে ভীষণ অতৃপ্তি তাকে ভেতর থেকে নিংড়ে নিয়েছে বারবার। আজ ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে কেবল সে রাতের কথাগুলোই মনে পড়ছে। কোনো মানুষের বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়ে বেঁচে থাকায় কী ভীষণ তৃপ্তি। কতদিন কতদিন হল সে বৃষ্টিভেজে না! পাহাড়ের যে বাঁকটায় ধাপে ধাপে চা বাগান শুরু হয়েছে। সেখানেই রোজ চুপ করে বসে থাকে। যতদূর চোখ যায় সবুজ মনোরম শোভা। এখানেই একসাথে থাকবে কথা ছিল দুজনে। তবু অনুজ কিসের টানে সব ছেড়ে চলে গেল কে জানে সে কথা? সবাইকে যে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসার মত যোগ্যতা হয়ত দেবপ্রিয়ার ছিলনা। আর ঐ যে এক কিশোর তাকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে তাকেই বা সে ভালোবাসতে পারেনি কেন? কে জানে এই উত্তর? জীবন বয়ে চলে নিজের ছন্দে। আকাশ জুড়ে মেঘ আসে আপন খেয়ালে। একা মানুষী মধ্য যৌবনে হেঁটে যায় এই আশায় শ্রাবণের ধারার মতো কারো ভালোবাসা অঝোরে ঝরবে তার কল্পনায়। সে প্রেম বাঁচিয়ে রাখবে সে অক্ষরে অক্ষরে। নিজের সবটুকু অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে। ভালো থাকুক অনুজ, ভালো থাকুক মরুণকিশোর। ভালো থাকুক ঊশ্রী ভালো থাকুক তার সদ্য প্রেম। দেবপ্রিয়া হেঁটে যায় পাহাড়ি পথের বাঁকে একা।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন