এই সংখ্যার গদ্যকার আবেশ কুমার দাস৷জন্ম ৩০ মার্চ, ১৯৮৩। উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটিতে। প্রযুক্তিবিদ্যা শাখায় পড়াশুনো। কর্মসূত্রে বেসরকারি প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা।ছোটগল্প রচনার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু। লিখেছেন সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট বিষয়ক কিছু নিবন্ধ। বর্তমানে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ‘বাক্’ পত্রিকার গল্প বিভাগ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। তিনটি ছোটগল্প ও দু’টি নিবন্ধ সংকলন ইতিমধ্যে প্রকাশিত।
যখন লকডাউন
খবরটা আর বেরোয়নি শুক্রবারের কাগজে।
ছবিটা অবশ্য বড় করেই ছাপা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। ফটোগ্রাফির হিসেবেও কাজটা ছিল বেশ পাকা হাতেরই। মুখটা অল্প নামানো থাকলেও পরিচিতরা ঠিকই চিনতে পেরেছিল মৃত্যুঞ্জয়কে। উপরন্তু সাবজেক্টের যেমন ফ্রেমের ঠিক মধ্যিখানে থাকার কথা, সেভাবেই ছবিতে ছিল মৃত্যুঞ্জয়।
খবরের কাগজের পাতায় ছবি ছাপা হওয়া বলে কথা।
চার লাইনের খবর হওয়া কি তার চাইতেও বড় হল!
বাজার থেকে ফিরে জামাকাপড় গামলায় ফেলে খিড়কির চাতালে ব্লিচিং ছড়াচ্ছিল বাপি। একটু ঘষে দেবে এরপর ঝাঁটা দিয়ে। শেষে ঢেলে দেবে দু’ বালতি জল। সদর নয়, বাড়িতে ঢুকছে বেরোচ্ছে আজকাল খিড়কি দিয়েই।
সদর দিয়ে ঢুকে বাথরুমে আসতে হয় শোবার ঘর ডিঙিয়ে। কিছুতে হাত না-ই দিল। বাইরের কাপড়ে হেঁটে আসবে ঘর দিয়ে! ভয় পেতে মানা করেও যা ভয় দেখিয়ে দিচ্ছে টিভি-কাগজ! এখন তো বলছে হাওয়াতেও নাকি ভেসে থাকতে পারে আপদটা। তার চাইতে এই ভাল। চাতালের কলের তলায় বাজারের জামাপ্যান্ট ছেড়ে একেবারে চান করে ঢোকো ঘরে। সারারাত তারেই মেলা থাকে আগের দিনের কাচা কাপড়জামা। চাতালটা শেড দিয়ে ঢাকা বলে সাঁঝ পাওয়ারও ঝামেলা নেই যেহেতু। চান সেরে শুকনো কাপড় চড়িয়েই একেবারে ঘরে ঢোকে বাপি।
মাথায় জল ঢালার সময়ই খেয়াল করেছিল গতকাল। ভাল পা হড়কাচ্ছে চাতালে। তখন আর ঝাঁটা ধরতে ইচ্ছে করেনি। ভেবে রেখেছিল আজ চানের আগে ব্লিচিং ছড়িয়ে একপ্রস্ত ঘষে দেবে চাতালটা। এমনিতে মা-ই করে এসব। কিন্তু বাড়ি বসে বসে ক’দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছে বাপি। কলকবজায় না জং ধরে যায় এরপর!
বাজার করার বাইরে আর কোন কাজটা করার আছে হালে! তাও পৌঁনে দশটা বাজল তো মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াল কালো ভ্যান। তারপর আর দেরি হয় না ভিড় পাতলা হতে। এপ্রিলের ফার্স্ট উইক পেরোতে চলল। সবাই বলছে আরও নাকি বাড়বে লকডাউনের মেয়াদ। গোটা এপ্রিলটাই নাকি টেনে দেবে এভাবেই। বাড়ি বসে থাকতে যে এত বিরক্তি, ভাবতে পেরেছে কোনওদিন বাপি! মার্চের গোড়াতেও মনে হত, দু’দিন ছুটি নিয়ে স্রেফ শুয়েবসে থাকবে ঘরে।
রাতে ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা প্রায়দিনই ছুঁয়ে ফেলত এগারোর দাগ। মিউনিসিপ্যালিটি চত্বরে দোকান। সওয়া দশটা-দশটা কুড়ি অবধি থাকতই দু’-একজন খরিদ্দার। তারপর হিসেব মিলিয়ে ঝাঁপ ফেলে বেরোতে বেরোতে সেই যার নাম সাড়ে দশটা-দশটা পঁয়তিরিশ। একদিন বন্ধ ঠিকই দোকান। কিন্তু ছুটি বলতে যা বোঝায় সচরাচর সেটা থাকত না বাপির। মাসের মধ্যে কম সে কম দুটো বিষ্যুদবার ছুটতেই হত চাঁদনি। শিয়ালদার মেন লাইনের ট্রেন। মানুষ যেন বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। এই ছ’ বছরের অভিজ্ঞতায় তেমনই মনে হয়েছে বারেবারে বাপির। মফস্সলের দিক থেকে পেটের টানে কত লোক যে যায় রোজ কলকাতায়, টের পাওয়া যেত এই লোকাল ট্রেনের কামরাতেই। উলটোদিকের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত বাপি। পুরনো প্লাটফর্মগুলোকে ধরে ধরে বাড়ানো হচ্ছে স্টেশনে স্টেশনে। কাঁকিনাড়ায় প্রায় তৈরি হয়ে গেল আস্ত একটা নতুন প্লাটফর্ম।
সাড়ে সাতটা-আটটার দিক করে ট্রেন থেকে নেমেও তখনই বাড়ি ফেরা হত না বাপির। মাদারবোর্ড, প্রিন্টার, হার্ড ডিস্কের হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত দেবুদার বাড়ি গিয়ে। দু’-একটা বিষ্যুদবার হয়তো যেতে হত না কলকাতায়। কিন্তু শুয়েবসে ছুটি কাটাতে হলে কপাল করে আসতে হয়। কলকাতায় যাওয়া না থাকলে কাস্টোমারদের বাড়ি পাঠাত দেবুদা। কার পাঁচ বছরের পুরনো ল্যাপটপ অন হচ্ছে না। কার মনিটরে সবুজ ছোপ আসছে। পনেরো মিনিট থেকে তিন ঘণ্টা— কতক্ষণের কাজ না গেলে বোঝার জো নেই। অল্পক্ষণে মিটে গেলেও বিরক্তি ধরত। এটুকুর জন্য ছুটির দিনে টাইম বের করে আসতে হল ছুটে। শুক্রবার অবধি ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারল না লোকটা। বেশিক্ষণ লাগলেও গরম হত মাথা। বাড়ির একটা কাজ সেরে আসা যেত এই সময়ে। সেই বিকেলে আধাঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট দেরি করে টাইম দিতে হবে পৃথাকে। এখনও ম্যাচিয়োরিটি আসেনি মেয়েটার। গুম হয়ে বসে থাকবে মিনিট দশেক। আবার তেলাতে হবে...
কতদিন ভেবেছে তখন বাপি। একেবারে নির্ভেজাল ছুটি নিয়ে বসে থাকবে দু’দিন। কিন্তু শুয়েবসে থাকা যে এত বিরক্তির কে ভাবতে পেরেছিল! খুঁজে খুঁজে কাজ বের করছে ইদানীং বাপি। বাজার এতকাল করেছে বাবা-ই। কিন্তু বুড়ো মানুষটাকে তো আর ভিড়ের মধ্যে পাঠানো যায় না এখন। একেই সুগারের রুগি। চাতালের শ্যাওলা সাফ করেছে এতদিন মা-ই। কিন্তু এত কাচাকাচির পর আবার খাটাবে বুড়িটাকে। একেই হাঁপের সমস্যা।
নিজেই ব্লিচিং ছড়াচ্ছিল তাই আজ বাপি।
তখনই কানে এসেছিল। ফোনে কার সঙ্গে কথা চলছে মা-র। উৎকণ্ঠায় গলার আওয়াজ চড়ে যায় মানুষটার। ভেসে আসা কণ্ঠস্বর থেকে শব্দগুলোকে আলাদা করতে না পারলেও টের পাচ্ছিল মায়ের উত্তেজনা। কী আর হবে! কুলতলা বা সাহাপাড়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে হয়তো আবার কাউকে। বাড়ি সিল করে লোকজনকে বেরোতে মানা করে গিয়েছে চোদ্দো দিন। কাকিমাকেও বলিহারি। রোজ ফোন করে করে এসব গল্প না শোনালেই নয় মাকে!
অদ্ভুত একটা ব্যাপার টের পাচ্ছে হালে বাপি। মৃত্যুভয় যত নিশ্বাস ফেলে ঘাড়ের কাছে, রোগ-জরা-মৃত্যুর খবর রাখাও যেন ততই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র নেশা। বলে বলে যা হয়নি এত বছরে, সেই বিড়ির নেশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে বাবা। অথচ রোজের কাগজ তন্নতন্ন করেও যেন আজকাল শান্তি নেই মানুষটার। টিভি খুলে ঠিক সেই খবরের চ্যানেলগুলোই চালিয়ে বসে থাকবে দিনরাত। আর খবর তো এখন একটাই। জালিয়াতি, রাহাজানি, খুনজখমের কিছুও যেন আর ঘটছে না হালে ভূভারতে! খবর বলতে শুধু সারা পৃথিবীর কোথায় কত বাড়ল আক্রান্তের সংখ্যা আর মরে গেল কত মানুষ! অলিম্পিক পদকের দৌড় চলছে যেন! এক-একদিন আশ্চর্য লাগে বাপির। পানুর ক্লিপিংসও আর পাঠায় না কেউ শালা হোয়াটসঅ্যাপে...
ব্লিচিং ছড়িয়ে কতক্ষণ রাখে কে জানে! সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁটা টেনে দেয়! উপযাচক হয়ে হাত দিয়েছিল বটে কাজটাতে। এখন টের পাচ্ছে কোনও কিছুতেই অন্ধের মতো নেমে পড়লেই হল না। মাকে ডাকবে নাকি একবার...
গলার আওয়াজটাও এদিকেই আসছে না!
দাঁড়া, আমি বলছি। কী যে করিস না তোরা...
ফোন কাটতে কাটতে এসেও দাঁড়িয়েছে মা।
বাপিকে আর বলতে হয় না কিছু। মা-ই বলে ওঠে, কী করছিস? এখন রাখ এসব। বেরোতে হবে এক্ষুনি তোকে...
মানে! এখন আবার কোথায় বেরোব! সাড়ে দশটা বাজতে চলল...
আর বলিস না। পুচাই ফোন করেছিল। তোর কাকা রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে...
কী বলছ, ঝাঁটা ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় বাপি, কোথায় বেরিয়েছে এই লকডাউনের মধ্যে!
ওই তো। এত আড়বুঝো না বাড়ির এই পুরুষমানুষগুলো! ক’দিন ধরে শরীর ভাল যাচ্ছিল না। এখন হবেই। দোকান বন্ধ। তার এক টেনশন আছে। মালা বোধহয় বলেছিল, বাড়ি বসে রয়েছ একদম, হজমের গণ্ডগোল তো হবেই একটু। তাতেই তেজ করে নাকি বেরিয়ে গেছেন বাবু...
বাপির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বলে, ফোন নিয়ে যায়নি?
তাহলে কি আর ভাবনা ছিল! এদিকে দু’ ঘণ্টা হয়ে গেছে। পুচাই যতটা পেরেছে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে এদিক-সেদিক...
না না, ও আবার বেরোতে গেল কেন! পুলিশ ঘুরছে রাস্তায়...
বলতে বলতেই তার থেকে কাচা জামাকাপড় টেনে নিয়েছে বাপি। মাস্ক তো এসেই ছেড়ে দিয়েছিল গামলার জলে। একটা রুমালই গিঁট দিয়ে নেয় এখন মাথার পেছনে। এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিচ্ছিল পুচাই। অভাবের সংসারেও বয়সের একটা স্বাভাবিক চটক লেগেছেই গায়েগতরে। দিনকাল ভাল নয়। অসুস্থতাকে ঢাল করে রাস্তাঘাটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রক্ষকই। ওদিকে ঘরে বসে থাকলেও ছ’ মাস দিব্যি এখন হেসেখেলে চলে যাবে যাদের, ফেসবুকে তারাই নিদান দিচ্ছে কড়া দাওয়াইয়ের। কী যে করে না কাকাটা! বুদ্ধিশুদ্ধি হল না এতদিনেও। নিজেও বিপদে পড়বে। মেয়েটাকেও ফেলবে। না না, একা-একা বেরোতে গেল কেন পুচাই! প্রথমেই ফোন করা উচিত ছিল বাপিকে। ফোন অবশ্য চার্জে বসিয়ে রেখে বাজারে বেরিয়েছিল বাপি। রুমালটাকে মাথার পেছনে গিঁট দিয়ে দাড়ির মতো ঝুলে থাকা অংশটাকে ঘুরিয়ে আবার নাকের কাছে তুলে আনে বাপি। কোন কোন রাস্তায় ঘুরপাক খেতে হবে এখন কে জানে! মামাদের মুখে না পড়াই বিচিত্র। মুখে ঢাকা থাকলে তাও কথা শুনবে মামারা।
মা গজগজ করে যাচ্ছে তখন, ঘরে বয়েস্থা মেয়ে। সেসব তো ভাবল না জীবনেও। পইপই করে বলা হয়েছিল তখন। ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকাগুলো তুলে বসিও না ওসব জায়গায়। এখন দোকান বন্ধ। কী করে চলবে সেই টেনশন। টাকাগুলো থাকলে বুকে বল থাকত তাও...
সাইকেলটা থাকে সিঁড়ির তলায়।
সেই চান না করেই ঢুকতে হল ঘরের ভেতর।
পাছায় হালকা রুলের গুঁতো দিতে দিতে হলদে দাঁত বের করে হাসছিল পুলিশটা, নামটা তো খাসা বে। মৃত্যুঞ্জয়। তাই বুঝি মরার ভয় নেই একদম...
যদিও পুলিশটার মুখ আসেনি ছবিতে।
ক্যামেরার ফোকাস ছিল বাপির মুখেই। বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে মাথা নামিয়েও নিয়েছিল বাপি। তবে বড় কাগজে চাকরি করা ফটোগ্রাফারের হাতের রিফ্লেক্স তো। সারা বাংলার লোক না হোক, বৃহস্পতিবারের কাগজ দেখে সারা শহরের লোক ঠিকই চিনে নিয়েছিল কান ধরে ওঠবোস করতে থাকা বাপিকে। আসলে খোদ মিউনিসিপ্যালিটি চত্বরে দোকান দেবুদার। দোকানে আসুক আর না-ই আসুক, কাজে-অকাজে বিগত ছ’ বছরে ওই চত্বরে একদিনও পা রাখেনি এমন মানুষ মাইক্রোস্কোপে খুঁজতে হবে শহর ঢুঁড়ে।
শুক্রবারের কাগজে অবশ্য আর বেরোয়নি বিষ্যুদবার দুপুরেই বাপির নিজের ঘরের সিলিংফ্যান থেকে ঝুলে পড়ার খবরটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন