রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৪.

এই পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে ভবতারণ বাবুর।পেছনে পড়ে থাকবে একটা চার কুড়ি পঁচাশি দিনের মস্ত জীবন।তার বন্ধ চোখের ভেতর এখন হেমন্তের মাঠের ছায়া।অগ্রহায়ণের খড় বিচালির ঘ্রাণ। বেঁচে থাকতে থাকতে একটা আস্ত জীবন কিভাবে ফুরিয়ে যায়!সরকারবাবুর জোত জুড়ে সেই কবেকার একুশ মহিষের ভইসা গাড়ি।
গাড়ির নিচে কালি পড়া লন্ঠন দোলে। পরনকথার গল্প ভেসে যায় আঞ্চলিক নদীতে।
জমে ওঠে হেমন্তের গানবাড়ি_
"দোলার জল থই থই
আছে মাগুর সিঙ্গী কই"
এই নদী টদি বাথান টাথান খেত খামার মানুষজন বাড়ি টাড়ি ঘিরে জমে ওঠা মানুষের জীবনযাপন থেকে দীর্ঘ হাই তোলে মানুষের জীবন।
যে জীবন ঘিরে থাকে মরণ।
মৃত্যুর স্বাদ তো নিতেই হয় মানুষ কে।
ভবতারণ বাবু তার মস্ত এক জীবন থেকে চলে যাচ্ছেন।তিনি তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রম জটিলতার ফাঁকে ফাঁকে মাঠে মাঠে ছড়িয়ে থাকা গান শুনতে শুনতে নুতন এক লোকপৃথিবীর দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
মরণের ভেতরের বিষাদ থেকে তখন ভেসে আসে গান_
"পানিয়া মরা যাবার না দেয়
কেমন করিয়া যাং"
ভবতারণ বাবু চলে যাচ্ছেন।
সঙ্গ থেকে সঙ্গহীনতার দিকে।
আলো আর অন্ধকারের কুহক থেকে নিঃসঙ্গতার উপর ঝুঁকে পড়ে ভবতারণ বাবুর আস্ত আয়ুষ্কাল।
এই যাওয়া রাজকীয়।
এই প্রস্থান মহামহিম হয়ে জেগে থাকে।নুতন নুতন গল্প দিয়ে ভরিয়ে তোলা লম্বা আখ্যানের মতন।
এই চলে যাওয়া চিরকালীন শুন্যতার জন্ম দিতে থাকে।আর সেই জন্ম মরণের ভিতর শিস দেয় হেমন্তের পাখিরা।
২৫.
ছত্রশালের সিথানে কালডোবার হাটে অঘ্রাণ সন্ধ্যায়
ভরা সভায় গান গাইতে শুরু করেন আলাউদ্দিন গিদাল। মানে সেই আখ্যান থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসা আলাউদ্দিন এম এল এ।সঙ্গে দোতরায় সঙ্গত করছে আব্দুল জব্বার।আলাউদ্দিন গান ধরেন আর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দোতরায় ঝড় তোলেন জব্বার।জমায়েতে মানুষ ঢুকে পড়ে।জমায়েত থেকে বেরিয়ে যায় মানুষ।এই যাতায়াতের
মাঝখানে,মানুষের প্রবেশ প্রস্থানের ভেতর খুব নিবিড়তা নিয়ে কেবল জেগে থাকে গান।মাটির গান।মাটিতে বসবাস করা মানুষের জীবনযাপনের গান।আমরা শুনি গান উড়ে বেড়াচ্ছে,ঘুরে বেড়াচ্ছে_
"বাইরা খোলান তোর ঝিকি রে মিকি
ঘরে জ্বলে ঘিয়ের পঞ্চবাতি
সোনার চান রে"
গানের পর গান চলে।গানের ফাঁকে কত গল্প করেন আলাউদ্দিন সাব।কত কত কিসসা শোনান।
রাজার হাতি পার করানোর সেই রাজড়াঙার ঘাটের কথা বলেন।একাব্বর ঘাটোয়াল আর তার "শিমুল খুটার" সেই মস্ত বাহারি নৌকোর গল্প বলেন।
এভাবেই মানুষের ঘন হয়ে আসাটা বেশ টের পাওয়া যায়।জমায়েতে উড়ে বেড়াতে থাকে বিড়ির আগুন,হুকা টানবার শব্দ, কোলার ছাওয়ার ডুকুরি
ডুকুরি কান্দন।রাত বাড়তে থাকে।গ্রামদেশে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে।গঙ্গাধরের বাতাসে শীত প্রগাঢ় হয়।আলাউদ্দিন এম এল এ আর গীদাল জব্বার খুব খুব ডুবে যেতে থাকেন গানেরই ভেতর_
"হস্তীর সনে মাহুতের পিরিতি
হস্তী ছাড়া মাহুত চলে কেমনে"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন