রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                             


দ্বিতীয় পর্বের পর 

৩) 

  খুব ভোরে উঠে পড়ে সামুয়েল। এ তার পুরনো অভ্যেস। ঘুম থেকে উঠেই সাইকেল নিয়ে কসরত করে সে। সাইকেলটাও যেন এই সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এইটুকু সময় শুধু তার আর সামুয়েলের। যেহেতু এই গ্রামের রাস্তার প্রায় সবটাই সমতলে, তাই চড়াই উতরাই ভাঙতে সে চলে যায় ওই দূরের পাহাড়ের দিকে। পাহাড় তো নয়, টিলার মতো। পাথুরে কিছুটা হলেও, সবুজে ঢেকে আছে এখন। পায়ে চলা পথ ধরে সামুয়েল আর তার সাইকেল সোজা উঠে যায় পাহাড়ের মাথায়। সূর্যটাও তখন পাহাড়ের মাথায় এসে হাজির হয়। এতদিনে আশেপাশের বসতির সবাই, মায় এই পথঘাট, গাছপালা, পশুপাখি, সবাই জেনে গেছে যে, এক বিদেশী ছেলের সাইকেলের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙবে আর সেই ছেলের গলায় থাকবে ভাঙা ভাঙা অসমীয়া গানের কলি। ঠিক এই যেমন এখন যদি কেউ ওই টিলার মাথায় এসে দাঁড়ায়, শুনতে পাবে…

নিবিড় বনে যে মাতিছে যা/ যা যা দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা/ সোনৰে সজাটি এৰি থৈ যা/ যা নীলিম আকাশলৈ/ সোনালী ৰদে যে মাতিছে যা/ জোনৰে জোনাকী মাতিছে যা/ যা পখী দূৰণিলৈ/ হেৰুৱা সুবাসে মাতিছে যা

 এই একটি মাত্র গান সে আয়ত্ব করেছে। এই সুর তাকে খুব টানে। অবশ্য জয়ন্ত হাজারিকার বেশ কিছু গানই ভাল লেগেছে ওর, কিন্তু ভাষা আর সুর রপ্ত করতে সময় লাগবে। আর তুলতে হবে ভূপেন হাজারিকার কিছু গান। টিলার ওপর এসে সামুয়েল কিছু ব্যায়াম করে সাইকেল নিয়ে। শরীরে আর এই সাইকেলে জং ধরতে সে দেয় না কোনোমতেই। তাকে সব সময় প্রফুল্ল রাখে সুর আর গান। কত দেশে সে গেছে, কত রকম মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সব মানুষের মুখ যে ওর মনে থাকে, বা মনে রাখতে চায়, তাও না। কিন্তু সুর সে ভোলে না। কথা ভুলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু সুর মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কখন যে কোন সুরে সে গুনগুনিয়ে উঠবে বা গিটারে কী যে সে বাজাবে, সেও জানে না! 

  সেদিন অভিজিতের সঙ্গে আলাপের পরদিনই ওরা আবার এক ক্যাফেতে আড্ডা দিতে বসেছিল। অভিজিৎ গরগাঁওয়ে যুবা উৎসবে ওকে নিয়ে যেতে চাইছিল, চাইছিল বলা ভুল, একরকম জোর করছিল ওকে ওখানে যাবার জন্য। খুব বেশি ভিড় সামুয়েলের ভাল লাগে না, তবু অভিজিতের উপরোধে ওকে রাজি হতে হয়েছিল সেদিন। এখন মনে হয়, সেদিন যদি ওই উৎসবে না যেত ও, এই গ্রামে আসাও হত না ওর। অথবা মণিপুর থেকে সে যদি ফেব্রুয়ারিতে আসামের শিবসাগরে না আসত, তাহলেও অভিজিতের সঙ্গে দেখা হত না। সবই বোধহয় পূর্বনির্ধারিত। নইলে কোথাকার কোন বরবরুয়া গ্রাম, আজ তার নিজের ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে! ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল সামুয়েলের মন কেড়ে নিয়েছিল। অসমীয়ার বিহু নাচগান আর সুর, তাল, ছন্দে সে খুব একাত্ম বোধ করেছিল সেদিন। আসলে তার নিজের বাসস্থান যেখানে, সেও তো এমনই এক মায়াময় দেশ। কান্ট্রিসাইডে এক বিরাট খামার রয়েছে ওদের। চাষবাস তাদের পরিবারের রক্তে। আর সুর! তাদের পরিবারের সবারই রক্তের মধ্যেই সুর দৌড়ে বেড়ায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে মুখে হাসি লেগে থাকে স্রেফ এই অজস্র, অনর্গল গান আর সুরের জন্য। টনিকের মতো কাজ করে। 

  একটানা সাতদিন যুবা উৎসবে ভাগ নিয়েছিল ওরা। এমনও হয়েছে, নিজের গিটার নিয়ে নাচেগানে ওদের সঙ্গে মেতে উঠেছে সামুয়েল। এমন একটা প্রাণবন্ত ছেলেকে, বিদেশি হলেও কাছে টানতে কারুর দেরি হয়নি। শেষদিন অভিজিৎ আর সামুয়েল প্রচুর মদ্যপান করে একসঙ্গে। আর সেই সময়েই অভিজিতের সঙ্গে ওর গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকতে চায় ও। অভিজিৎ অবাক হলেও, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। যদিও একটু কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল ওর…একজন সাহেবকে নিয়ে গিয়ে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে, ওইরকম গ্রামে সাহেব কি থাকতে পারবে আদৌ…এইসব নিয়ে যখন মনে মনে ভাবছে অভিজিৎ, ভরপেট মদ খেয়েও সামুয়েল কী করে যেন ওর মনের কথা ধরতে পেরে গেছিল। নিজেই জড়ানো গলায় আশ্বাস দিয়েছিল, আমাকে নিয়ে ভেব না। এই সাইকেলে আমি কত যে দেশ ঘুরেছি, কত গ্রাম, জঙ্গল, পথঘাটে না খেয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে, জল পর্যন্ত ফুরিয়ে যেত একেক সময়ে, ফলে আমাকে নিয়ে টেনশন কর না। তোমরা যেমন ভাবে থাকবে, আমাকেও সেভাবেই রাখবে।

   তবুও দুরুদুরু বুকে সামুয়েলকে নিয়ে গ্রামে এসেছিল অভিজিৎ। ঠিক হয়েছিল সাতদিন থাকবে এখানে সামুয়েল। তারপর রওনা দেবে দেশের উদ্দেশ্যে। ততদিনে টিকিট কেটে রাখতে হবে। কারণ ওর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে।        


(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন