রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                  


 সাইকেল 


  

প্রথম পর্বের পর 


২) 

  সামুয়েল কাঁধ ঝাঁকাল অদ্ভুত ভঙ্গি করে। যেন ও নিজেই ঠিক বুঝতে পারছে না—মন খারাপ লাগছে কিনা। এই বরবরুয়াদের গ্রামটাকে সামুয়েলের খুবই ভালো লেগে গেছে। আর সেই ভালো লাগার মাশুল গুণছে এখানে আটকে পড়ে। ভাগ্য যে এভাবে ওকে আসামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে এনে ফেলবে, এনে ফেললেও এখানেই সাময়িক আস্তানা গড়ে দেবে ওর, কে জানত! এই বাচ্চাদুটো ওর খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে। একজনের ক্লাস থ্রি, একজনের টু। বড়টার নাম রুবাই আর ছোটটাকে সামুয়েল ডাকে মাদাম বলে। আসলে ও সবার মুনিয়া। রুবাই ওর সাইকেলে উঠে প্যাডেলে পা পৌঁছনোর চেষ্টায় মত্ত। আর মাদাম এখন গিটারে টুংটাং করছেন। মেয়েটার তেলমাখা খোঁচা খোঁচা চুলে হাত বুলিয়ে দিল ও। আদর পেয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল ও। তারপর আবার গিটারে মন দিল। যেন এই মুহূর্তে জি শার্পে গিয়ে সে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। এটুকু প্রশ্রয় ওদের দেয় সামুয়েল। শুধু এই দুটি না, আরও কয়েকজন এসে জোটে ওর কাছে। বরাবর ছোটদের পছন্দ করে ও। ওদের পালস্‌ বোঝে, আর তাই যেখানেই যাক, ছোটরা ওকে ঘিরে রাখে। এই বরবরুয়া গ্রামে এসে ওদের ভাষার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল প্রথমটা। তারপর আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, ভাঙা ইংরেজিতে বস্তুর নাম বলে বোঝাতে পেরেছে কিছুটা। এভাবেই চলেছে দুপক্ষের ভাষা শেখার খেলা। এখন তো অসমীয়া, স্প্যানিশ আর ইংরেজির সহাবস্থানে গ্রামের বিকেলগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট স্কুলের মতো তৈরি হয়ে গেল এভাবে। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়! 

  জুন, জুলাইয়ের এই ভরা বর্ষায় অবশ্য মাঠেঘাটে ওদের স্কুল বসতে পারে না। কারুর ঘরে, বারান্দায় মায় পরিত্যক্ত গোয়াল বা রান্নাঘরেও চলে ওদের পাঠ। আজ তিনমাস হয়ে গেল এখানে এসে। তিন মাস তো না, যেন এক যুগ! গত বছর আগস্টে স্পেন থেকে উড়ান দিয়েছিল সে জাপানের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী ছিল তার সাইকেল। সেই জাপান থেকে সাইকেলে চড়ে একে একে কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে মণিপুরে। তারিখটাও মনে আছে! ২৭ জানুয়ারি। কারণ আর কিছু না, সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। বাড়িতে বাবামায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে এক সাইবার কাফেতে গিয়েছিল সন্ধেবেলা। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকেই জেনে গেছে সাইকেলধারী এই বিদেশী পর্যটকের কথা। অনেকেই আলাপ করছে, হাত মেলাচ্ছে, এরই মধ্যে যখন বাবামায়ের সঙ্গে ও কথা বলছিল স্কাইপে, উচ্ছাস হয়ত বেশি হয়ে পড়েছিল ওর। জন্মদিনে ওঁদের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে দূরে থাকলেও আজ এভাবে জাপান থেকে ইন্ডিয়ায় আসতে পারবে, নিজেও ভাবেনি কখনও। সেসময়েই এক যুবকের সঙ্গে চোখচোখি হয় ওর। সে নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয় আলাপের জন্য। শিক্ষিত অসমীয়া এই যুবকের নাম অভিজিৎ বরবরুয়া। কী এক প্রাণের টানে বন্ধু হয়ে যায় ওরা খুব সহজেই।

  অভিজিতের মূল আগ্রহ ছিল ওর পর্যটনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা। আর তাই দুজনের মধ্যে ভাব হতে সময় লাগেনি। নাহ খিদে পাচ্ছে খুব। ওরা হয়ত বসে আছে ভাত নিয়ে। অভিজিতের মাকে ও কাকিমা বলে। অনেকবার বোঝানো সত্ত্বেও কাকিমা ওরা দুজনে না খেলে খায় না। এখন আর আকাশকুসুম ভেবে দেরি করলে চলবে না। উঠে পড়ল ও। পুঁচকে দুজন বিদেয় নিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। গিটারটা পিঠে ঝুলিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল ও। আর গলা দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে এল-

Hoy en mi ventana

brilla el sol

Y el corazón se pone triste 

contemplando la ciudad

Porque te vas ……

(আজ আমার জানলায় রোদ এসে পড়েছে,/ আর মন হয়ে রয়েছে বিষণ্ণ/ এই শহরকে অভিযুক্ত করছি আমি/কারণ তুমি চলে যাচ্ছ…)  


   সূর্য এখন আর ভোরের নেই। দুপুর গড়িয়ে সে খর হয়ে উঠেছে। কেউ এ শহর ছেড়ে আপাতত চলে যেতেও পারবে না লকডাউনের কারণে। ফলে দুঃখের কিছু নেই তার। গান তো এমনিই গাওয়া। এমনিই…তার অভ্যেস। আর দুঃখ কি কিছু আছে ওর? মনখারাপ? সে সত্যিই বোঝে না এসব। সামুয়েলের মন একটা আলগা পালকের মতো ভাসতে থাকে সব সময়। তুলোর মতো পেঁজা মেঘে ঢেকে আছে এখনকার আকাশ—ঠিক এরকম। যখন খুব মেঘ করে, আকাশ কালো হয়ে আসে, সামুয়েলের খুব ভয় লাগে। মনে হয় কারুর নরম বুকে মুখ লুকিয়ে যদি বেঁচে থাকা যেত নির্ভয়ে… 

)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন