(মাতৃ দিবসে এক মায়ের গল্প)
#নকশী_কাঁথা#
ফ্ল্যাটের ঢোকার দরজার কাছে গিয়ে আর একবার লিভিং রুমের চারিদিকটা পরখ করে নিলাদ্রী। গতকালের কেনা জানলা-দরজার পর্দাগুলো টাঙানো পর বেশ লাগছে ঘরটাকে। নিজের পছন্দের তারিফ করে মনে মনে। হঠাৎ দেওয়ালে টাঙ্গানো ফ্রেমে বাঁধানো বহুদিনের বিবর্ণ পারিবারিক ছবি দেখে ভ্রুঁরু কুঁচকে গেল নীলাদ্রির। ইসস, একদম চোখে পড়ে নি!! “মধু... মধু...”। মধুরিমা, নিলাদ্রীর স্ত্রী। “আসছি...। কী হলো আবার...?” কিচেন থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে মধুরিমা। আজ ভোর থেকেই রান্নার কাজে ব্যাস্ত মধু।
“এই দ্যাখো, পরিষ্কার করার সময় ভেবেছিলাম সরিয়ে দেব, একদম খেয়াল হয় নি...! তোমারও তো চোখে পড়েনি! ইসসস...!”
“আমি কী করে করবো? সকাল থেকেই তো কিচেনে...। তোমার আর কি, বাজার করেই খালাস...। নিলাদ্রী মধুর কথার জবাব না দিয়ে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ফ্রেমটা নামিয়ে আনে।
“গতকালের আনা রবীন্দ্রনাথের পোট্রেটটা কোথায় গো?” মধুরিমা বেডরুম থেকে নিয়ে এসে ছবিটা নিলাদ্রীর হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলে;
“শোনো, একটা বিষয় আমরা ভেবে দেখি নি...”। একটু চিন্তিত মনে হয় মধুরিমাকে।
“আবার কী হল...?” পোট্রেটটা টাঙ্গিয়ে দিতে দিতে বলে। ওঃ, সকাল থেকে যা চলছে...। শরীর আর চলছে না। ঘরদোর পরিষ্কার, পুরোনো নড়বড়ে ফার্নিচারগুলো সব ছাদে তোলা, ব্যালকনির টবগুলি রঙ করা, দু’রকম মাছ, মাংস...এখনও তো ফুল আর মিষ্টি আনতে বাকী। যদি কাজটা হয়ে যায়, তাহলে পরিশ্রমটা সার্থক হয়।
“না..., সে রকম কিছু না, ভাবছিলাম, তোমার মা’কে কোথায় রাখা যায়? মা কি তাঁর ঘরেই থাকবেন?
“তাই তো, এদিকটা একদম ভাবা হয় নি। সোফায় বসে নীলাদ্রী। “কী করা যায় বলো তো?”
“তোমাকে বলেছিলাম কয়েকদিন দেশের বাড়িতে কাকার কাছে রেখে আসতে। তুমি তো তখন পাত্তা দিলে না..., এখন বোঝো!”
“এখন তো ওই সব ভেবে লাভ নেই...। প্লিজ, কী করা যায় বলো না।“ অনেকটা আবদারের সুরেই বললো নীলাদ্রির। মাথাটা একটু নীচু করে একটু ভেবে নেয় মধু।
“এক কাজ করো, পেছনের দিকে শোয়ার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে মা তো রোজই বসেন। আজ না হয় ওনারা না যাওয়া পর্যন্ত বসে থাকবেন। দু’তিন ঘন্টার তো ব্যাপার...। তেমন ঠান্ডাও পরে নি...”।
“তা অবশ্য ঠিক...” অনেকটা অনিচ্ছা যত্বে মেনে নেয় নিলাদ্রী।
“আর হ্যাঁ..., ফুল আনার সময় মা’র জন্য ভালো দেখে একটা হাউসকোট নিয়ে এসো। চিন্তা করো না, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। তুমি এগোও...আমার এখন অনেক কাজ”। বলতে বলতে কিচেনের দিকে এগোয় মধু।
বাজার থেকে ফিরে মা’র হাউসকোটটা হাত বাড়িয়ে মধুকে দিয়ে কয়েক ডজন রজনীগন্ধা স্টিক আর ফুলের বুকেটা ডাইনিং টেবিলে রেখে একটু জল ছিটিয়ে দেয় নিলাদ্রী। তারপর শেষবারের মতো লিভিংরুমের ফার্নিচারগুলো একটু ঠিকঠাক করে দেয়। দরজা থেকে দু’পা এগিয়ে বুকশেলফের পাশে সোফাসেট, মাঝখানে সেন্টার টেবিল, জানলার একপাশে একটু উঁচু টুলের ওপর স্কেলচেঞ্জার, তার পাশে টুল। তার ঠিক পেছনের ওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। ‘মধুকে দুটো গান একটু প্রাকটিস করে রাখতে বলেছিলাম, করেছে তো?’ মনে মনে ভাবে নিলাদ্রী।
“মা দেখি, একবার পরে দেখুন তো ঠিক হয়েছে কিনা”। মধু হাউসকোটটা প্যাকেট থেকে বের করে শাশুড়িকে পরিয়ে দেখে নেয়। ভালোই লাগছে শাশুড়িকে, বোঝাই যায় একসময় বেশ সুন্দরী ছিলেন। যদি নেহাতই সামনে আসতে হয়, খারাপ দেখাবে না। মনে মনে ভাবে মধু।
“এটা কী বউমা? ম্যাক্সি...? আমার তো অনেক ম্যাক্সি আছে... এটা...?”
“এটা হাউসকোট, আজ বিকেলে ওঁর অফিসের বড়সাহেব তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন। সবাইকে একটু ফিটফাট থাকতে হবে। বিকেলে আপনি এটা ম্যাক্সির ওপর পরে থাকবেন। ও হ্যাঁ...আর একটা কথা, বিকেলে ওই সময়টুকু ব্যালকনি গিয়ে বসবেন। বুঝতেই পারছেন, আপনার ছেলের চাকরীর ব্যাপার। এর মধ্যে আপনার না থাকাই ভাল। একটু কষ্ট হবে হয়তো”।
“আমি বুঝতে পেরেছি বউমা। আমার কোনও কষ্ট হবে না। ওঁনারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি ওখানেই থাকবো। কোনও চিন্তা করোনা”।
বিকেলে নিলাদ্রী স্নান সেরে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর পায়জামা পরে। মধুরিমা পরে সাদা লালপাড় টাঙ্গাইল। সাহেব ছ’টা থাকে সাড়ে ছ’টা মধ্যে আসবেন বলেছেন। একবার যদি সাহেবকে হাত করা যায়, তাহলে এরিয়া ম্যানেজারের পোস্টটা পাকা। যদিও ক’দিন ধরেই তেওয়ারিকে স্যারের চারপাশে ঘুরঘুর করতে দেখছে। অফিসের কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে তেওয়ারিই নাকী...। এই প্ল্যানটা অবশ্য মধুরই...।
“মধু পায়েসটা ফ্রিজে রেখেছো তো? ঠান্ডা না হলে ঠিক ভালো লাগে না’
“সব ঠিক আছে, কোনও টেনশন করো না। প্ল্যানটা যখন আমার, তখন অত ভাবতে হবে না। এই রকম হাই-প্রোফাইলের গেস্টদের কী ভাবে এন্টারটেন্ট করতে হয়, তা তোমার থেকে ভালো জানি”।
“মা ঠিক আছে তো?”
“মা’কে ব্যালকনিতে বসিয়ে দিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধা হবে না। আর অসুবিধা হলেও তো কয়েক ঘন্টা। মাঝখানে আমি একবার দেখে আসবো”।
“পোনে ছ’টা বাজে। যাই..., নীচে গেটে গিয়ে ওয়েট করি”। নিলাদ্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় মধুরিমা।
জলতরঙ্গের মতো কলিংবেল বেজে উঠতেই মধু তাড়াতাড়ি দরজা খোলে। নিলাদ্রীর পাশে সাদা পাঞ্জাবীর ওপর র’সিল্কের জহরকোট পরা এক হাসিখুশী ভদ্রলোক এবং সিল্কের শাড়ি পরা এক ভদ্রমহিলাকে দেখে অবাক হয় মধু। তবে যে নিলাদ্রী বললো, ইউ এস থেকে এসেছেন !
“আসুন আসুন প্লিজ...” নিজেকে সামলে আলতো করে ভদ্রমহিলার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে মধু।
“মধু... এই হল আমাদের সকলের প্রিয় মিষ্টার সান্যাল সাহেব আর উনি...”।
“বুঝতে পেরেছি... ‘দিদি’...” ইচ্ছে করেই ‘দিদি’ সম্বোধন করে মিসেস সান্যালের প্রতিক্রিয়া দেখে মধু। মিসেস সান্যালের হাসি মুখ দেখে নিশ্চিন্ত হয়।
মিস্টার সান্যাল লিভিং রুমের চারিদিকটা দেখতে দেখতে বলেন;
“বাঃ, আপনাদের রুচির তারিফ করতেই হচ্ছে...। সবই তো ম্যাডামের ক্রেডিট, তাইতো? নিলাদ্রীর আর সময় কোথায়...”।
“খুব অন্যায় হয়েছে। আপনার মিসেসকে ‘দিদি’ বলে ডাকাটা ঠিক হয় নি। ম্যাডাম বলা উচিত ছিল”। অভিমানী গলায় বলে মধু। মধুর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলেন মিস্টার সান্যাল।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি নাম ধরেই ডাকবো। কী যেন নাম...?”
“আমার নাম মধুরিমা। মধু বলেই ডাকবেন আমাকে। ও ওই নামেই ডাকে...”।
“স্কেলচেঞ্জারও আছে দেখছি...! কে গান করেন? মধু নিশ্চয়ই, তাহলে তো একটা গান শুনতে হয়...”। সত্যি মধুকে তারিফ করতেই হচ্ছে। কয়েক মিনিটেই বেশ জমিয়ে দিলো! খুশী হয় নিলাদ্রী।
“এক সময় করতাম, বিয়ের পর ঠিকমতো রেওয়াজ করার সময় পাই না”।
“তা বললে তো আমি শুনবো না...”। মিসেসের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে মিষ্টার সান্যাল। মিসেসও সায় দেয় তাতে।
“নিশ্চয়ই স্যার, ও অবশ্যই করবে”। কথাটা বলে মধুকে ইশারা করে নিলাদ্রী।
“পাঁচ মিনিট দাদা, সবার জন্যে আগে কফি নিয়ে আসি”। কিচেনের দিকে পা বাড়ায় মধু। নাঃ, এলেম আছে মধুর। দশ মিনিটেই দাদা পাতিয়ে ফেললো! মনে মনে ভাবে নিলাদ্রী।
মিষ্টার ও মিসেস সান্যালের অনুরোধে পর পর দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত করে মধু। গল্প গান, কবিতা পাঠে সময় গড়িয়ে যায়। কারো খেয়াল থাকে না। মধু ঘড়ির দিকে তাকায়।
“আটটা বেজে গেছে। আপনাদের জন্য এবার ডিনারের ব্যবস্থা করি?”
“তার আগে চলো তোমাদের ফ্ল্যাটটা একটু ঘুরে দেখি”। মিসেস সান্যালের কথায় উঠে দাঁড়ায় সকলে।
বেডরুমে গিয়ে ব্যালকোনির দরজাটা খুলে দেয় মধু। আশপাশের ফ্ল্যাটের আলো ঝলমলিয়ে ওঠে। ব্যালকোনির ইন্ডোর-প্ল্যান্ট আর অর্কিডের তারিফ করে তাঁরা। সকলে পেছনের দিকে ছোট বেডরুমে এসে ঢোকে।
“এখানে কে থাকেন? মিসেস সান্যালের প্রশ্নে নিলাদ্রীকে ইতস্তত করতে দেখে এগিয়ে আসে মধু।
“এটা আমাদের মা, মানে আমার শাশুড়ী মা’র জন্য। মা সাধারণত দেশের বাড়ি বীরভূমেই থাকেন, মাঝেমধ্যে এখানে এলে...”। বেডরুম থেকে বেরোবার সময় হঠাতই থমকে দাঁড়ায় মিষ্টার সান্যাল।
“এখানে কী কেউ আছেন? একটা কাশির শব্দ শুনলাম মনে হোল!” মিষ্টার সান্যালের কথায় প্রমাদ গোনে নিলাদ্রী। মধুর দিকে অসহায়ের মতো তাকায় মধুর দিকে...।
“এই রে...মা এখনও ব্যালকোনিতে! ইসসস... কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছিলাম... মা কয়েকদিন হোল এখানে এসেছেন”। ব্যালকোনির দরজা খোলে মধু। মধুর সাথে সাথে মিষ্টার সান্যালও এগিয়ে যান।
ধীরে ধীরে মা’কে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয় মধু।
“কিছু মনে করো না বৌমা, ঘুমিয়ে পরেছিলাম”। হঠাৎ মিষ্টার ও মিসেস সান্যালকে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যান।
“কী যে বলেন মা। আমারই ভুল, ওঁনাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যাস্ত থাকায় একদম খেয়াল করতে পারি নি”।
মিষ্টার সান্যাল সামনে গিয়ে প্রণাম করেন নিলাদ্রীর মা’কে। তা দেখে বিস্মিত হয় নিলাদ্রী ও মধু।
মিসেস সান্যাল ঝুঁকে প্রণাম করে উঠতেই হঠাৎ গায়ের জড়ানো কাঁথার দিকে নজর পরে তাঁর। মিষ্টার সান্যালকে বলেন;
“দেখো..., নকশী কাঁথা...!!” মিসেসের কথা মিষ্টার সান্যাল ঘুরে ফিরে চারদিকে দেখতে থাকেন গায়ে জড়ানো কাঁথাকে। দুটি হাঁটুকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে মাথা নিচু করে আরো কুঁকড়ে যান নিলাদ্রীর মা।
“ দেখি মা...” মধু চট করে একটা হালকা শাল নিয়ে এসে শাশুড়ীকে জড়িয়ে কাঁথাটা খুলে দেয়। তারপর সকলের সামনে এনে বিছিয়ে দেয় বিছানায়। বিস্ময়ে দুজনে কাঁথাটা খুঁটিতে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। কী অসম্ভব ধৈর্য্য, দক্ষতা আর নান্দিকতার অপূর্ব মেল বন্ধন... স্তম্ভিত হয়ে যান দু’জনে।
নিলাদ্রী আর মধু অবাক চোখে দাঁড়িয়ে ভাবে, এত মূল্যবান, এত কদর এই কাঁথার...! আগে জানলে তো...।
“মাসিমা, আপনি করেছেন?” মিস্টার সান্যাল পাশে বসে জিজ্ঞাসা করেন নিলাদ্রীর মা’কে।
“হ্যাঁ, বাবু যখন খুব ছোট, সেই সময়ে করেছিলাম...”।
“আমাকে একটা করে দেবেন মাসিমা?” দু’হাত দিয়ে নিলাদ্রীর মায়ের হাত ধরেন মিসেস সান্যাল ।
“এখন কি পারবো? চোখে ভালো দেখতে...” কথাটা শেষ করতে দেয় না মধু।
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন দিদি, মা ঠিক পারবে”। এবারে কথা বলে নিলাদ্রী;
“ঠিক আছে মা, তোমার কী কী লাগবে বলে দিও, আমি এনে দেবো”।
ডিনারের পর মিষ্টার আর মিসেস সান্যাল বিদায়ের সময় আর একবার প্রণাম করলেন নিলাদ্রীর মা’কে। নিলাদ্রী নিচে নেমে তঁদেরকে গাড়িতে তুলে ফিরে এসে মা’কে জড়িয়ে পাশে বসে।
“আচ্ছা বাবু, ওদের কাঁথাটা করে দিলে তোর কি মাইনে বাড়বে?”
“হ্যাঁ মা, একটা প্রমোশন হবার কথা আছে। আর প্রমোশন হলে মাইনে তো বাড়বেই মা”।
“তাহলে তুই কালকেই নানা রঙের সুতো আর কয়েকটি সূঁচ নিয়ে আসিস। আমার করেকটি সাদা শাড়ী আছে, তাতেই হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না বাবু, আমার যত কষ্টই হোক, তোর জন্য ঠিক করে দিয়ে যাব”।
.....................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন