রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                       


সাইকেল 


১) 

  সাইকেলটা সামনের গাছে ঠেস দিয়ে রাখা।  উলটোদিকে অন্য এক গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক যুবক। দুধারে সবুজ ধানক্ষেতে দোলা লেগেছে আচমকাই। একটা ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে দুলিয়ে দিয়ে গেল সেই যুবকের মনও। গ্রাম বলতে যা ছবি আমাদের চোখের সামনে এসে যায়, অবিকল সেরকমই একটা পিকচার পোস্টকার্ডের ছবি তার চোখের সামনে। খেতের মাঝখান থেকে একফালি পাকা, বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে দুদিকে।  কোথাও কোনো বাড়তি আবর্জনা নেই এই গ্রামে। যখন তখন বর্ষা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উত্তর পূর্ব সীমান্ত এলাকার গ্রামে। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা দূরেই, ফলে এই অঞ্চলে তেমন জল জমে না। কাদা জমে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে না চারদিক। আর সবুজ যে এত ঘন, নরম আর মোলায়েম হতে পারে এই ছেলেটির তেমন জানা ছিল না আগে। ছোটো ছোটো বাড়িগুলোর বেশিরভাগই পাকা, খড়ের বা টিনের চালে ছাওয়া, নয়ত পাকা ছাদ। ছাদের মাথায় লাউ, কুমড়ো শাক শনশন করে বেড়ে উঠছে এই তেজী হাওয়ায়। যুবক এখন লাউশাক, কুমড়ো শাকের ঘন্ট খেতে শিখেছে, খেতে শিখেছে ভাত, ডাল আর নদীর মাছও। সাইকেল এসবের সাক্ষী। ওর দিকে চোখ গেল তার। সাইকেলটা যেন চোখ মটকে কী একটা ইঙ্গিত করল ওকে। একটু কি আরক্ত হল যুবকের মুখ? সাদা রঙে তামাটে ছোপ পড়লেও তার টকটকে গালে লজ্জার ছাপ। লজ্জা পাওয়ার যে সহজাত বোধ, সেও কি এখানে এসে সে শিখে ফেলল এই ক’মাসে? 

অলস বসার ভঙ্গী ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এবারে সোজা হয়ে বসল সে। পাশে রাখা গিটারে টুংটাং বোল তুলতে গিয়েও থেমে গেল।  তারপর আবার দ্বিধা নিয়ে সুর তুলল, গেয়ে উঠল দু কলি- 

No puede ser

no soy yo

me pesa tanto el corazón

por no ser de hielo cuando el cielo me pide paciencia

  আর সেই সময়েই যেন মাটি ফুঁড়ে দুটি শিশু হাজির হল ওর সামনে। ওদের দেখে গান থামাল সে। কিন্তু শিশুদুটি সমস্বরে বলে উঠল, আবার গাও, আবার গাও। মানে কী এই গানের?

  সে এখন মোটামুটি বোঝে ওদের ভাষা। নিজের ক্ষমতায় যেটুকু কুললো, তাতে বলল, ‘মানে? মানে জেনে কী করবি তোরা? গানের সুরই হল সব। আর কথারও প্রয়োজন আছে বৈকি! তবে তার মানে যেমন খুশি ধরে নিলেই হবে। ওই যে আকাশ দেখছিস, ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে—কেন তোমার মন এত ভারি হয়ে আছে আজ? আমি ওকে বললাম—না, না এ আমি নয়, আমি হতেই পারে না। অন্য কেউ, যার মনে বরফ জমেছে, সে আমি নয়, অন্য কেউ, অন্য কেউ……’

এক ক্ষুদে কোলের কাছে ঘেঁষে এল যুবকের। ‘তোমার কি মন খারাপ করছে দেশের জন্য?’  


(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন