রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                   


 মন এবং চার যুগ :



যুগের ভেদে মানব মনের প্রকৃতির বদল ঘটে। তাহলে দেখি, চার যুগ কেমন ছিল?
 ১. সত্য যুগ: 
     পুরাণ ঘেঁটে তথ্য পাওয়া যায়, এই যুগ ছিল মোট__১৭, ২৮, ০০০ বছর। অবতার প্রসঙ্গ যদি আলোচনায় আনতে চাই , দেখব__মৎস, কুর্ম, বরাহ, নরসিংহ __এই চার অবতার। এই সময় শুধুই পূণ্য। পাপ ছিলনা। মৃত্যু ইচ্ছাধীন। সোনার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল পুষ্কর। 
একটু ব্যাখ্যা করি এই যুগটির। পাপ ছিল না। শুধু পুণ্য ছিল। 
অর্থাৎ, সকলেই মহান। পাপ হীন। এবার ধরা যাক, এমন ইস্কুলে আমি এলাম, যেখানে সকলে ফাস্ট হয়। তাহলে, সেখানে নিজেকে প্রমাণ করতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে? তাই তো? সত্যযুগে ছিল তপস্যার কম্পিটিশন। সেরার মধ্যে সেরা হতে গেলে যা যা করতে হবে, সত্য যুগের মানুষ তাই তাই করতেন। তারপর অভীষ্ট লাভ হত। সুতরাং , বিচার করলে দেখা যায়, সত্য যুগ ছিল কঠিন পরিশ্রমের যুগ। দেবতা বলে যে জাত ছিল, যাঁরা এই সব সত্যবাদী তপস্বী মানবদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারত না। মনে রাখতে হবে, দেবতা কিন্তু পরম ব্রহ্ম নন। শুধু , ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ __ছিলেন সেই ভগবান ... যাঁদের জন্য কঠোর তপস্যা করতে হত। এমনকি দেবতাদের ও করতে হত। সে যাই হোক, সত্য যুগের কাহিনীতে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল। এই যুগের নায়ক , প্রহ্লাদ, ভক্ত প্রলহাদ হিসেবে যিনি বিখ্যাত, তাঁর জীবন কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। মহর্ষি বাল্মীকির মত ওইরকম প্রতিভাধর কবি থাকলে, প্রহ্লাদ কাহিনী আজ ঘরে ঘরে আলোচনা হত। অসির চাইতে মসি অনেক বেশি ক্ষমতাবান, সেটা বাল্মীকি প্রমাণ করে গেছেন।  আর ওই যে দাবি?  সত্য যুগ অর্থাৎ মিথ্যা হীন যুগ... সম্পূর্ণ ঘটনা জানলে একটু কেমন কেমন যেন লাগে। তাহলে , ঘটনা একটু বলি বরং। 
    ভক্ত প্রহ্লাদ, নামের মতই স্বভাব। মধুর স্বভাব, সর্বদা হরি নামে বিভোর। মুশকিল হল, ওই রকম সত্যযুগে ও, তাঁর প্রতি অমানুষিক অত্যাচার করলেন তাঁর জন্মদাতা পিতা , হিরণ্যকশিপু।  এই যে সর্বক্ষণ দেখানো হয়, ভক্তদের প্রতি অত্যাচার করা হচ্ছে এবং ভগবান এসে রক্ষা করছেন... এই ব্যাপার একটু অদ্ভুত লাগে না? তবে কি , ভগবান কতখানি শক্তিমান , সেটা প্রমাণ করার জন্য এইরকম কাহিনী রচনা করা হয়েছিল? 
 পৃথিবী সবে গড়ে উঠছে। মানব জাতি নিজেকে প্রমাণ করছে। যুগভেদ বা তার সঙ্গে গল্পগুলি মানব সৃষ্ট __এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শৃঙ্খলাাহীন পৃথিবী ধর্মের শিকল পরে , বশ্যতা স্বীকার করবে সহজে। এই পদ্ধতি যথেষ্ট সম্মান জনক এবং আধুনিক ছিল। কালক্রমে বিকৃতি যদি আসে, সে দোষ কিন্তু নিয়মের নয়, সে দোষ করা হয়, কোনো ব্যক্তি স্বার্থের জন্য। 
 যেমন , এই যে তত্ত্ব , সাধনা করো , ঈশ্বর লাভ হবে। এক্ষেত্রে , সাধনা যদি dedication বোঝানো হয়, তবে dedicated লোক , ভালো ফল পাবে। ঈশ্বরের মত ভালো কিছু, সুন্দর কিছু, মঙ্গল কিছু লাভ করবে। সাধনা করা অর্থাৎ ইতিবাচক দিকে মন নিয়ে যাওয়া। 
ভক্ত প্রহ্লাদ , প্রচুর অত্যাচারিত   হচ্ছিল শুধুমাত্র হিরণ্যকশিপু র বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। তবু, সে আপোষ করে নি। বালক বয়স থেকে  তিনি সেটাই করেছেন, যেটা তিনি ঠিক মনে করেছেন! মৃত্যুর মুখ থেকে বারবার ফিরে এসেছেন, রাজ্য , সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন... কিন্তু, মাথা নত করেন নি। শেষ পর্যন্ত , রেজাল্ট ভালো হয়েছে। ঈশ্বর এসেছেন কাছে।  আমাদের ধর্মের এই সবচেয়ে মহৎ গুণ। অলৌকিক তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে লৌকিক সত্যকে তুলে ধরা। রোজকার জীবন, তেল মশলার জীবন, যৌনতা , অধিকার বোধ ইত্যাদির জীবন... সেখান থেকে একটু সরে গিয়ে অলৌকিক কিছু দেখালে বা শোনালে , মানব মন আকৃষ্ট হতে বাধ্য। এইবার , সেখান থেকে শিখে নাও জীবনে চলার ধর্ম।
ত্রেতা যুগ

২.

চারযুগের দ্বিতীয় যুগ হল, ত্রেতাযুগ। এর পরিমাণ , ১২, ৯৬, ০০০বছর। পুণ্য তিনভাগ। পাপ এক ভাগ। অর্থাৎ, পাপের প্রবেশ ঘটেছে। এই যুগের কিছু বিশেষত্ব ছিল। এই সময় থেকে নতুন করে জেগে উঠেছে ভারতবর্ষ। জ্ঞান বিজ্ঞান শৌর্য বীর্য  সাহিত্য কাব্য ... সব দিকেই উঠছে নতুন সূর্য। সূর্য বংশ। নতুন নায়ক__শ্রীরামচন্দ্র। সত্যবাদ, ন্যায়বাদ ,যুক্তিবাদ সেই সঙ্গে প্রথম অনুভূত অপরাধবোধ। পাপ বোধ...জাতিভেদ , বর্ণভেদ... ত্রেতা যুগের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ  করলে মনে হয়, আধুনিক নাগরিক জীবনের জটিলতা এই যুগ থেকেই শুরু হল। 
   নারীর ভূমিকা নিয়ে সংশয়, নারীকে ঘিরে বিতর্ক, বিবাদ এমনকি যুদ্ধ পযর্ন্ত শুরু হল। ত্রেতা যুগ , ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের চেনা যুগ। মনে রাখতে হবে, অনর্থক অলৌকিক কোনো ভাবনা কিন্তু এই যুগে তেমন করে গুরুত্ব পায়নি। শ্রীরামচন্দ্র আদর্শ মানব হিসেবে স্থান করে নিলেন ইতিহাসে।
 রাম + আয়ন__রামায়ণ __লেখা হতে থাকল তাঁকে কেন্দ্র করে।   কালক্রমে এই আদর্শ মানব, দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। নানা ঘটনার সাক্ষী ত্রেতা যুগ। যে ঘটনা কালের বিচারে স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে ইতিহাসে। 
    চার যুগের বিচারে, আমার মতে, ত্রেতা  হল শ্রেষ্ঠযুগ।
দ্বাপরযুগ

৩.
 তৃতীয় যুগ। এর পরিমাণ: 
 ৮, ৬৪, ০০০ বছর। পুণ্য অর্ধেক। পাপ অর্ধেক। দ্বাপর যুগ___
  ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, আধ্যাত্মিক__ সব দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য যুগ। কারণ, এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। 
এমন একজন যুগপুরুষ, যাঁর কথা শত মুখে ব্যাখ্যা করলে, আবার নতুন করে কিছু বলতে হয়। যেহেতু অর্ধেক পাপ থাবা বাড়িয়ে দিচ্ছে তখন, সে জন্যে প্রচুর জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ লোভী প্রতারক হত্যাকারী হয়ে উঠছে। একে অপরের সম্পত্তি গ্রাস করার  জন্য হানাহানি করছে। প্রাচীনকে অপমান করছে নবীন। এই সময়, দুষ্ট শাসক মহাশক্তিশালী। যেমন , কংস। শিশুপাল জরাসন্ধ প্রমুখ। সংকটে  আছে সৎ নিরীহ মানুষ। যেমন পাণ্ডব। দেশ জুড়ে হাহাকার। অশান্তি। এই সময় আবির্ভাব কৃষ্ণের। 
সুতরাং , সব দিক দিয়েই দ্বাপর যুগ উল্লেখযোগ্য।
8.
কলিযুগ
____________
এবার বলি, কলিযুগের কথা। আমাদের কাছে খুবই গুরত্বপূর্ণ। এর পরিমাণ: 
৪, ৩২,০০০ বছর। পুণ্য একভাগ। পাপ তিনভাগ। এক অদ্ভুত সময়। সৎ হলে পতন। দুষ্ট হলে সফলতা। পুরাণ যা যা বলছে, তাতে কলিযুগের ভালো বলতে কিছু নেই। কুটিল, হিংস্র , নারীর অপমান, তপস্যা ধর্ম সব রসাতলে। আবার, গুরুমুখী সাধনা তুঙ্গে।  মানুষের গড় আয়ু ১০০র কাছাকাছি। কলিযুগ অদ্ভুত যুগ। মানুষ আর মেশিন একসঙ্গে মিলে পৃথিবী জয় করবে। নাম যশের কারণে , মানুষ হত্যা পযর্ন্ত করতে পিছপা হবে না। 
   কলিযুগ সম্পর্কে, ঋষি মার্কন্ডেয় অনেক কথা বলেছেন। তিনি কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। দিব্যদৃষ্টির অধিকারী।  তাঁর সম্পর্কে আমি পরে লিখব। যাই হোক, প্রচুর নেতিবাচক দিকের মধ্যে, কলিযুগে দুটি ভালো দিক আছে। একটি হল, এই যুগে দান হল সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর হরিনাম সংকীর্তন করলেই মোক্ষলাভ। 
  অন্যান্য যুগে প্রচুর পরিশ্রম করে সিদ্ধি লাভ হয়, কলিযুগ সেইদিক দিয়ে সহজ পথ দেখিয়েছে। অল্প ভালো কাজ বিনিময় প্রচুর লাভ।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন