আলেকজান্ডারের স্বপ্ন
হেফাস্টিয়ান, অত্যন্ত জরুরি ব্যপারে তোমাকে ডেকেছি।
আলেকজান্ডার তাঁর প্রিয় সহচর ও প্রধান পরামর্শদাতার দিকে তাকিয়ে বললেন।
বলুন মহারাজা! আপনি কি নতুন কোনও অভিযানের কথা ভাবছেন? বেশ
কিছুক্ষণ আগেই রাজা আলেকজান্ডারের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন আবার
তাঁকে ডেকে পাঠানোয় একটু অবাকই হয়েছেন হেফাস্টিয়ান।
হুম। ঠিকই ধরেছ। এই কারণেই তোমাকে এত ভালোবাসি হেফাস্টিয়ান।
স্মিতহাস্যে আলেকজান্ডারের প্রশংসা উপভোগ করলেন
হেফাস্টিয়ান। তিনি জানেন ম্যাসিডোনিয়ার রাজা, সদ্য পারস্যজয়ী আলেকজান্ডার তাঁকে
কতটা ভরসা করেন। তিনিও তার প্রতিদান দেন সর্বদা সুপরামর্শ দিয়ে। তিনি মহারাজের
প্রায় ছায়াসঙ্গী বলা যায়। মুখের হাসি ধরে রেখেই হেফাস্টিয়ান বললেন, এবার কোনদিকে
আমাদের বিজয়রথ এগিয়ে নিতে চান রাজা?
ভারতবর্ষ! আমি এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ অভিযান ছাড়া আর কিছু
ভাবতে পারছি না। সোনার এক দেশ ভারতবর্ষ। এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।
বেশ মহারাজ। আমরা তাহলে তারই প্রস্তুতি নিই।
কিন্তু হেফাস্টিয়ান, শুধু ভারতবর্ষ অভিযানের কথা বলার জন্য
তোমাকে ডেকে পাঠাইনি। তা নিশ্চিত তুমি বুঝতে পেরেছ। আমি সংবাদ পেয়েছি আমার
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আমারই কয়েকজন সেনাপতি। সে ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে আলোচনা
করতে চাই।
ষড়যন্ত্র? মুখের রেখায় যতটা সম্ভব বিস্ময় এঁকে বললেন
হেফাস্টিয়ান। ইতিমধ্যে তাঁর কানেও এইরকম একটি সম্ভাবনার কথা এসেছে। কিন্তু নিশ্চিত
না-হয়ে রাজাকে বিষয়টা বলতে চাননি তিনি। এদিকে জেনেও তাঁকে না-জানানোর ব্যাপার
বুঝতে পারলে ক্ষুব্ধ হবেন রাজা। তাই বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে তুলতেই হয়েছে। অবাক হয়ে
জানতে চাইলেন, আপনাকে এই সংবাদ কে দিল মহারাজা?
গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি আমি। এবং নির্ভুল সংবাদ। বেশ জোরের
সঙ্গে বললেন আলেকজান্ডার।
যে সূত্র থেকে হেফাস্টিয়ান ষড়যন্ত্রের কথাটা শুনেছেন, তার
কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। আলেকজান্ডারের মতো এমন একজন রাজার বিরোধিতা
কেউ করতে পারে! গভীর ভাবনায় তিনি যখন ডুবে আছেন, তখন আলেকজান্ডার বলে উঠলেন, আমি
ম্যাসিডোনিয়ার সন্তান। তাই ম্যাসিডোনিয়ান ভাষায় কথা বলি। মাতৃভাষায় কথা বলতে আমার
সবথেকে ভালো লাগে। গ্রিক সেনাপতিরা এতে নাকি ক্ষুব্ধ! তাদের জাত্যাভিমানে আঘাত
লাগে! গ্রিক হল মহান কবি হোমারের ভাষা। আমার গুরু অ্যারিস্টটলের ভাষা। আমি তো সেই
ভাষাতেও কথা বলি মাঝে মাঝে! তাও এদের এত ক্ষোভ?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন হেফাস্টিয়ান। তাঁর মনে পড়ে গেল,
কয়েকদিন আগেই আলেকজান্ডার বিশাল সেনা সমাবেশের সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সেনাপতিদের
নাম ধরে ডাকছিলেন। গ্রিক সেনাপতিদের সঙ্গে গ্রিক ভাষাতেই কথা বলছিলেন। এসব ভেবেই
হেফাস্টিয়ান বললেন, আপনি বিচলিত হবেন না মহারাজ! ম্যাসিডোনিয়ার সৈন্যসংখ্যা
পঁয়ত্রিশ হাজার। আর গ্রিক সেনাদের সংখ্যা মাত্রই সাত হাজারের কিছু বেশি। গ্রিকরা
খুব-একটা সুবিধে করতে পারবে না।
তা ঠিক হেফাস্টিয়ান। তবে শত্রু যত সামান্যই হোক তাদের
অবহেলা করা যথাযথ মনে করি না আমি। আসলে আমি চাই ষড়যন্ত্রের বিনাশ হোক। ষড়যন্ত্র
যদি সত্যিই দানা বাঁধে, তাহলে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তখন সেনাদের
নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না ঠিকভাবে। আমি সেইরকম পরিস্থিতি আসুক চাইছি না।
ঠিক বলেছেন মহারাজ। সবার আগে প্রয়োজন এই ষড়যন্ত্রকারীদের
শক্ত হাতে দমন করা।
ঠিক। ঠিকই তাই। তুমি ভাবতে পারো হেফাস্টিয়ান, অশ্বারোহী
কমান্ডার ফিলোটাসকে আমি বন্ধু মনে করি। তাকে নানাভাবে সুযোগসুবিধা দিই। সেও কিনা
আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে! সেনাপতি ক্লোটিয়াস, আমারই মাতৃভূমি মেসিডোনিয়ার
সন্তান। সেও ষড়যন্ত্র করছে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার! আমাকে এরা হত্যা করতে চায়!
এদের কঠিন শাস্তি দিন মহারাজ। মৃত্যুদণ্ডই এদের প্রাপ্য।
এত দ্রুত কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না হেফাস্টিয়ান। আরও
ভেবে দেখতে হবে। এতদিন ধরে এরা আমার সঙ্গে আছে। নানা যুদ্ধে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে।
আচমকা তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আরও একটু ভাবতে দাও। এদের
অভিসন্ধি ভালোভাবে না-জেনে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে হেফাস্টিয়ান।
রাজার কথা শুনে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন হেফাস্টিয়ান।
কিন্তু আর কোনও মন্তব্য করলেন না। আলেকজান্ডারের মতামতের অপেক্ষায় থাকলেন।
এরা আসলে ভারতবর্ষ অভিযানে যেতে চাইছে না। সৈন্যদেরও ভুল
বোঝাচ্ছে। আমি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলাম, ভারতবর্ষ অভিযানই আমাদের শেষ অভিযান। এই
দেশ জয় করে আমরা ফিরে যাব আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। এটুকু ধৈর্য তাদের থাকবে না!
গ্রিকরা বীরের জাতি। তাদের পক্ষে যুদ্ধ না-করার বাহানা মেনে নেওয়া যায় না
হেফাস্টিয়ান! অধৈর্য হয়ে বললেন আলেকজান্ডার।
সত্যিই তাই। আমাদের কাছে আছে বিশাল সেনাবাহিনী। তারা যুদ্ধে
ভীষণ দক্ষ। এমনিতেই আমাদের বিশাল সাম্রাজ্য। আরও অনেক রাজ্য জয় করে অনায়াসে আমরা
সাম্রাজ্য বাড়িয়ে নিতে পারি। বললেন আলেকজান্ডারের পরামর্শদাতা।
সেকথাই তো বলতে চাইছি হেফাস্টিয়ান। কত সৈন্যসামন্ত আমাদের।
নানা দেশের। নানা জাতির। অথচ কী আশ্চর্য, সবচেয়ে বেশি ষড়যন্ত্র করছে আমার স্বদেশের
মেসিডোনিয়ান আর গ্রিকরা! এই সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতেই হবে। ভারতবর্ষ অভিযান
আমার স্বপ্ন হেফাস্টিয়ান। একে সফল করতেই হবে। তারপর ফিরে যাব স্বদেশে। কিন্তু
কীভাবে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় ভাবতেই হবে।
(ক্রমশ:)
চিত্র- অন্তর্জাল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন