আ
আমার মাথাতেও কিছু আসছে না
মহারাজ। হতাশ গলায় হেফাস্টিয়ান কথাটা বলেই যোগ করলেন, এইসময় আমাদের দরকার ছিল গুরু
অ্যারিস্টটলকে। তিনি সঠিক দিশা দিতে পারতেন।
ঠিক। একদম ঠিক বলেছ। আমার
মাথাতেই আসেনি মাস্টারমশাইয়ের কথাটা। তাঁর পরামর্শ খুব জরুরি এখন। উনি আছেন
এথেন্সে। তুমি দ্রুত যাও ওনার কাছে। ওনার মূল্যবান মতামত নিয়ে এসো।
এথেন্স এখান থেকে অনেক
দূরে মহারাজ! সডগিয়ান থেকে সেখানে যাওয়া, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করা, আবার ফিরে
আসা... বিরাট সময়ের ব্যবধান। এই মুহূর্তে আপনার পাশে আমার সবসময় থাকা অত্যন্ত
প্রয়োজন। আপনাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমি স্বস্তি পাব না। তার চেয়ে একজন বিশ্বস্ত
সেনাকে পাঠানো যেতে পারে। তার ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা যেভাবেই হোক এদের সামলাতে
পারব।
কথাটা মনে ধরল
অ্যালেকজান্ডারের। তিনি মনে মনে স্বীকার করলেন, হেফাস্টিয়ান সঙ্গে থাকা মানে মনোবল
অনেকটাই বেড়ে যাওয়া। তাই বললেন, বেশ, তবে তাই করো। খেয়াল রেখো দূত যেন ষড়যন্ত্রকারীদের
সঙ্গে যোগাযোগ না-করে। সে যেন গুরুর পরামর্শ ফাঁস করে না-দেয়।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন
মহারাজ। আমি যাকে পাঠাব সে খুবই বিশ্বাসী। প্রাণ যাবে, তবু বেইমানি করবে না।
(২)
বিশ্বস্ত সেনা হেরাসকে
পাঠানো হল এথেন্সে। সে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, দীর্ঘদিন বাদে এসে পৌঁছল এথেন্সে। এখানে
অ্যারিস্টটলকে সকলেই চেনে। তিনি একজন জ্ঞানী পুরুষ ও রাজা আলেকজান্ডারের গুরু
হিসাবে পরিচিতি। তাই অতি সহজেই হেরাস পৌঁছে গেল অ্যারিস্টটলের গৃহে।
অ্যারিস্টটল তখন তাঁর ঘরে
বসে আছেন। তাঁর চোখ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। তবে তিনি যে কিছুই দেখছেন না তা বোঝা
যাচ্ছে তাঁর বাহ্যজ্ঞানহীন দৃষ্টি দেখেই। কোনওকিছু নিয়ে তিনি গভীর ভাবনায় ডুবে
আছেন। এমনকি ঘোড়ার পদশব্দও শুনতে পাননি তিনি, এতটাই নিমগ্ন হয়ে আছেন।
মহান রাজা আলেকজান্ডার
আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। হেরাসের কথা অ্যারিস্টটলের কানে পৌঁছল না। তিনি ভেবেই
চলেছেন কোনও গভীর বিষয়ে। হেরাস আবার বলল একই কথা। এবার বেশ জোরেই বলল সে।
সম্বিত ফিরল
অ্যারিস্টটলের। তিনি মুখ ফিরিয়ে দেখলেন সেনাটিকে। হেরাস প্রায় একই কথা উচ্চারণ
করল। তিনি তরুণ সেনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
আলেকজান্ডার তোমাকে কেন পাঠিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে? তার কোনও বিপদ ঘটেনি তো!
না মহামান্য। বিপদ তেমন
নয়। আবার বিপদও বলতে পারেন।
ভ্রু কুঁচকে উঠল
অ্যারিস্টটলের। বিপদ নয়, আবার বিপদও! তুমি বোসো এখানে। তারপর সবিস্তারে বলো ঘটনাটা
কী। কথাটা বলেই একটি পাথরের বেদি দেখিয়ে দিলেন অ্যারিস্টটল।
মহারাজার গুরু। তাঁর সামনে
বসতে একটু ইতস্তত করলেও অবশেষে বসে পড়ল সেখানে হেরাস। এরপর আলেকজান্ডার ও
হেফাস্টিয়ান যেমন করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, হুবহু সেভাবেই বুঝিয়ে বলল
অ্যারিস্টটলকে।
অ্যারিস্টটল কখনওই বক্তার
কথার মাঝে কথা বলেন না। তিনি বক্তাকে বলতে দেন। তারপর নিজের মতামত দেন। এমনকি কারও
ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়াও তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। এক্ষেত্রেও হেরাসের কথা মন দিয়ে
শুনলেন।
নিজের বলা শেষ হলে
জিজ্ঞাসা করল হেরাস, এবার আপনি বলুন গুরুদেব, আমাদের মহান রাজার কর্তব্য কী? আপনার
পরামর্শ নিয়ে দ্রুত ফিরে যাব সডগিয়ায়। সেখানে আপনার সুপরামর্শের আশায় অপেক্ষা
করছেন আমাদের সম্রাট।
অ্যারিস্টটল উঠে দাঁড়ালেন।
একটি শব্দও উচ্চারণ না-করে চলে গেলেন পাশের ঘরে। তাহলে কি লিখবার সরঞ্জাম আনতে
গেলেন গুরুদেব? শিষ্যকে লিখে জানাবেন তাঁর মতামত? ভাবল হেরাস। কিন্তু বিস্মিত হয়ে
সে দেখল অ্যারিস্টটল একটা বিরাট আকারের ছুরি নিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সোরেস
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সে তো কোনও অন্যায় বাক্য বলেনি! মহারাজার হুকুম তামিল করেছে
মাত্র! অ্যারিস্টটল তার দিকে দৃকপাত না-করে ছুরি নিয়ে চলে গেলেন বাগানের দিকে।
তাকে যে হত্যা করতে ছুরি হাতে নেননি গুরুদেব, তাতেই সে আশ্বস্ত হয়ে তাঁর পিছন পিছন
চলে এল বাগানে। অবাক হয়ে দেখল অ্যারিস্টটল ছুরিটা দিয়ে একের পর এক গাছের শুকনো ডাল
কেটে চলেছেন। হলুদ হয়ে যাওয়া ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছেন তিনি। কী আশ্চর্য! একটি
অত্যন্ত গুরুতর বিষয় জানতে সে এখানে এসেছে, সেসব গুছিয়ে বলেওছে। আর অ্যারিস্টটল
সেসবের জবাব না-দিয়ে গাছপালা কাটছেন! হেরাসের মনে হল, আমাদের সম্রাট বদরাগী। আচমকা
সেনা বা সেনাপতির ওপর রেগে যায়। যদিও সেই রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আর তাঁর গুরুদেব কেমন যেন আধ-পাগল। সবকিছু
শুনেই নির্বিকার হয়ে বাগান পরিচর্যা করে চলেছেন। রাজার গুরু বলে কথা! তাঁর সঙ্গে
তো আর খারাপ আচরণ করা যায় না। অপেক্ষা করতেই হবে তাকে। এই ভেবে হেরাস চুপ করে
দাঁড়িয়ে থাকে তফাতে।
কিছুক্ষণ পরে সমস্ত কেটে
ফেলা ডালপালা জড়ো করে একটা গর্তের মধ্যে ফেললেন অ্যারিস্টটল। বিড়বিড় করে বললেন,
এগুলো এখানে জমা থাক। এর থেকে ভালো সার হবে। এই বলে তিনি বাগানের মধ্যে থাকা একটা
পাথরের ওপর বসে পড়লেন। বহুক্ষণ বাদে গুরুদেবের মুখে এইটুকু বাক্য শুনতে পেল হেরাস।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সে বলল, আমাকে আপনার পরামর্শটা জানান মহামান্য। আমি দ্রুত
ফিরে যেতে চাই। মহারাজা উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।
অ্যারিস্টটল মুখ তুলে
তাকিয়ে ভালো করে জরিপ করলেন তরুণ সেনাটিকে। তারপর কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
আলেকজান্ডার যা জানতে চেয়েছে, আমি তো তার জবাব দিয়ে দিয়েছি!
জবাব দিয়ে দিয়েছেন! কখন
দিলেন! এই নিয়ে তো একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি গুরুদেব! এবার সে নিশ্চিত হয়ে গেল,
সে যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। এই বৃদ্ধ ছিটগ্রস্ত। তবু সে আর-একবার জানতে চাইল, তাহলে
আমি মহারাজাকে গিয়ে কী বলব?
(ক্রমশ:)
চিত্র- অন্তর্জাল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন