বাক্য ও জীবন
বাক্য কয়েকটি শব্দের সমষ্টি। অথবা একটি মাত্র শব্দও বাক্য হতে পারে। মানুষের মনের ভাব প্রকাশ বাক্যের সাহায্যেই সম্পূর্ণ হয়। মনের ভাব--অর্থাৎ মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ফুটে ওঠে বাক্যের মাধ্যমে।
মন দেখা যায়না। স্পর্শ করা যায়না। অথচ মন হল সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকট ইন্দ্রিয়। শরীর নানা ভাবে তুলে ধরে মনের ভাব। বাক্য তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।
বাক্য দুরকম। উচ্চারিত আর অনুচ্চারিত। জীবনের ষাট ভাগ হল অনুচ্চারিত বাক্য। বেশিরভাগ কথা মানুষ ভিতরে রাখে। আর যেগুলো বলে সেগুলোও অনেক সময় সেটা বাদ দিয়ে বলে , যেটা সে বলতে চায়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্থ বহু পরিবার কথা হারিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশে থাকাকালীন রাশভারী ছিলেন, অথচ কলকাতা এসে হয়ে উঠলেন তোষামুদে , অকারণ হ্যা হ্যা করা মানুষ। ভিতরের কষ্টের কথা ক্ষতের কথা বলতে না পেরে হয়ে উঠছেন অবিন্যস্ত।
রেপড হওয়া চোদ্দ বছরের এক মেয়ে এসেছিল আমার কাছে। ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকা শুধু। শরীরের চাইতে মন হয়েছিল অনেক বেশি রক্তাক্ত। তখন তার নিরাময় নির্ভর করছিল স্বাভাবিক কথা বলার উপর। সেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার লড়াই সহজ ছিল না।
আমার কাজ হল--how to motivate our daily life----অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন পাঁচপাঁচির জীবন ছোট ছোট সমস্যার কাঁকড়ে আক্রান্ত হয়। আমরা পাত্তা দি না। অথবা দেখেও ভান করি না দেখার। অবশেষে সেই কাঁকর জমতে জমতে পাহাড়। তখন ছোট মনের ডাক্তারের কাছে। গেলো একগাদা ওষুধ।
একটা দিন আসলে একটা জীবন। কেন? ভাবলে দেখা যায়, ভোর বেলার আমি, বেলা বারোটার আমি, বিকেলের আমি, রাতের আমি--মানুষ এক--চরিত্র আলাদা। প্রত্যেক সময় ভাবনা বদলেছে, মন পাল্টেছে, কথা বদলে গেছে। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ঘরের বাতাবরণ পরিবর্তন হচ্ছে। কাজের মহিলা এল না? অফিসে বস ক্ষেপে গেল; ফেসবুক লাইক কমেন্ট কম দিল; বন্ধু চ্যাটে এল না--হরেক কিসিমের সমস্যা, মাথা গরম।গরম মাথা নিয়েও মুখে হাসি রাখতে হয়। মন ভাবছে এক, মুখ বলছে আর এক।
সবাই বলবে, এগুলো তো পার্ট অফ লাইফ। তাই কি? এত সহজ সমাধান হলে আজ মনের ডাক্তারের চেম্বারে এত ভীড় হত না।
মনে, রোজ রোজ জমা হচ্ছে হাজার অভিযোগ। বেশিরভাগ অকারণ। মনের ডাস্টবিন উপচে পড়ছে। বাক্যর ঝাড়ু পারে সেগুলো ঝেঁটিয়ে তুলে ফেলতে। কিন্তু সে বলবে না। ভাববে কিন্তু বলবে না। লোক বলবে বলা যায়না সবসময়। কিন্তু, ভাবাও তো বলা।
--অমুক খুব পাজি। খুব সুবিধাবাদী। একদম সহ্য হয়না --এমন ভাবনা কিন্তু ক্ষতি করছে নিজের। তারচেয়ে চোখ কান বুজে বলে ফেলা অনেক ভালো। হয়ত দেখা গেল, ভাবনা ছিল ভুল। দুঃখের কথা এই, এমন ভুল ভাবনা বহন করে চলতে পছন্দ করে মানুষ।
নদীর তলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীবন শেষ হয়ে যায় এক সময়। রোজকার জীবন সুন্দর রাখতে হলে একটা দিনকে লক্ষ করতে হবে ভালো করে। দেখা যাবে,ভোর থেকে রাতের পরিক্রমায় কথার বিশেষ ভূমিকা আছে।
বহু সমস্যা পারস্পরিক কথা বলাবলিতে কেটে যায়। মনে রাখতে হবে, কোনো সম্পর্ক অনর্থক নয়। সাধারণ জীবনে একে অন্যের সঙ্গে সুন্দর সহাবস্থানের অপর নাম হল জীবন। বাক্যকে সঠিক উপায়ে মধ্যস্থতা করতে ডাকলে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে উকিলের দরকার পড়বে কম।
আমরা কি চাই? আমরা ঠিক কি বলতে চাই? সেটা ডাক্তার হোক বা উকিল--সে ভালো বুঝবে না আমি নিজে বুঝব? আমার অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব অন্য লোকের হবে কেন? নিজের অবস্থান নিজেকেই তো ঠিক করতে হবে।
বাক্য সংকট ত্রাতা। মনের জমে ওঠা আবেগ মাইক হাতে নিয়ে না বলতে পারলেও, নিজের কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিন। অনেক শান্তি লাগবে। ঘরের ভারি বাতাস হালকা হয়ে উঠবে। ঘুমের ওষুধ ছাড়াই হয়ত এসে যাবে প্রশান্তির ঘুম।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন