দৌড়
________
বিমল মাস্টার হুমকিই দিয়ে গেলো আসলে। আবার সন্ধ্যার পরে
আসব জানিয়ে বলল, যা ঠিক করার এর মধ্যেই ঠিক কর, এসে
যদি শুনি উল্টা কথা তাহলে আমারেও ভাবতে হবে কিছু। এই ভাবা মানে যে কি সেটা জানে না
তাপস। তবে এটুকু বোঝে পারলে খুনটুনও করাতে পারে বিমল মাস্টার। কেননা মাস্টারের
হাতে ক্ষমতা আর লোকলস্কর কম নেই।
দুপুরের খাওয়ার পর ভাতঘুম দেওয়া একটা অভ্যেস হয়ে গেছে
তাপসের। আজ তাড়াতাড়িই খেলো মতির হোটেলে। এখানে মাসকাবারি খায়। তাপসকে ঢুকতে দেখেই
মতি বলল,
কী গো তপা মাস্টার, আজ এত সকাল সকাল কেন?
দূরে কোনো অপারেশন আছে নাকি?
মুচকি হাসে তাপস। তারপর ধীরে ধীরে মতির দিকে এগিয়ে যায়।
মতির সামনে কাঠের একটা বাক্স। এটাই ওর ক্যাশবাক্স। তার উপর কাগজ আর কলম। কলমটা
আবার একটা সুতো দিয়ে বাঁধা আছে বাক্সের গায়ে। তাপস গিয়ে মতির পাশের টুলে বসে। এখনও
তেমন লোকজন আসেনি। তবু প্রায় ফিসফিস করে বলে, না রে মতি। তোরে তো
কইছিই আমি এইসব কাজ ছাড়লাম। আর করুম না।
~ তা কইছ ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস যায় না। শুনি একবার এই
লাইনে ঢুকলে আর ছাড়া যায় না।
~ সে হয় কোনো দলে থাকলে। আমার তো দলবল নাই। আমি একাই। গত
মাসখানেক কোনো কাজ করি নাই। তোরে তো সবই কই। আর কেউ জানে না আমার কামকাজের হদিশ।
~ জানে না কবা না মাস্টার, এইসব
খবর হাওয়ায় উড়ে। অনেকেই হয়তো জানে, তয় স্বীকার করে না। আসলে
তুমি হইলা গিয়া চালাকের চালাক। তোমারে ধরতে পারে নাই কেউ, তাই
হলফ কইর্যা কইতে পারে না আর কি। আমি নেহায়েত দেইখ্যা ফেলছিলাম। তাই …
~ সেই দেখার মূল্যও তো তুই পাইছস। পাস নাই ?
~ তা পাইছি। আমিও দেওয়া কতাখান রাখছি সেইটা কও?
তপা চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না। মতিই আবার কথা বলে, কামকাজ না করলি পয়সা পাও কই খাওনের? মতি আসলে বুঝে
নিতে চায় মাসকাবারি বাকির টাকাটা সে ঠিকমতো পাবে কিনা।
~ টাকা জোগায় ভূতে। হা হা হা … তুই
কি ভাবস আমার পয়সা নাই? কিছু টাকা তো জমাইছি রে পাগলা।
~ তুমি ওস্তাদ যে সে মাল না। তোমার ঘটে বেজায় বুদ্ধি।
তপা এর কোনো জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, হিসাবটা করতে কইছিলাম। করছস?
~ না হয় নাই। এত তাড়া কিসের? এ তো
দু'মিনিটের কাজ মাস্টার, ধরুম আর
শ্যাষ।
~ কইর্যা ফেল। আজই মিটাইয়া দিমু।
~ কও কী? রাতে কি খাবা না ?
~ না না। বিকালেই চইল্যা যামু আমার সুমুন্দির বাড়ি। তোরে
কইছিলাম কাইল। তর মনে নাই।
সাধারণত বেলা তিনটের আগে খায় না তাপস। আজ একেবারে একটার
মধ্যে খেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। গায়ের আকাশি রঙের ফতুয়াটা খুলে দেওয়ালের গায়ে পোঁতা
পেরেকে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঢ্যালঢ্যালে পায়জামা পরেই চৌকির উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ
বুজল। কিন্তু ঘুমাতে পারল না। লাইনে নতুন নামা বামনাকে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে যাবে
ভেবে রেখেছে। ছেলেটা ওকে গুরু বলে মানে। বলেছে, গুরু কিছু জ্ঞান দাও
মাইরি। একটু করেকম্মে খাই। তোমার পায়ের ধুলো মাথায় দাও ওস্তাদ।
তা কিছু জ্ঞান দিয়েছে বইকি ! কীভাবে নানা কিসিমের তালা
খুলতে হয়,
লকার ভাঙতে হয়, ধরা পড়লে কীভাবে চমকে দিয়ে
পালাতে হয় সব শিখিয়ে দিয়েছে। এবার যন্ত্রপাতিগুলোও দিয়ে দেবে ওকে। কী আর হবে এসব
নিয়ে তপা মাস্টারের?
তাপস ঠিক করেই নিয়েছে এই জীবন আর না। এবার সৎপথে বাঁচতে
হবে। তাহেরপুরে থাকে পরিমল। সেও আগে পকেটমারি করত টুকটাক। ধরা পড়ে বেদম মার খেয়েছে
একবার। থানার বড়বাবু ছিল ভালো মানুষ। দিন তিনেক লক-আপে রেখে তাকে ছেড়ে দেন। তার
আগে কাগজে সইসাবুদ করিয়ে নিয়েছেন আর
কোনোদিন এই পথে যাবে না। শুধু কি তাই ? বড়বাবু কোথা থেকে
বেশকিছু টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন ছোটোখাটো ব্যবসা করার জন্য। পরি কথা রেখেছে। এখন
একটা চায়ের দোকান দিয়েছে স্টেশন বাজারে। অবশ্য বড়বাবুর উদ্যোগ ছিল এর পেছনে। সেই
পরিকে দেখেই তপার সৎভাবে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছে।
পরি বাংলাদেশে কাপড়ের দোকানে চুরি করে পালিয়ে এসেছিল
বর্ডার পেরিয়ে। নানা জায়গা ঘুরে এসে পড়ল মদনপুরে। সেখানে ছোটোখাটো চুরিটুরি করে
চলত। সেই সূত্রেই আলাপ পরির সঙ্গে। তখন থেকেই দুজন দুজনকে সুমুন্দি হিসাবে পরিচয়
দেয়। পরিমলকে তাপস পরি ডাকে। আর তাপস পরির ডাকে হয়ে গেলো তপা মাস্টার। তাপসের এই
ডাকটা পছন্দ বলে কাউকে নিজের পরিচয় দেয় তপা মাস্টার বলেই। পরি শেষে ট্রেনে বা
বাজারে পকেটমারিতে ঢুকে গেল। আর নিজের উদ্ভাবনীশক্তি দিয়ে দোকানের বন্ধ তালা খুলে
টাকাপয়সা লুঠের দিক বেছে নিল তাপস। তবে যোগাযোগটা থেকেই গেল।
একদিন সুমুন্দিকে গিয়ে নিজের মনের কথা বলল তাপস। বুঝলি পরি, তোর তো দোকান ভালোই চলে দেখি। তা আমারেও একটা জায়গা দেখি দে দিনি। আমিও
এট্টা ব্যবসা ফাঁদি।
~ কও কি মাস্টার ? তোমার ইনকাম কি
কম নিকি? ব্যবসা করবার মন চায় ক্যান হঠাৎ?
~ না রে পরি। ছোট্টুটা মরি যাওনের পর থিকাই ভাবতাছি আর এ
পথে যামু না।
~ কও কি? ছোট্টু মরি গেছে?
~ হ ভাই। মাইর্যা ফালাইছে পিটাইয়া।
~ অ্যাঁ ! কেডায় মারল?
তাপস সবিস্তারে জানায় ছোট্টুর গণপিটুনির কাহিনী। প্রথম
প্রথম বাজারের দোকানের গেট বা সাটারের তালা কৌশলে ভেঙে তারপর যা টাকাপয়সা পেত সব
লুঠ করত তাপস। ছোট্টু ছিল বাপ-মা খেদানো এক ছেলে। পথে পথে ঘুরে বেড়াত আর নানা
দোকানের ফাইফরমাশ খাটত। ওকে দেখেই মাথায় খেলে গেল আইডিয়া। দোকানের টাকাপয়সার হদিশ
দিতে পারবে ছেলেটা। একদিন পাকড়াও করে অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে লোভ দেখিয়ে নিজের দলে টেনে
নিল তাপস। দল বলতে সে একাই। এসব ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। এক থেকে
এবার দুজন হল। মাসখানেক আগে এক সোনার দোনাকে চুরি করতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। কীভাবে
যেন টের পেয়ে গেলো কোনো অফিস বা এটিএমের সিকিউরিটি। সে ঘটনা আঁচ করেই চিৎকার করে
উঠল আর বাঁশি বাজাল। বাঁশির শব্দে আশেপাশের কিছু লোকজন ছুটে এলো। সিকিউরিটি তাপসকে
জাপটে ধরে ফেলেছিল। তাপস তাড়াতাড়ি জামার বোতাম পটাপট খুলে প্যান্টের পকেট থেকে
ধুলো মুঠোয় নিয়ে ছুঁড়ে মারল সিকিউরিটির চোখে। তারপর জোর ঝটকায় ছিটকে পড়ল মাটিতে।
উঠেই দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সিকিউরিটির হাতে থেকে গেলো তার জামা। ওদিকে তালা ভেঙে
ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল ছোট্টু।সে বাইরের এত কাণ্ড বোধহয় টেরই পায়নি। দৌড়তে
দৌড়তে হইহই চিৎকারে বুঝে গেল ছোট্টু ধরা পড়ে গেছে।
পরদিন একটু বেলায় ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে, মুখে দাঁড়িগোঁফ লাগিয়ে এলাকায় এসে ছোট্টুর অবস্থা বুঝতে চেয়েছিল। শুনল
মারের চোটে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। তারপর পুলিশ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় ছেলেটা।
নিজের উপরই খুব রাগ হল তাপসের। যাকে জোর করে টেনে আনল এই পথে, তাকে বাঁচাতে পারল না! এই ঘটনার পর আর-একবার অবশ্য একটা বড় মুদি দোকানের
তালা ভেঙেছিলে তাপস। সেটা ছিল বড়সড় অপারেশন।
কিন্তু সেটাই শেষ। আর ও পথ মাড়ায়নি।
এইরকমই এক মধ্যরাতে দোকান লুঠ করে পালানোর সময় দেখে ফেলে
মতি। তারই ছোট্ট হোটেলের কাছের দোকান ছিল সেটা। এই প্রথম নিজের এলাকার দোকানের
সাটারের তালা ভেঙেছিল তপা। মতিকে সে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
মতিও কথা রেখেছে। কোনোদিন মুখ খোলেনি কোথাও। মতির গল্প পরি আগেও শুনেছে।
সব শুনে আফসোস করল পরি। তারপর নানা কথার ফাঁকে জানাল
স্টেশনের পাশেই একটা জায়গা ঠিক করে দিতে পারে সে। তবে অনেক টাকা দিতি হবে পার্টি
অফিসে।
~ কত টাকা?
~ তা পেরায় ধরো হাজার কুড়ি টাকা।
~ সে দেওয়া যাবে'খন। তুই কথা ক'
ইউনিয়ানের লগে।
~ পাট্টির লগে কালই কতা কয়ে নেবো। তাপ্পর ধরো গিয়া দোকান
দিতি হবে। জিনিসপত্র কিনতি হবে। ম্যালা টাকার মামলা। এত টাকা তুমি পাবা কোতায়?
~ সে সব ব্যবস্থা হইব রে পাগলা। ঠাকুরের ইচ্ছায় কিছু
টাকা জমাইতে পারছি। তুই জায়গাটা দেখ।
পরি জায়গা দেখল। ঘুগনি পাউরুটি ডিম সেদ্ধর দোকান করতে যা
যা লাগে তারও ব্যবস্থা করল। একজন সাহায্যকারীও ঠিক করে দিল। সব পাকাপাকিও হয়ে গেলো
একদম। এমনকি আপাতত তার বাড়ির বারান্দা ঘিরে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিল পরি।
ঠিক হল মাস দুয়েকের মধ্যে দোকান চালু হলে অন্য জায়গায় ভাড়াতে যাবে তপা। পরির
পোয়াতি বউ। ক'মাস পরে নতুন একজন আসবে সংসারে। বারান্দাটা তার লাগবে।
আগামীকাল থেকেই সেই দোকান খুলতে চায় তাপস। তাই আজই তার
মতির দোকানে শেষ খাওয়া। এর মধ্যে দু-তিনদিন ঘুরেও এসেছে তপা। আজ বিকেলে তাহেরপুরে
পাকাপাকি চলে যাবে সে। দোকানের রঙ করা হয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। ডিম, পাউরুটি সব জোগাড় করে রেখেছে পরি। ঘুগনিটা রান্না করতে হবে ভোরে। মটর
ভেজাতে হবে। দোকানে একটু পুজো দিতে হবে। অন্যান্য দিকও দেখে নিতে হবে।
চৌকির তলা থেকে একটা চামড়ার বাক্স টেনে বের করল তপা
মাস্টার। হাত দিয়ে উপরের ময়লা মুছে খুলল বাক্সটা। কয়েকটা বিভিন্ন মাপের পেরেক, দুটো স্ক্রু ডাইভার, সরু মোটা তার, ভাঙা ব্লেড, স্টিলের একটা ছোটো হাতুড়ি, আর-একটা কাঠের হাতল লাগানো বড় হাতুড়ি, টুকরো দড়ি,
কামারশালা থেকে বানানো লোহার বাঁকানো পাত ইত্যাদি নানা যন্ত্রপাতিতে
একটা একটা করে পরম মমতায় হাত বোলায় তপা। এমন সময় বাইরে থেকে কার জোরালো গলা ভেসে
আসে।
~ তপা মাস্টার আছো নাকি ?
তাড়াতাড়ি বাক্সটা বন্ধ করে আবার চৌকির নীচে চালান করে দেয়।
তার ঘরে আসার মতো লোক তো কেউ নেই ! এক মতি আসে। তাও কালেভদ্রে। কখনো খুব ইচ্ছে
করলে বাংলার বোতল কিনে আনে। সেইসময় মতিকে বলে আসে রুটি তরকা বা মাংস পাঠিয়ে দিতে।
এছাড়া তো কেউ আসে না এখানে ! চুপ করে বোঝার চেষ্টা করে কে এলো। একটু আগেই মতি
বলছিল কেউ কেউ নাকি জানে তার কাজের কথা। সত্যি হতেও পারে। পুলিশের লোক নয়তো? ভাবতে ভাবতেই আবার ডাক, কই হে তপা? সাড়া দিস না ক্যান?
ঘাড় বাড়িয়ে দেখে বিমল মাস্টার। পঞ্চায়েতের মেম্বার আবার
এলাকার প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার। তাই সবাই তাকে বিমল মাস্টার নামে ডাকে। তা সে
এই দুপুরবেলা এসে হাজির কেন? বিপদের আঁচ পায় তপা। চোখ সরু করে
দেখে। এর মধ্যেই বিমল ঘরে ঢুকে পড়ে।
~ একটা জরুরি দরকারে এলাম বুঝলি। তোকেই আমার খুব দরকার।
~ আমারে দরকার আপনার ? কী ব্যাপার
বলেন তো মাস্টারবাবু?
বিমল যে দরকারের কথা বলে তাতে মাথাটা ঘুরে যায় এতদিন এই
লাইনে থাকা তপারও। বিমল প্রাইমারি স্কুল কমিটির সেক্রেটারি। একটু আগে ব্যাঙ্ক থেকে
সরকারি অনুদান হিসাবে দু লাখ টাকা তুলে এনেছে হেড মাস্টার। তাকে আর কমিটির
প্রেসিডেন্টকে সাক্ষী রেখে টাকাটা আলমারির
লকারে রেখেছে। স্কুলের নতুন বিল্ডিং হচ্ছে। কালই বিল্ডার্সকে কিছু টাকা দেবার কথা।
আর বাকি টাকা স্কুলের আলাদা ফান্ডে রাখা হবে। সে নাকি অন্য এক ব্যাঙ্ক। তা তপাকে
আজ রাতেই আলমারি ভেঙে সেই টাকা লুঠ করে এনে দিতে হবে বিমলের হাতে। বিনিময়ে সে পাবে
কুড়ি হাজার টাকা।
~ কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কাছে ক্যান মাস্টারবাবু?
~ তুই পারবি বলেই। আমি সব জানি রে তপা। মতির থেকে পাক্কা
খবর নিয়েই এসেছি।
শুনে থমকে যায় তপা। তার মানে কেউ কেউ জানে বলে মতি যে
ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা ঠিক। ও কথা রাখেনি। অনেককেই হয়তো জানিয়েছে। মনে মনে মতিকে
হারামজাদা বলে স্পষ্ট করে জানায়, আমি এইসব কাজ ছাড়ছি চিরকালের জইন্য।
আপনে অন্য কাউরে ধরেন মাস্টার।
~ আচ্ছা ! খুব তেল বেড়েছে দেখছি। তোর খবর থানায় জানালে
কী হবে জানিস? আমারে চিনিস নাই তপা। আমি হলাম বিমল মাস্টার।
সবাই আমারে ডরায়।
ঝপ করে বিমল মাস্টারের পায়ে পড়ে তপা। আমারে বাঁচান
মাস্টারবাবু। আমি সত্যি কইর্যা কইতাছিএই কাজ ছাড়ছি। আমি অখন ভালো কাম কইর্যা
বাঁচতে চাই।
বিমল কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। বলে দিয়েছে সন্ধ্যার পরে আবার
আসবে। তপা সব দিকই চিন্তা করে দেখেছে। একবার ভেবেছিল কাজটা করে দিলে খারাপ হয় না।
কুড়ি হাজার টাকা কম না ! টাকাটা পেলে ব্যবসাটা আরও ভালোভাবে করতে পারবে। তাছাড়া
পরি তার জন্য এত করল, ওর জন্য একটা জামাপ্যান্টের পিস, ওর বউয়ের জন্য ভালো শাড়িও কিনতে পারবে।
চৌকিতে শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে অবশেষে ঠিক করে, নাহ্ একবার যখন করবে না ঠিক করেছে, আর করবেই না এই
কাজ। একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ভেসে বেড়ায় তার চোখে। একটা ঘর, বউ, সংসার তার সেই স্বপ্নে হানা দেয় বারবার। কিন্তু
বিমল মাস্টারের হাত থেকে আপাতত বাঁচতে হবে।
চৌকির নীচ থেকে বাক্সটা আবার বের করে। তারপর ঝোলানো ফতুয়া
গায়ে চাপিয়ে বাক্সটা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তালাট দুটো কড়া একসাথে করে
ঝুলিয়ে দেয়। চাবি ঝোলে তালার সঙ্গেই। দিনের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এবার
পালাতেই হবে।
পিছু ফিরে একবার তার এতদিনের আস্তানা দেখে নেয়। তারপর
দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে পলাশডাঙার দিকে। কিছুটা যাওয়ার পর ধু ধু মাঠ পায়। সেই মাঠ
ধরে দৌড় শুরু করে। অন্ধকারে বারবার হোঁচট খায়। উঠে আবার দৌড়োয়। কতক্ষণ এই দৌড় চলে
সে নিজেই জানে না। একটা বড় রাস্তা পার করে দেখে রেললাইন। তার পাশ বরাবর জলাজঙ্গল
দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা স্টেশন দেখতে পায়। স্টেশনের নামটা আবছা অন্ধকারে দেখা
যাচ্ছে। কিন্তু তার জানতেই ইচ্ছে করে না কোন স্টেশন। বাক্সটা মাথায় দিয়ে একটা
ফাঁকা বেঞ্চে শুয়ে পড়ে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল দৌড়ে দৌড়ে। তাড়াতাড়ি ঘুমও এসে
পড়ে।
"তপা, আজ রাতেই কাজটা করা চাই। কুড়ি হাজার টাকা নগদ …।" বিমল মাস্টারের গলা শুনে ধড়ফড় করে উঠে দেখে কেউ কোত্থাও নেই।
দুঃস্বপ্ন দেখেছে। বাক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। স্টেশনের নামটা ভালো করে দেখে।
এটা হল্ট স্টেশন। অনেক দূরে চলে এসেছে সে। কিন্তু বিমল মাস্টারকে বিশ্বাস নেই। যদি
ধরা পড়ে যায়। অন্ধকার চিরে আবার দৌড় শুরু করে তপা মাস্টার। আর কতক্ষণ দৌড়োলে সে
নিরাপদ জায়গায় পৌঁছবে নিজেও জানে না। দৌড় চলতেই থাকে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন