শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

ভজন দত্ত


            ।।  পুরুলিয়ার মুখ ।।
প্রথম পর্ব :
                                    
১.
কবি,প্রিয় কবি।'বাংলার মুখ' কবি দেখেছিলেন। তিনি তো কবি, দেখতেই পারেন, অসুবিধে কী! প্রিয় পাঠক, প্লিজ আমাকে এ প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। আমি দুটি হাত তুলে আত্মসমর্পণ করছি। তাতে শান্তি না হলে,করজোড়ে মার্জনা চাইছি,আঞ্চলিক আমি, 'দেখা হয় নাই মুখখানি '।দার্জিলিং এ গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতকে দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি সেই। আবার দীঘা বা সুন্দরবনে গিয়েও তাই মনে হয়েছে।
এবঙ্গের প্রান্তভূমি পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে যখন দেখছিলাম মুখোশ তৈরির 'কারিকুরি ' তখন মনে হলো এই তো সেই। না।আমি বাংলার মুখ খুঁজতে চাই না, বাংলার মুখ মনে করে করে কষ্টার্জিত নিদ্রাকে পরিত্যাগ করতে চাই না।( আজ ১৯/০১/২০১৮এ লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলার মুখ মনে করলেই দেখতে পাচ্ছি সেই বুলেটবিদ্ধ নিষ্পাপ শিশুটিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এলোমেলো হয়ে যায় সব অক্ষর।পাঠক মাফ চাইছি। পারলে অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ উথ্থাপনের জন্য ক্ষমা করবেন।)



আমি পুরুলিয়ার মুখ, হ্যাঁ, মুখ দেখেছিলাম, মুখোশ নয়।পুরুলিয়া জেলার বিখ্যাত পাহাড় অযোধ্যর পাদদেশে, বাঘমুন্ডি ব্লকের গ্রাম চড়িদা-য়।পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে তৈরি 'ছো নাচ' এর মুখোশ আজ যথার্থই তা পুরুলিয়ার মুখ হয়ে উঠেছে। তা কি, বাংলার মুখ নয়? কবি কি দেখেছিলেন কোনোদিন, কোনোদিন কি এ অহল্যাভূমি তাঁর পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল?
বাংলার মুখের একদিকে আমি দেখতে পাই পুরুলিয়ার মুখ আঁকা আরেকদিকে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ায় তৈরি পোড়ামাটির ঘোড়া।
২.
গ্রামের নামটি কেউ বলেন চড়িদা, কেউ বা বলেন চোড়দা। তা নামে কি এসে যায় তো পুরনো কথা। বাঘমুন্ডির রাজবাড়ি থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে একবর্গ কিমি জুড়ে একটি গ্রামকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন ছো নাচের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া। তিনি বলেছেন, মুখোশ না থাকলে  তাঁদের নাচ এত বর্ণময় হয়ে উঠত না।এই গ্রামের সূত্রধর  সম্প্রদায় মুখোশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত।
গ্রামটি দুদিকে পাহাড় ও অরণ্য দিয়ে ঘেরা।রসহীন পাথুরে জমিতে সামান্য  কিছু চাষযোগ্য জমি।আকাশের বৃষ্টিতে পাথর না নড়লে চাষাবাদ করা যায় না সেসব জমিতে।এরমধ্যেই তাঁরা বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নিয়েছিলেন।
তরুনদেব ভট্টাচার্য তাঁর 'পুরুলিয়া' গ্রন্থটিতে লিখেছেন।চড়িদা গ্রামের সূত্রধরগণ এসেছিলেন বর্দ্ধমান জেলা থেকে। ভাদু সহ অন্যান্য দেবদেবীদের মূর্তি গড়ে দেওয়ার শর্তে বাগমুন্ডির রাজা তাঁদের  জমি দিয়ে এখানে এনে বসিয়েছিলেন। সেসব মূর্তি তৈরি হত মাটি দিয়ে।
চল্লিশ - পঞ্চাশ বছর আগে ছো নাচের মুখোশ তো সারাবছর বিক্রি হত না।তাই জীবিকার প্রয়োজনে তাঁরা একসময় পালকি, কারুকার্য়সহ কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি করতেন। প্রতিমা তৈরির সময়ে অনেকে দূর দূর জায়গায় গিয়ে প্রতিমা তৈরি করার কাজেও যুক্ত হতেন। এখনো তাঁরা যান বিভিন্ন জায়গায়।
৩.
উপকরণ:
এখানে যে মুখোশগুলি তৈরি হয় তার প্রধান উপকরণ হল, এ্যাঁটেল মাটি,পুরাতন খবরের কাগজ,ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, ময়দা,আঠা, তেঁতুলের বীজ দিয়ে একরকম আঠা,মুখোশগুলি পালিশ করার জন্য গর্জন তেল, ধুনো,নকল চুল,পাখির পালক,পাট, নানা রকমের পুঁতি, রাংতা, শালমা, বিভিন্ন রঙের ও সাইজের চুমকি ও সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি।
পদ্ধতি :
প্রথমে ছাঁচে ফেলে তাঁরা মূর্তিগুলির মুখমন্ডল তৈরি করেন। কিছুটা শুকনো হলে তার উপর ছাইয়ের গুড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওঁদের কথায় 'ছাঁচা' তৈরি।
এরপর তাঁরা পাতলা আঠার মধ্যে মাপমতন কাগজ ভিজিয়ে ঐ ছাঁচার ভেতরের দিকে আটকে দেওয়া হয়।এভাবে ৭- ১০ বার করার পর, আঠায় ভেজানো কাপড় ও কাগজ দিয়ে তা আরো মজবুত করা হয়। শক্তপোক্ত করা না হলে মুখোশগুলি পরে ছো নাচের মত বীরত্বপূর্ণ নৃত্য প্রদর্শন করা যায় না।
তৃতীয় ধাপে চলতে থাকে চরিত্রানুযায়ী মুখোশগুলির রূপদান। নির্মিত ঐ ছাঁচাটির ওপর মাটি দিয়ে নাক,চোখ,মুখ,ঠৌঁট,থুতনি,কান সব করা হয়। এরপর গোলা কাদামাটির মন্ডে পাতলা মিহি কাপড়ের টুকরো দিয়ে ওই ছাঁচাটির ওপরে টানটান করে আটকানো হয়। এই প্রক্রিয়াকে ওরা বলেন 'কাবিজ লেপা '।
পরের ধাপে শিল্পীরা তাঁদের দক্ষ হাতে সেগুলিকে পালিশ করেন কাঠের তৈরি এক কর্ণিক দিয়ে।একে ওরা বলেন 'থাপি' বা 'থুপি'। পালিশের পর রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পালা শুরু।আধশুকনো হলেই ওই ছাঁচা থেকে কাগজ ও কাপড়ের আবরণ খুলে ফেলা হয়।বাড়তি কিছু থাকলে তা কাটছাঁট করে সেই অবয়বটিকে নিঁখুত করে তৈরি করার চেষ্টা হয়।
এর পর ঐ অবয়বে চোখ ও নাকের জায়গায় ফুটো করা হয়। ছো নাচের শিল্পীরা যাতে মুখোশগুলি পরে দেখতে পান ও শ্বাসপ্রশ্বাস কাজ চালাতে পারেন সেদিকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখেন তাঁরা।
এভাবে মুখোশের কাঠামো তৈরির কাজ শেষ হলে শুরু সেই মুখোশগুলিতে চরিত্রানুযায়ী রঙ করার কাজ শুরু হয় প্রতিমা তৈরির মতো। গর্জনতেল লাগানো হলে এই পর্যায় শেষ হয়।
সেগুলিকে চুল,চুমকি,শলমা,রাংতা,পুঁতি, পালক ইত্যাদি যা দরকার তাই দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়।
মুখোশশিল্পীরা রামায়ণ, মহাভারত,পুরাণ বর্ণিত রূপ অনুযায়ী সেগুলিকে সজ্জিত করে থাকেন।
মুখোশ নির্মানের ক্ষেত্রে চড়িদা প্রাচীন ঐতিহ্যধারাকে অনুসরণ করে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
(পরের সংখ্যায় সমাপ্ত হবে) 


আলোকচিত্র : উজ্জ্বল দাস। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন