বুদ্ধিজীবী
-------------------
'বুদ্ধিজীবী' কথাটা নিজের ক্ষেত্রে ভারি বকোয়াস আর বাওয়া মনে করি। এমনিতেও শব্দটা যদৃচ্ছ ইস্তেমালের ফলে ঘষা আধুলি হয়ে গেছে, বাজারে ক্রেডিবিলিটি খুইয়েছে। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, বাঙালি লেখকরা কি প্রকৃতই বুদ্ধিজীবী? না না, ভুল বললাম। প্রশ্নটা হল, আমাদের ভাষায় যথার্থ বুদ্ধিজীবী-লেখক আছেন কি? এদেশে দর্শনের অধ্যাপক মাত্রেই 'দার্শনিক', বিজ্ঞানের গবেষক মানেই 'বৈজ্ঞানিক'। আর, যে-কোনও কলমচি মাত্রেই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু সেই কলমের সঙ্গে যে প্রতিভা, বোধ, বোধি, প্রজ্ঞা, মেধা, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা, অন্তর্দৃষ্টি আর সৃজনশীলতার কিঞ্চিৎ রসায়ন থাকা বাঞ্ছণীয় সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।
'বুদ্ধিজীবী' লুগাতটা যদিও ইংরেজি intellectual শব্দের বাংলার্থে ইস্তেমাল হয়ে আসছে ঢের দিন থেকে, কিন্তু মোদ্দায় এটি তার যথাযথ সংজ্ঞার্থ নয়। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত ইন্টেলেকচুয়াল-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিশেবে ' বিজ্ঞজন' ও 'প্রাজ্ঞ' শব্দ দুটির তরফদারি করবেন। কিন্তু স্যার, ভেবে দেখুন, intellection নামক মনন ক্রিয়াটিতে বুদ্ধিরই প্রাথম্য বিদ্যমান। বিদ্যাচর্চা যদিও এর আবশ্যিক অঙ্গ, তথাপি ভিত্তি নয়। প্রজ্ঞা অবশ্যই লভ্য। তবে একজন ইন্টেলেকচুয়াল সঠিক অর্থে savant বা sage না-ও হতে পারেন। সেজন্যই বলছি, বুদ্ধিজীবীর বঙ্গীয় অর্থে বিজ্ঞজন বা প্রাজ্ঞ প্রযোজ্য নয়।
উনিশ শতকের পরিশিষ্টে একটি উক্তি নিয়ে বঙ্কিম আর রবিবাবুর মধ্যে তুমুল কাজিয়া বেধেছিল, যা ছিল বাস্তবত ইন্টেলিজেশিয়া ও বুদ্ধিবাদের যোধন। বঙ্কিমবাবু মহাভারতের দোহাই পেড়ে বলেছিলেন, 'প্রাণরক্ষার্থে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ অপরাধ নহে।' রবিবাবু লাইক দিয়ে কমেন্ট করলেন, 'মিথ্যার বিনিময়ে জীবন রক্ষা পাইলেও তাহাতে সত্যরক্ষা হয় না।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনের সন্ধিক্ষণে নিশ্চয়ন্তিকা বুদ্ধি দিয়ে সত্যকে পরখ করতে চেয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাটের সঙ্গে ওই বিতর্কে।
বস্তুত, ইন্টেলিজেন্সিয়া শ্রেণীর মধ্যে তাঁরাই পড়েন যাঁদের কাজ হাতে নয়, মাথা দিয়ে। যদিও বিগত শতকে এঁরাই ছিলেন বাংলা রেঁনেশসের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী, কিন্তু বর্তমানে মার্কসীয় রাজনৈতিক চেতনায় শব্দটি ঘৃণিত। এঁরা নীতিগতভাবে বিপ্লব ও প্রগতিকে স্বীকার করলেও কার্যত প্রাচীন রক্ষণশীল চেতনাকে আঁকড়ে ধরে প্রগতিকেই বানচাল করে দেন। তাই ভারতের নিজভূমিতে কোনো রেঁনেশস হয়নি।
এই ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবীদেরই এখন এদেশে বাড়বাড়ন্ত। আজকের 'সফল' কবি-লেখক বলতে এঁরাই। এঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরিজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির জলবাতাসে। এঁরাই আপনার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শিল্প-সাহিত্যের ধারক ও বাহক বেশে। এঁদেরি হাতে গোড়াপত্তন ঘটেছিল মনোপলি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান আর সাহিত্যের ব্যবসা। এঁরা সাধারণ পাঠককে একটা নির্দিষ্ট ভাবনাচক্রে (পড়ুন, ঘোরচক্রে) ঘুরপাক খেতে বাধ্য করেছেন। গভীর কিছু ভাবা থেকে তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন আর নিজেদের মুনাফার জন্যে একের পর এক সস্তা, গণতোষণকারী ফ্যাদানো গল্প-উপন্যাস সাপ্লাই দিয়ে এসেছেন। এঁরাই আপনাদের 'মূল'-ধারার 'জনপ্রিয়' লেখক। আজ যে ত্রিশূলে কন্ডম পুঁতে দিল বলে এত হা-হুতাশ, এবং তার সপক্ষে এমন ফেসবুকিয়া একজোট, এসবই আমরা করছি একটি বেনিয়া কালচারকে গ্লোরিফাই করে তুলতে। এতে বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির নতুন কোনো উন্মেষ ঘটবে না।
-------------------
'বুদ্ধিজীবী' কথাটা নিজের ক্ষেত্রে ভারি বকোয়াস আর বাওয়া মনে করি। এমনিতেও শব্দটা যদৃচ্ছ ইস্তেমালের ফলে ঘষা আধুলি হয়ে গেছে, বাজারে ক্রেডিবিলিটি খুইয়েছে। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, বাঙালি লেখকরা কি প্রকৃতই বুদ্ধিজীবী? না না, ভুল বললাম। প্রশ্নটা হল, আমাদের ভাষায় যথার্থ বুদ্ধিজীবী-লেখক আছেন কি? এদেশে দর্শনের অধ্যাপক মাত্রেই 'দার্শনিক', বিজ্ঞানের গবেষক মানেই 'বৈজ্ঞানিক'। আর, যে-কোনও কলমচি মাত্রেই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু সেই কলমের সঙ্গে যে প্রতিভা, বোধ, বোধি, প্রজ্ঞা, মেধা, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা, অন্তর্দৃষ্টি আর সৃজনশীলতার কিঞ্চিৎ রসায়ন থাকা বাঞ্ছণীয় সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।
'বুদ্ধিজীবী' লুগাতটা যদিও ইংরেজি intellectual শব্দের বাংলার্থে ইস্তেমাল হয়ে আসছে ঢের দিন থেকে, কিন্তু মোদ্দায় এটি তার যথাযথ সংজ্ঞার্থ নয়। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত ইন্টেলেকচুয়াল-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিশেবে ' বিজ্ঞজন' ও 'প্রাজ্ঞ' শব্দ দুটির তরফদারি করবেন। কিন্তু স্যার, ভেবে দেখুন, intellection নামক মনন ক্রিয়াটিতে বুদ্ধিরই প্রাথম্য বিদ্যমান। বিদ্যাচর্চা যদিও এর আবশ্যিক অঙ্গ, তথাপি ভিত্তি নয়। প্রজ্ঞা অবশ্যই লভ্য। তবে একজন ইন্টেলেকচুয়াল সঠিক অর্থে savant বা sage না-ও হতে পারেন। সেজন্যই বলছি, বুদ্ধিজীবীর বঙ্গীয় অর্থে বিজ্ঞজন বা প্রাজ্ঞ প্রযোজ্য নয়।
উনিশ শতকের পরিশিষ্টে একটি উক্তি নিয়ে বঙ্কিম আর রবিবাবুর মধ্যে তুমুল কাজিয়া বেধেছিল, যা ছিল বাস্তবত ইন্টেলিজেশিয়া ও বুদ্ধিবাদের যোধন। বঙ্কিমবাবু মহাভারতের দোহাই পেড়ে বলেছিলেন, 'প্রাণরক্ষার্থে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ অপরাধ নহে।' রবিবাবু লাইক দিয়ে কমেন্ট করলেন, 'মিথ্যার বিনিময়ে জীবন রক্ষা পাইলেও তাহাতে সত্যরক্ষা হয় না।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনের সন্ধিক্ষণে নিশ্চয়ন্তিকা বুদ্ধি দিয়ে সত্যকে পরখ করতে চেয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাটের সঙ্গে ওই বিতর্কে।
বস্তুত, ইন্টেলিজেন্সিয়া শ্রেণীর মধ্যে তাঁরাই পড়েন যাঁদের কাজ হাতে নয়, মাথা দিয়ে। যদিও বিগত শতকে এঁরাই ছিলেন বাংলা রেঁনেশসের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী, কিন্তু বর্তমানে মার্কসীয় রাজনৈতিক চেতনায় শব্দটি ঘৃণিত। এঁরা নীতিগতভাবে বিপ্লব ও প্রগতিকে স্বীকার করলেও কার্যত প্রাচীন রক্ষণশীল চেতনাকে আঁকড়ে ধরে প্রগতিকেই বানচাল করে দেন। তাই ভারতের নিজভূমিতে কোনো রেঁনেশস হয়নি।
এই ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবীদেরই এখন এদেশে বাড়বাড়ন্ত। আজকের 'সফল' কবি-লেখক বলতে এঁরাই। এঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরিজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির জলবাতাসে। এঁরাই আপনার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শিল্প-সাহিত্যের ধারক ও বাহক বেশে। এঁদেরি হাতে গোড়াপত্তন ঘটেছিল মনোপলি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান আর সাহিত্যের ব্যবসা। এঁরা সাধারণ পাঠককে একটা নির্দিষ্ট ভাবনাচক্রে (পড়ুন, ঘোরচক্রে) ঘুরপাক খেতে বাধ্য করেছেন। গভীর কিছু ভাবা থেকে তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন আর নিজেদের মুনাফার জন্যে একের পর এক সস্তা, গণতোষণকারী ফ্যাদানো গল্প-উপন্যাস সাপ্লাই দিয়ে এসেছেন। এঁরাই আপনাদের 'মূল'-ধারার 'জনপ্রিয়' লেখক। আজ যে ত্রিশূলে কন্ডম পুঁতে দিল বলে এত হা-হুতাশ, এবং তার সপক্ষে এমন ফেসবুকিয়া একজোট, এসবই আমরা করছি একটি বেনিয়া কালচারকে গ্লোরিফাই করে তুলতে। এতে বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির নতুন কোনো উন্মেষ ঘটবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন