শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সুধাংশু চক্রবর্তী

                                   



।। গুষ্টির পিণ্ডি ।।




দুর্গাপুজো যত এগিয়ে আসছেসংসারের আকাশে ততই ঘনিয়ে উঠছে ঘন কালো মেঘ । অর্ধেন্দু ভয় ভয় আছেন এই বুঝি বজ্রপাত শুরু হলো । এবছর পুজোর কেনাকাটা যত না হলো তারচেয়ে বেশী হলো তাঁর স্ত্রী সোমদত্তার মুখচোপাএটা নিয়ে এলে কেন ? এই বয়সে আমাকে কি এই রঙ মানায় কখনো ? কিম্বাবোনাসের টাকাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছো কার শ্রাদ্ধের জন্যে শুনি ? ছেলেটার মুখ চেয়ে পুজোর বাজেট আর একটু বাড়াতে পারলে না ? এমন বদখৎ একটা সস্তার পোষাক নিয়ে এলে ওর জন্যে ? 


এমন সব বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হতেই এক সকালে সোমদত্তার আবদার কানে এলো অর্ধেন্দুরএই শুনছোপুজোর আর মাত্র দশ দিন বাকী আছে । আমি ভেবে রেখেছি পুজোর সাতদিন আগেই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাবো । আমাদের পৌঁছে দিয়ে এসো কিন্তু ।


একে লাগাতার বাক্যবাণে ক্রমাগত বিদ্ধ হতে হতে জেরবার হয়েই ছিলেন অর্ধেন্দু । এর ওপর এমন একটা আবদার শুনে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে স্ত্রীর মুখের ওপর বলে বসলেনহবে-এ-এ না-আ-আ-আ…

হবে না মানে ? হতেই হবে-এ-এ-এ…। সোমদত্তাও সমান তালে জবাব দিলেন 

বললাম তো হবে না । যেতে হলে দশমীর পর গিয়ে প্রণাম ঠুকে এসো গুরুজনদের পায়ে । অর্ধেন্দু  কড়া গলায় জবাব দিলেন ।


বাপের বাড়ি যাওয়া হবে না শুনে সোমদত্তা তখুনি গিয়ে ঢুকলেন গোসাঘরে । স্ত্রীকে গোসাঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হতে দেখে অর্ধেন্দু মুখ কাঁচুমাচু করে শুধোলেনআজ কি রান্নারের চুলোয়...

আর গুষ্টির পিণ্ডি চাপবে না । কথাটা এমন গলায় সম্পূর্ণ করলেন সোমদত্তা যেতার ঝাঁঝে অর্ধেন্দু যেন ঝলসে গেলেন 

ঝলসে যেতে যেতেও ভয়ে ভয়ে শুধোলেন, তবে আমি আর বাবুলাই কি আজ না খেয়ে...


তাঁর কথার মাখখানেই সোমদত্তা আবার ঝংকার দিয়ে উঠলেন, বাপ-ব্যাটা মিলে পিণ্ডি গিলতে হলে নিজেই গতর খাটাও না কেন ? কে মানা করেছে তোমাকে ?     


অর্ধেন্দু বুঝলেন এইমুহূর্তে স্ত্রীর মান ভঞ্জন করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি । সেই ভেবেই মমতাভরা গলায় বললেনআমি নিজেদের কথা ভাবছি না সোনা । ভাবছি তোমারই কথা । এক বেলা না খেলে তোমার ওই দশাসই চেহারা যে চুপসে অর্ধেক হয়ে যাবে মনা 

এ্যাঁই চোপ্‌ । আমার গতর নিয়ে খোটা দেওয়া হচ্ছে ? নিজে গতর খাটাতে পারো তো ভালো, নইলে বাপ-ব্যাটা মিলে গোটা দিন হরিমটর করে থাকো । গোসাঘরের বন্ধ দরজার ভেদ করে ভেসে এলো সোমদত্তার কড়া জবাব 


অর্ধেন্দু মিনমিনে গলায় অনুনয়ের সুরে বললেনহরিমটরটা কোন কৌটোয় রেখেছো সেটা অন্তত বলে দাও আমাকে ।  


সোমদত্তা নিরুত্তর থাকে । গোসাঘরের দরজা ভেদ করে কোনো শব্দই আর বেরোচ্ছে না দেখে অর্ধেন্দু একপ্রকার নিরুপায় হয়েই গিয়ে ঢুকলেন রান্নাঘরে । এরপরই গোসাঘরে বসে সোমদত্তা মাঝেমাঝে চমকে উঠছে অর্ধেন্দু গলায় আর্কিমিডিসের উল্লাস শুনেএই তো পেয়েছি চাল ! ওই তো বঁটি ! আরে বাহ্‌, আনাজপাতি বেড়ে কেটেছিস রে অর্ধেন্দু ইকি রে বাবামাছের টুকরোগুলো এমন গলাগলি জুড়ে দিয়েছে যেন নদের নিমাই হয়ে...


সোমদত্তা তবু অনড় রইলেন । সহসা কানে এলো বছর সাতেকের ছেলে বুবলাইয়ের প্রবল উৎসাহ ভরা গলাচালিয়ে যাও বাবাচালিয়ে খেলো তুমি । ছক্কা মেরে মাকে উড়িয়ে দাও একেবারে বাউন্ডারির বাইরে । আমি আজ তোমার হাতেই পিন্ডি খাবো ।


শুনে সোমদত্তার বুক কেঁপে উঠলো অজানা আশঙ্কায় । ঈশ্বরকে ডেকে মনেমনে বললেনহে ঈশ্বররক্ষা করো । অবোধ ছেলেটার কথা কানে নিও না প্রভু । 


এরপর ছেলের উৎসাহ ভরা গলা যখন ভেসে এলো ডাইনিং টেবিলের দিক থেকেসোমদত্তাকে তখন বাধ্য হয়ে বেরোতেই হলো গোসাঘর থেকে । বেরিয়ে এসে দেখেঅর্ধেন্দু মহানন্দে খাদ্য তুলে দিচ্ছেন ছেলের থালায় । গলা ভাতের দলাদলা পাকানো পোড়া মাছের টুকরো...


ওই খাবারে বুবলাই হাত দিতে যেতেই সোমদত্তা ছুটে গিয়ে খাবারের থালাটা এক টানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁঝের গলায় অর্ধেন্দুকে বললেন, এই পিণ্ডি তুমি নিজে গেলো ক্ষতি নেইতাবলে ছেলেটাকেও গেলাতে হবে ? 


অর্ধেন্দু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেনবুবলাই তার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর মায়ের ওপরআমি বাবার হাতের পিণ্ডি খাবোই খাবো । কেন ফেলে দিলে তুমি ?


শুনেই ছেলের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে সোমদত্তা বললেনবাঁদর ছেলে । গেলাচ্ছি তোকে পিণ্ডি । কোথায় তুই পিণ্ডি গেলাবি তোর বাপকুলের চোদ্দ পুরুষকে, তা নয় নিজেই পিণ্ডি গিলতে বসেছিস তোর বাপের হাত থেকে ওঠ বলছি । নইলে বাপ-ব্যাটা দু'জনকেই আজ... 


বুবলাই
 সভয়ে দেখেআরও একটা চড় নামবো নামবো করছে ওর নরম গালের ওপর । 

চিত্রঋণ - ঈষা চৌধুরী


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন