শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮

রিয়া চক্রবর্তী

মেঘ বালিকা ও আমি


“মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যাকুল হলে তিস্তা।।“

আজ সাতসকালেই ঘুম ভেঙে দেখি আকাশের মুখভার, নীল আকাশ জুড়ে মেঘেদের আনাগোনা। বৃষ্টি নামবে কিছু পরেই। আর ওই গানটা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো। আমার এই এক চিলতে ঘরে দেওয়ালের থেকে জানালাই বেশী। বিছানার পাশের জানালাটা খুলে আনমনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম মেঘেদের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম ওরা আমায় ডাকছে, ওদের সাথে ভেসে বেড়াবার জন্য। অবাক হয়ে ভাবলাম এই যে প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি “মেঘ”, আজ না হয় সব কাজ ফেলে মেঘেদের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবো। ফিরব না আজ কারো ডাকেই। তাই বলে এখন নেফোলজি নিয়ে পড়াশুনোর কোন ইচ্ছেই নেই আমার। তবে এটাও ঠিক যে এই মেঘ কিন্তু মেঘ বিজ্ঞানীদের থেকে কবি, সাহিত্যিকদের মনে প্রভাব ফেলেছে অনেক বেশী। তাই তো তাঁদের লেখায় আদুরে মেঘ বার বার ঘুরে ফিরে আসে।

“দূরে থাকা মেঘ তুই দূরে দূরে থাক
যতটুকু পারা যায় সামলিয়ে রাখ “

মেঘ হল বাস্তব প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। পৃথিবীর সদাচলমান ‘জলচক্র’-র ফলে সৃষ্টি হয় মেঘের। তবে মেঘ বিজ্ঞানীরা কিন্তু এক একটা মেঘের বেশ সুন্দর গালভরা নাম দিয়েছেন। তারা আবার মেঘেদের দুটি বড় শ্রেণীতে ভাগ করেছেন: ১/ স্তরীভূত ও ২/ পরিচলনশীল।

এই নামগুলো মেঘের আচরণ আলাদা করে। মেঘকে তার উচ্চতা দিয়ে শ্রেণীবিভক্ত করেছেন, চূড়ার উচ্চতা দিয়ে নয়, পাদদেশের উচ্চতা দিয়ে। যেমন খুব উঁচু মেঘদের তিনটে ডাকনাম আছে-
১. সিরোকিঊমুলাস
২. সিরাস মেঘ
৩. সিরোস্ট্রাটাস।
মাঝামাঝি উঁচু মেঘেদের নাম হলঃ
১. অলটোস্ট্রাটাস আর ২. অলটোকিঊমুলাস। আবার নিছু মেঘেদের বলা হয়, ১. কিউমুলাস ২. স্ট্রাটোকিউমুলাস ৩. নিম্বোস্ট্রাটাস ৪. স্ট্রাটাস। আরও অবাক করা ঘটনা হল এই স্ট্রাটাস যখন মাটির খুব কাছে এসে মাটির কানে কানে কথা বলে ঠিক তখনই আমরা তাকে কুয়াশা বলি। আমার আরও এক ধরনের মেঘ আছে তাদের ঊলম্ব মেঘ বলি আমরা। যে মেঘ মাঝে মাঝেই ভেঙে গিয়ে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করে। তাদের সুন্দর সুন্দর নাম আছে, ১. কিঊমুলোনিম্বাস ২. কিউমুলাস ৩. পাইরোকিউমুলাস। এই মেঘ শক্তিশালী, আর অনেক ওপরে উঠে যেতে পারে এবং বহু উপরে উঠে নানা রকম আকৃতি তৈরি করতে পারে।

“রাধার কি হৈল অন্তরের ব্যাথা।
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে না শুনে কাহারো কথা।।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে না চলে নয়ান-তারা।
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে যেমত যোগিনী-পারা।।
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি দেখায়ে খসায়ে চুলি।
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে কি কহে দুহাত তুলি।।”

মনে পড়ে যায় বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী শ্রীরাধিকা মেঘের শ্যামল রূপ দেখে আকৃষ্ট হওয়ার সেই অপরূপ বর্ণনা। যেখানে রাধা ঘন কালো মেঘকে তাঁর প্রেমিক রূপে দেখছেন। সেখানে তিনি কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে দু হাত তুলে প্রেম লীলা করছেন।

আবাত শরৎ কালে প্রকৃতিও সাজিয়ে তোলেন নিজেকে। মনে পড়ে যায় সেই ছোটবেলায় (এখনও) কখনও জানলায় দাঁড়িয়ে আবার কখনও একলা ছাঁদে নীল আকাশের দিকে তাকালেই চোখে পড়তো সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। কখনও খরগোশ, কখনও হরিন, কখনও আবার সাদা ভাল্লুক হয়ে ধরা দিতো আমার চোখে। কোন কোন পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না মাখা ছাঁদে যখন একলা ঘুরে বেড়াতাম, জ্যোৎস্না মেখে নিতাম সারা গায়ে, ঠিক সেই সময়ে জ্যোৎস্নার আকাশে রুপোলী মেঘেদের মাঝে সে উঁকি দিয়ে ডাকতো। যখন তাকে খুঁজে পাতাম মেঘ রাজ্যের মাঝে, ঠিক তখনই সে খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠত

“ আমিই তো সেই মেঘ বালিকা”

মনে পড়ে যায়, ছোটোবেলায় পরীক্ষার আগে যখন প্রাণপণ পড়ছি, ঠিক তখনই পড়ন্ত সূর্যের গোধূলি আলোতে আমার ঘর ভরে যেত, আলপনা এঁকে যেত সোনালি বিকেল আমার পড়ার টেবিলে, দেওয়ালে, আমার বইয়ের তাকে। রক্তিম মেঘেদের ফাঁক থেকে দেখতাম আমার প্রিয় মেঘগুলো রঙেরপ্রপাত বেয়ে নেমে আসছে আমার ঘরে। আলপনার আঁকিবুঁকির খেলায় মেতে উঠছে তারা।

“তারপরও ওরে মেঘ দূরে দূরে থাক
ফাগুনের হাওয়া এলে সামলিয়ে রাখ।
শ্রাবনের হাওয়া এলে সামলিয়ে রাখ।
দূরে থাকা মেঘ তুই দূরে দূরে থাক
উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে দূরে দূরে থাক
উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে দূরে দূরে দূরে দূরে।”

মেঘ কি কখনও আমার একার হয় নাকি, মেঘ তো সবার। মেঘ পিওনের ব্যাগের মধ্যে থাকে বৃষ্টির চিঠি। বর্ষায়, শরতে কিম্বা ফাগুনে মেঘ আমাদের কাছে সেই ছোট্ট বালিকার মতো সে যখনই আসে সাথে করে আনে একরাশ ভালোলাগা।

“একটুকরো চেরাপুঞ্জির মেঘ এনে দিতে পারো কি
গোবি সাহারার বুকে?”

মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি, যেখানে মেঘেদের বাস। সারাদিন, সারাবছর ঘন কালো মেঘে মোড়া থাকে। মেঘ মুলুকের দেশ সে যে। কিন্তু ওই গোবি সাহারায় যে মেঘের অন্তহীন অপেক্ষা। তাই তো কবি কিশোরী মেঘকে বলেছেন এক টুকরো মেঘ যেন সেখানেও পাঠিয়ে দেয়। যেখানে কোন এক বাচ্চা মেয়ে হয়তো কল্পনাতেই মেঘের ছবি এঁকেছে, বাস্তবে সে মেঘের দেখা পায় নি কোনোদিন।

“পথ চেয়ে আজও সেই মেয়ে
বুঝি স্বপ্ন জাল বোনে গান গেয়ে”

হয়তো একদিন বিজ্ঞানের সাফল্যের সাথে সাথে সত্যি সত্যিই এক টুকরো মেঘকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে সাহারার খটখটে বুকে। হয়তো সেইদিনও সেই মেয়েটি অপেক্ষা করে থাকবে তার বহু প্রতীক্ষিত কল্পনার মেঘ কে দেখার জন্য। মেঘের সৌন্দর্যকে তখন সে আরও ভালোবেসে ফেলবে। তবে এ তো কল্পনা মাত্র। আজও চেরাপুঞ্জির মেঘ যায় না ভেসে সাহারায়, যেমন আজও ধনী –দরিদ্র, ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণ, হিন্দু- মুসলমানের মিল হয় না, কু সংস্কার মুছে যায় না চিরতরে, দুর্নীতি ছাড়া রাজনীতি হয় না।

ঘুষ ছাড়া সরকার চলে না, ঠিক তেমনই।
“একদিন সবভুল ঠিক হয়ে যাবে
আমাদের কল্পনা বাস্তব হবে”

তবুও আমি স্বপ্ন দেখি, মেঘেদের সাথে ভাসাই আমার কল্পনার ভেলা, রোজ রোজ মনের মাঝে জমে ওঠা হাজারও অভিমান কে খামের মধ্যে পুরে পাঠিয়ে দিই মেঘ পিওনের কাছে। মনখারাপ কাটিয়ে উঠে দেখি আমার প্রিয় বান্ধবী মেঘ সদ্যস্নাত হয়ে নীলাকাশের বুকে এঁকে রেখেছে আমার প্রিয় মুখ, প্রিয় আলপনা। সুন্দর এক দিনের প্রতিবিম্ব রূপে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন