রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

               


ইগনিস



মৃত জল জ্যান্ত শ্যাওলার উপর কী ভাস্কর্যের জন্ম দেয় যারা দেখতে চায়নি, বর্ষা তাদের ঋতু নয়। আঁচে আলস্য সেঁকে নেওয়া টুকু গন্তব্য হলে শীত সব ঠিকানায় আসনপিঁড়ি খোঁজে না। আর কোনো কোনো দিন প্রকৃতির স্নায়ু মদিরাপ্রবণ হলে পৌষালি শিশির যে মেঘে ডুবে যায়, তাকে ভোর রাতে পালাতে গিয়ে পা থেকে খুলে যাওয়া চাঁদের মোজা মেনে নিতে স্বধার সামান্য সংশয়ও আসে না। সে কোনোদিন 'ফেভারিট সিজন' এই প্যারাগ্রাফ লিখতেই পারেনি। শীতের কোনো কোনো অলীক দিনে বৃষ্টি এলে তাকে তো আর 'সিজন' বলা চলে না অথচ ওটাই তার প্রার্থিত। কেজো মানুষদের কাছে খুবই বিরক্তির এই বাক্সের বাইরের আবহাওয়া। নিতান্ত বাধ্য না হলে এই দিনগুলোকে তারা লেপ্রসি পেশেন্টদের মতোই ট্রিট করে সর্বত্র। ফলত নিখাদ বৃটিশ স্থাপত্যের এই কলেজ আজ প্রায় শূন্য। চোখ খুলেই স্বধার মনে হয়েছিলো আজ তার দিন। অন্তরীক্ষে মোহর গাইছেন - "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ"।



অনুপস্থিত ছাত্র ছাত্রীর তালিকায় তিন বছর ধরে স্বধার নাম একদম প্রথমদিকে থেকেছে কারণ প্রথম বছরের প্রথম সপ্তাহে ছয় জন অধ্যাপকের ইন্ট্রোডাক্টরি ক্লাসের রাউন্ড শেষের পর থেকে অর্ক ছাড়া সে আর কাউকে শুনতে চায়নি। ডিরেক্ট এক্সাম দিয়ে সদ্য জয়েন করা, উদ্ধত, ক্লাসে মূল টেক্সটকে প্রায় ঐচ্ছিক বিষয়ের পর্যায়ে ফেলে দেওয়া, শ্যামবর্ণ, গ্রীসিয়ান স্থাপত্যের অর্ক বাগচী যার তিলফুল নাসা থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচের চৌহদ্দিটাকে কক্ষনো বোতামের শাসনে রাখা হতো না। স্বধার একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সেটাই গৌরচন্দ্রিকা - বোধ আর মেধাকে যারা মগজ থেকে রূহ অবধি একটা টানেল তৈরী করে একাকার করে ফেলতে পারে, তাদের শরীরী ভাষা অমোঘ হয়। অনুমানে সে যে ইঙ্গিত জমা করছিলো এগারো থেকে, ঠিক আঠেরো থেকে অর্ককে তিন বছর নেওয়ার পর তাতে সিলমোহর পড়েছিলো। এগারো - তোলপাড়ের - যা দেখছি যা ঘটছে তার অন্তরালে কোথাও অন্য সত্যেরা অপেক্ষায় - "I too am written" - পূর্ব নির্ধারিত যাবতীয় বহতা - রিনরিনে জাগানিয়ার - এগারো। ভেজা থামে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে সে অতীতচারী হয়ে উঠলো (এই তার ব্যাধি যা সে লালন করে যত্নে) । 


সেই বছর নীলে কাশের বেহায়াপনা ছিলো তাকিয়ে দেখার মতো। ছুটি শুরুর প্রথম দিন। কেন প্রতিটা শরৎ এত খা খা করা হতো তার, সে কারণ খুঁজতো। অজস্র জামা হতো জন্ম ইস্তক, কক্ষনো একটাও পরে প্যান্ডেলে যাওয়ার আবহবিকার তৈরীই হয়নি। দুঃখ তার হয় যে প্রাপ্তির ধারণা জানার পর অপ্রাপ্তি টের পেয়েছে, সুতরাং কোনো বোধই তার আসেনি। তার কাছে নতুন জামার মানে একটাই ছিলো পুরনো গুলো খুব পুরনো, অব্যবহার্য যাতে না হয়ে যায় হস্তান্তরের আগে সেটারই নিশ্চিতকরণ। মহালয়ার সকালে নতুনের মত চেহারায় বাক্সবন্দী হয়ে তারা যে কোন তেপান্তরে যেতো, বেশ খানিকটা বড় হওয়ার আগে সে বোঝেনি। কিন্তু নতুন গুলো যত সুন্দরই হোক, লাল টুকটুকে গাউন বা গোলাপী বার্বি ড্রেস, মেয়াদ এক বছর, মায়া আসতে নেই, এটুকু বুঝে নিয়েছিল। খুব ছোটতে পাপাকে তার বড় নিষ্ঠুর মনে হতো। সে গল্প শুনতো সবার বাবাদের হাত ধরে ঠাকুর দেখার আর তার বাবা ... সে বেলুন ভালোবাসে বলে রাস্তা দিয়ে যে কটা বেলুনওয়ালা তিন চার দিন ধরে যেতো, সবাইকে ডেকে সব কটা বেলুন কিনে দিতে দিতে তাকে দেখতে শেখাতো বেলুনওয়ালাদের ছেঁড়া জামা, চিন্তা করতে বলতো তাদের বাড়িতে যে ছোট্ট ছোট্ট স্বধারা আছে একটাও রঙিন নতুন কাপড়ের রুমালও না পেয়ে, তাদের ইতিবৃত্ত। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিতো বাঁশের জোগাড়ে থেকে শুরু করে ঢাকী, বিপুল শারদীয়া মূলত শ্রেণী বৈষম্যের বিকট উদযাপন। দেবীমুখের গর্জন তেল ততটাই উজ্জ্বল হয় মৃৎশিল্পী যতটা অন্ধকার ধারণ করতে পারে তার উপেক্ষিত যাপনকলায়। ফলে ছুটিতে বাড়ি ফেরার আগে তার অনেক বেশী উন্মাদনা থাকতো এবার কোন বইগুলো তার জন্য উপহার এসেছে ইলাহাবাদ থেকে সেটা জানার।



একইদিনে একই মেটারনিটি হোমে জন্মেছিলো স্বধা আর আয়ান। নিজের ছেলের মুখ দেখার আগে স্বধাকে কোলে নিয়েছিলেন আয়ানের বাবা, ক্রাইসিস ফরসেপ পেরিয়ে যে মেয়ে ডাক্তারদের নাভিশ্বাস উঠিয়ে জন্ম নিলেও মায়ের মুখ দেখতে পায়নি ভেন্টিলেশন ওভারের আগে। তার বাল্যবন্ধু নীলাদ্রির পৌঁছতে আরও তিনদিন লেগেছিলো। জন্মমুহূর্ত থেকে পরবর্তী বাহাত্তর ঘন্টা তিনিই ছিলেন একাধারে স্বধার পিতা ও মাতা। এর পরের কোনো মুহূর্তেই তিনি স্বধাকে নিজেরই অপত্যের বাইরে কিছু মানতে পারেন নি। এমন কোনো উপলক্ষ এরপর আসেনি যেখানে আয়ানের সমান উপহার নীলাদ্রির ঠিকানায় পৌঁছায়নি। স্বধার ভিতর দিয়ে স্বল্পায়ু জুনেইদ খান তার মেয়ের বাবা হওয়ার যাবতীয় উপলব্ধি পেতে চেয়েছিলেন প্রগাঢ় টানে। যখন স্বধা তাকে তার প্রকৃত মর্যাদা দেওয়ার বয়সে পৌঁছেছিলো, তিনি সাড়ে তিন হাত জমিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুধু উপহারগুলো থেকে গেছে। বই ব্যতীত অন্য উপহারকে জুনেইদ ব্লাসফেমি মনে করতেন, এইই রহস্য অজস্র দুষ্প্রাপ্য এডিশনে স্বধার ব্যক্তিগত স্টাডি আলোয় আলো হয়ে থাকার, তার লেখায় কাফনের রঙের আধিক্যেরও বটে। কেন বইকে সে শরীরের অংশ মানে, তারও একই সূত্র হয়তো। নিয়তি হিসাবে সে বই আর বই তাকে সহবাসে রেখে আসছে, নাড়ি ছেঁড়ার ক্ষণ থেকে, জুনেইদ কি জানতেন খুব বেশীদিন তিনি তার মেয়েকে ছুঁয়ে থাকতে পারবেন না? তাই এই আমবিলিক্যাল সাবস্টিটিউট পুঁতে যাওয়া?



সেই এগারোর ছুটির প্রথম দিনে ব্রাউন পেপার ছিঁড়ে স্বধা যে পাঁচটা বই জড়িয়ে ধরেছিলো, তিরিশ বছর পরের স্বধাকে ময়নাতদন্ত করলে হৃদপদ্মে তাদেরই কিছু শব্দকে খোদাই করা পাওয়া যাবে, এ ধ্রুব। সেই পঞ্চকই স্বধার নির্মাণবেদ। তার সমগ্র অস্তিত্বকে ময়ালের শ্বাসে টেনে নিয়ে জাদু আর পরার ইনফিউশনে ফেলে দেওয়ার বাস্তবগ্রন্থি। ছুটি শেষের দিন ফিরে যাওয়ার আগের সন্ধ্যায় প্যাকিং চেক করার সময় তলপেটে যন্ত্রণা করায় সে যখন প্যান্টিতে ডার্ক চকোলেট পেস্ট আবিষ্কার করে, এগারো বছরের মেয়ের পড়া হয়ে গেছে তার মানে, সৌজন্যে - "ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড"। কিছু বছর পর পীতাম্বরপুরায় সত্তরোর্দ্ধ দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার সম্পর্ককে ঘিরে যখন বাঙালীটোলার মুখিয়ারা পুরোদস্তুর গেস্টাপোর ভূমিকায়, চবুতরায় মাথা নিচু করে বসে থেকেছে সে, একান্ত ব্যাক্তিগত এক সহজ সত্যের অনুভবকে সামাজিক তুলায় চাপানোর বাঙালী অশ্লীলতার গ্লানিতে, কারণ তার মাথার ভিতর দিয়ে তখন ভেসে চলেছে ডাজা আর আরিজার জাহাজিয়া নির্বাণ - "লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা"। 


ঘোরে "মিসিং ইউ জুনিপাপা" ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে স্বধা দেখতে পেয়েছিলো অর্ক রাজহাঁস'রঙা শার্টের ভিতর কলোসাল গেট পেরিয়ে হেঁটে আসছেন। প্রাচীন বৃক্ষরাজির সদ্যস্নাত সবুজ চুইঁয়ে হীরের কুচিরা তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। চুল থেকে কপাল গড়িয়ে ঠোঁট - প্রশস্ত কাঁধ - দীর্ঘ বাহু - ভিজে উঠছে। ডানহাতে ট্রাইডেন্টের জায়গায় তিনটে বই। ব্যাস এটুকুই ব্যবধান পোসেডনের সমুদ্র থেকে উঠে আসার সঙ্গে। আঠারোর বুক জানে খরগোশের নরম ঠিক কতটা লাব ডুব নিতে জানে। হোক না তার বাবার নাম নীলাদ্রি চ্যাটার্জি, রিফুর নৈপুণ্যে যতই তার ভিতর বুনে দেওয়া হোক অকাল কাঠিন্য, জলোচ্ছাস তীব্র হলে চর ধ্বসে না যাক, ফাটল তো ধরেই। অশ্বত্থ ঘেরা ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশের স্যাঁতস্যাঁতে কড়িবরগার বিরাট হল... মেহগিনি গ্যালারির একদম শেষ রো'তে উঠে গিয়ে বসে পড়েছিলো। নিজের শ্বাসের শব্দ নিজের কাছেই কখনো কখনো ভয়ের দাবিদার। কিছুটা সময় একা থাকার দরকার ছিলো খুব। দেরী হয়ে গেছে। অর্ক ঢুকছেন হলে। প্রতিধ্বনি হলো -

-- "জানতাম... কেউ আসেনি...               অথচ আজ প্রুফ্রক'কে দেওয়ার         কথা... as far as my capacity       permits... স্বধা, তুমি কী চাইছ?        মানে, চাইছ কি?"

আত্মস্বরও আউটসাইডার হয়, স্বধার জ্ঞান বাড়ল উচ্চারণের পরেই -


-- "শেয়ার করার লোক না থাকলে         চাওয়ার টেনাসিটি বাড়ে বোধহয়"


--- "বেশ... let's begin then..."




 পরের আড়াই ঘন্টা এলিয়টকে "লাভ সংস অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক" এর চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন অর্ক। সেদিন বর্ষণ সম্ভবত তার সঙ্গে ঈর্ষায় নেমেছিলো এবং...হেরেছিল। অর্ক তাকিয়েও দেখেন নি একবার, না ঘড়ি, না বারিধারার গতি। ডায়াস নয়, স্বধার ঠিক সামনের ডেস্কে ডিপ ব্লু ডেনিমে ক্রসলেগড অধ্যাপকটি একবারের জন্যেও রেফারেন্স হাতড়াতে চোখ নামান নি কোনো বইতেও। অর্ক হল ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে স্বধা টের পেয়েছিলো তার জ্বর এসেছে প্রবল।


সে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় অর্ক তার তিনজন কলিগের সঙ্গে স্মোকিং জোনে...

-- "স্বধা, শুনে যাও তো"

হে ঈশ্বর, ক্ষমা আঁকা যায় না? মরণ কি সর্বদাই শ্যামরূপী? কে. ভাস্করনকে মন দিয়ে শোনেনা বলে নীলাদ্রি দুঃখ পান, সেই শাস্তিই কি আজ পাচ্ছে সে? সে এগোনর আগেই অর্ক হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলেন -


-- "ডায়েরিটা রাখো, আমার                   পার্সন্যাল নোট, যখন তোমার             মতো বাচ্চা ছিলাম, এলিয়টকে         এখানে রাখতাম"


লাইটনিং স্পিডে স্বধার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো অসুস্থ শরীরে -

-- " লাগবে না "

অর্ক থমকেছিলেন -

-- " মানে? নেবে না?"

স্বধা তখন অন্য মানুষ -

-- " না। বাচ্চাদের নিজেদের নোট            নিজেদেরই তৈরী করা উচিৎ।             আমিও করছি। গুড প্র্যাক্টিস। "



হা হা করে হেসে উঠেছিলেন অর্ক। নির্জন ইমারতটি অর্ক বাগচীর বিরল সেই হাসিতে বিস্ময়ে আছাড় খাওয়া সূক্ষ্ম চায়না ভাস হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন, তার সহজাত গাম্ভীর্যের থেকেও কয়েক মাত্রা গভীরে-- 



-- " লুটো ইগনিস... লুটো ইগনিস              তুমি স্বধা...
     অন্ধত্ব আরোপ করাই আমার            একমাত্র কর্তব্য এখানে। এত               বেশী বোঝো, এত কিছু জানো,           বেসিক'গুলো না দেখা থাকে কী         করে? আমিও মানুষ। "


স্বধা খড়ের কাঠামো হলে তার দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে অর্কর বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই অগ্নিদেবের উদরপূর্তি হতো খানিক। ঘোর কলিতে তাও হয় না, এ কি কম যাতনার? স্বধার স্ট্যাচুর হাতে ডায়েরিটা ধরিয়ে দিয়ে কথা শেষের পর এক সেকেন্ড দাঁড়ান নি অর্ক। তার পরের সাতদিন কলেজ চত্বরে দুজনের কারোর পা পড়েনি। উত্তাপ যে কতদূর সংক্রামক, স্বধার স্নায়ু টের পেয়েছিল। সাতদিন... প্লাবনের প্রস্তুতি হিসাবে খুব কম সময় ছিলো না ঋষ্যমূকদের কাছে, সম্ভবত মৃগয়াভূমির কাছেও নয়।



1 টি মন্তব্য: