শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

ভজন দত্ত



(প্রিয় পাঠক গত সংখ্যায় লেখা দিতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।না,কোনো অজুহাত নয়।পারলে ক্ষমা করবেন।)
            ।।  পুরুলিয়ার মুখ ।।
                                     ভজন দত্ত
দ্বিতীয় পর্ব :
৪.
বর্তমানে বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় সবকিছুর মধ্যেই নানান পরিবর্তন এসেছে।এই বাংলার 'মুখোশ গ্রাম ' চড়িদাতেও লেগেছে সেই পরিবর্তনের ঢেউ। টিভি ও ফিল্মি দুনিয়ার প্রভাব এসেছে।যেমন, শিবের মুখোশের মধ্যে ব্যাটারির আলো জ্বালিয়ে তৃতীয় নয়ন বা কোমরে ব্লাডার বেঁধে শিবের জটায় গঙ্গার জলধার করা এসব। অনেকে আক্ষেপ করে বলেন,  মুখোশ ও বীরত্ব ব্যঞ্জনাই হল ছৌনাচের আসল। তা যেন এখন পুতুল নাচ হয়ে যাচ্ছে। মুখোশ তৈরির ব্যয় বাড়ছে দিন দিন তাই সাদা সাপ্টা স্বল্পব্যয়ে মুখোশের ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে পর্যটন শিল্পের বিকাশের ফলে পর্যটকরাও মুখোশ স্মারক হিসাবে ক্রয় করছেন পুরুলিয়া শহর বা চড়িদা বা ঝালদা বা জয়পুরে।জয়পুরের ডুমুরডি গ্রামেও মুখোশ তৈরি হয় একই পদ্ধতিতে। তরুণদেব ভট্টাচার্য্য তাঁর পুরুলিয়া গ্রন্থে  ( প্রকাশ:১৯৮৬) লিখেছেন, " দশবছর আগে চোড়দায় মুখোস তৈরি করতেন ২৯ টি পরিবার।পরবর্তীকালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ টি। ডুমুরডিতে সংস্থা আছে তিনটি। বর্তমানে আরো কটি জাশগায় মুখোশ তৈরি সুরু হয়েছে।তাদের মধ্যে অন্যতম,পাড়া,ঝালদা ১নং ব্লক,সাঁতুড়ি ও আড়শা। "( বানান অপরিবর্তিত, পৃষ্ঠা  ৩৩৭-৩৩৮) বর্তমানে পুরুলিয়ার শিল্প মানচিত্রে এই মুখোশ শিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিকমত বিপণন করতে পারলে মুখোশ শিল্প থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
৫.
চড়িদা গ্রামে দত্ত,শীল ও পাল পদবীধারী সূত্রধররা সপরিবারে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।লোকশ্রুতি যে তাঁরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলা থেকে।তাদের জমি দিয়েছিলেন, তখনকার বাগমুন্ডির রাজা।তা এমনি এমনি দেননি সে জমি । তার পিছনে জমিদারের শর্ত ছিল।সে শর্তটি হোল,জমিদারের দেবদেবীর মূর্তি গড়ে দিতে হবে।নানান দেবদেবীর মধ্যে ভাদুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরাই পুরুলিয়ায় মুখোশ তৈরির সূচনা করেন। আর তার পিছনে বাগমুন্ডির রাজা বা জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যতদূর জানা যায় এই চড়িদা গ্রাম থেকেই জয়পুর থানার ডুমুরডি ও অন্যান্য জায়গায় তারা বসতি স্থাপন করে।
৬.
প্রস্তরযুগের পরবর্তীকাল থেকেই মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক সকল পর্বেই ব্যবহৃত হয়েছে মুখোশ।মুখকে ঢেকে রাখাই তার কাজ। আর নৃত্যে মুখোশের ব্যবহার আদিম লোকসমাজের এক অভ্যেস।পৃথিবীর সবদেশেই তা  দেখা যায়। ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার জাভা,সুমাত্রা, বলীদ্বীপ, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা মহাদেশে,সুমের সভ্যতায়,গ্রীক ও রোমান রাজত্বে, দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলে ও পৃথিবীর আরো নানান জায়গায় নানান কারণে মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। প্রবহমান সেই  পরম্পরা বহন করে চলেছে পুরুলিয়ার মুখোশ।লোকায়ত স্তরে নৃত্যে বিশেষ করে ছৌ নৃত্য মুখোশ ছাড়া ভাবাই যায় না। বর্তমানে আজ তা বাস্তবিকই শুধু পুরুলিয়ার মুখ নয়, বাংলার রূপ হিসেবে স্থান লাভ করেছে। তো, কবি কী বলতেন, এই পুরুলিয়ার এই মুখোশ দেখে। আমাদের মুখোশ গ্রাম চড়িদা আজ বাংলার গর্ব।
ঋণ:
১/ পুরুলিয়া : তরুণদেব ভট্টাচার্য্য, ফার্মা কে এল এম, কোলকাতা : ১৯৮৬
২/ পশ্চিমবঙ্গ ( পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা),জুন, ২০০৭
৩/অহল্যাভূমি পুরুলিয়া : সম্পাদনা, দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন, কোলকাতা : জুলাই, ২০০৩
আলোকচিত্র : উজ্জ্বল দাস। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন