শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

শর্মিষ্টা দত্ত


অভিযোজন (২)

সকালে রান্না সেরে সেলাই মেশিন  নিয়ে বসেছিলেন ভারতী ।আজ বিকেলেই ডেলিভারি দিতে হবে ব্লাউজগুলো ।কাল সারাদিন মল্লিকাকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন , কোন কাজই হয়নি ।পাড়ার দর্জির দোকান থেকে অর্ডার নিয়ে মেয়েদের জামা-কাপড়  সেলাই করেন ভারতী ।সামান্য যা আয় হয় তাতে তার নিজের খরচটুকু চলে যায় ।দাদার কাছে হাত পাততে হয়না ,সংসারের টুকটাক জিনিসপত্রও আনতে পারেন ,মল্লিকার হাতেও  অল্পসল্প দিতে পারেন কিছু  ।তাঁর নিজের আর কি ই বা এমন খরচ ! একা বিধবা ...তবু এই কাজটা করেন বলে নিজেকে এখনো দাদার সংসারের গলগ্রহ মনে হয় না । ভাইপোরা স্কুল আর দাদা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর বৌদি গেছে পাড়া বেড়াতে ।বাড়িতে ভারতী এখন একা ।আজ কিছুতেই কাজে মন বসছে না ,থেকে থেকেই কাল রাত্তিরে মল্লিকার জলভরা চোখদুটো চোখের সামনে ভাসছে । তাড়াতাড়ি হাত চালাতে লাগলেন ভারতী ।বাঁচাখোঁচা কাপড় দিয়েই বাচ্চার জন্য বানিয়ে ফেললেন দুটো ফ্রক ...ঝড়ের গতিতে ।

অর্ডারটা ডেলিভারি দিয়েই যেতে হবে মল্লিকার বাড়ি ।কে জানে ,কেমন আছে মেয়েটা ! নিজের বলতে তো এই একটা বোনই আছে তাঁর ।দাদা তো অনেক দূরের মানুষ এখন ...নেহাতই বেনিয়াপুকুরের এই বাড়িটা পৈত্রিক ,তাই ভারতী নিজের অধিকারেই থাকেন এখানে ।বছর তেরো  আগে ,বিয়ের দু বছরের মাথায় যখন ম্যালেরিয়ায় স্বামী মারা যান তখন বাবাই শ্যামবাজারের শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে এখানে ফিরিয়ে এনেছিলেন ।মল্লিকা তখন মাত্র এগারো  বছরের মেয়ে ,ওই বয়সেই দিদিকে আগলে রেখেছিল দুহাতে ।মা তো মারা গেছেন সেই কবেই ...মল্লিকার জন্মের তিন বছর পরেই ।মল্লিকা ছোটবেলা থেকে দিদির কাছেই মানুষ ।বাবাও  চলে গেছেন তাও প্রায় সাত বছর হতে চলল ।দুই বোনই পরস্পরের অবলম্বন হয়ে উঠল অবশেষে ।ন 'বছরের ছোট বোনটাই এখন ভারতীর সব । সম্ভব হলে মল্লিকাকে এখানেই নিয়ে আসতেন হাসপাতাল থেকে , কিন্তু দাদা -বৌদি কালই সাফ বলে দিয়েছিল ,ভারতী যেন মল্লিকাকে তার শ্বশুরবাড়িতেই রেখে আসে ।দাদার পক্ষে আর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব না ।

সারাটা দুপুর ধরে প্রায় দশটা ব্লাউজের বোতামঘর সেলাই করে ,হুক লাগিয়ে , গলায়-পিঠে হেম দিতে দিতেই বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গেল ।রোদ পড়ে এসেছে , শীত কামড় দিচ্ছে শরীরে ...ঘরে পরার শাড়িটার ওপরেই একটা মোটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভারতী ।'পরিধান টেলর্সে ' গুণে -গুণে দশটা ব্লাউজ ডেলিভারি দিয়ে ,পরবর্তী কাজের জন্য ছিটকাপড় ভরে নিলেন ব্যাগে । তারপর টাকা-পয়সা বুঝে নিতে নিতেই সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল ।ইতিমধ্যেই  ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে ।তাড়াতাড়ি পা চালালেন ভারতী ...মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান থেকে পাঁচ টাকার সন্দেশ নিলেন ...মল্লিকা ভালোবাসে ।শুধু তার জন্য নিলে তো হবে না ...তার শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য সবসময়ই বেশি বেশি করেই জিনিস নিয়ে যেতে হয় ভারতীকে ।এসব সামাজিকতা -কর্তব্যের দায় তাঁরই ...দাদা থাকতেও ! অবশ্য দাদা যে প্রণবের সঙ্গে মল্লিকার বিয়েটা দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছে , এটাই অনেক ! নয়তো মল্লিকার বিয়ে নিয়ে অশান্তি তো কম হয়নি ।ভারতীই কি মেনে নিতে পেরেছিলেন ! তবু অদৃষ্ট বলে মেনে নিয়েছেন সব । নয়তো তাঁর বিএ পাশ ,এমন সুন্দরী বোনের কি প্রণবের মতো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা !

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তাঁতীবাগানে ঢুকে পড়লেন ভারতী ।গলির মোড় থেকেই উমা আর প্রণবের উত্তপ্ত বাক্যালাপ আর মল্লিকার চাপা কান্নার আওয়াজ কানে এল তাঁর ।বন্ধ দরজাটার সামনে মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে করাঘাত করলেন ...আকস্মিক থেমে গেল সব আওয়াজ ...নিরুপায় নৈঃশব্দে ডুবে গেল শীতের সন্ধ্যে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন