শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

রীনা রায়





তৃতীয় পর্ব:
এক একটা মানুষের চেহারা এমন হয় যে কিছুতেই বয়স বোঝা যায় না, কেমন একটু পাকানো টাইপের, এদের ত্রিশ বছর বয়সেও পঞ্চাশ মনে হয়, আবার সত্তর বছরেও পঞ্চাশ লাগে।
শেখরকে দেখতে ঠিক ঐ ধরনের, ওর বয়স এখন ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ হলেও ওকে দেখে পঞ্চাশোর্ধ মনে হয়। নিজের এই পাকানো চেহারাটা নিয়ে শেখর একটুও খুশী নয়। সারাক্ষণ চোখে মুখে কি যেন একটা বিরক্তি লেগে থাকে, কোনো কিছুতেই যেন তৃপ্ত নয়।
চেহারা অনেকসময়ই একটা মানুষকে বিচার করতে সাহায্য করে, তার ইতিহাস বলে দেয়।
যেমন শেখরকে দেখেই বোঝা যায় ওর চলার পথটা মোটেও মসৃণ ছিলোনা এবং সেটা একশভাগ সত্যি।
শেখরের বাবা একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন। তখন বেতনও পেতেন খুবই কম। কোনোরকমে দিন গুজরান হতো। তখন শেখর সবে ক্লাস এইট, আচমকাই বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়, দিনদুয়েক টানাপোড়েনের পর উনি মারা যান। জমানো পুঁজি কিছুই ছিলোনা, যেটুকু ছিলো বাবার চিকিত্সায় তাও শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই শেখরকে রোজগারের চেষ্টা করতে হয়। বাড়িতে ওর মাও টুকটাক সেলাই ফোঁড়াই করতেন।
সারাদিন নানারকম ছোটোখাটো কাজ, টিউশন পড়ানো আর রাত জেগে পড়াশোনা করে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে শেখর একসময়ে ইতিহাসে এম এ পাশ করে ফেললো। এরপর ভগবানের দয়ায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেলো।
কিছু টাকা জমিয়ে শেখর ততদিনে একটা দোতলা বাড়িও করে ফেলেছিলো।
শেখরের কোনো এক দূরসম্পর্কের পিসির ননদের বাড়ি ছিলো ওদের পাড়াতেই। কলেজে যেতে আসতে অনন্যাকে উনি দেখতেন।
অনন্যার তখন এম এ ফাইনাল ইয়ার। ইউনিভার্সিটি বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিলোনা, তাই ও বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতো। একদিন বাড়ি এসে দেখে পাড়ার ঐ কাকিমার সাথে আরও দুই ভদ্রমহিলা বসে আছেন । মা ওকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো, ওনারা নাকি ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন।
বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় এগিয়ে আসছিলো, তাই ওর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বিয়েটা হয়েই গেলো। অবশ্য ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করেছিলো।
শেখরকে তখন অপছন্দ না করার মতো কিছু ছিলোনা। বাবা বললেন, ''দেখেই বোঝা যায় পরিশ্রমী ছেলে, আমার মেয়ে ওখানে খারাপ থাকবেনা"। কিন্তু মানুষকে ওপরে দেখে আর কতটুকু চেনা যায়! যে ঘর করে সেই জানে।
শেখরের মায়ের মিষ্টি ব্যবহারেও মা বাবা মুগ্ধ হয়েছিলো। উনি মানুষটা সত্যি তেমন খারাপ ছিলেন না, কে জানে হয়তো ওরই কপালে সইলোনা! না হলে এত যে ভালো মানুষ, ওর সাথে এত দুর্ব্যবহার কেন করতেন?
যাইহোক, এক শুভদিন দেখে, অনেক পাঁজিপুঁথি বিচার করে ওদের রাজযোটক সাব্যস্ত করে বিয়েটা হয়েই গেলো!
প্রথম প্রথম ওর ভালোই লাগতো, ভাবতো ওর স্বামী কতো কেয়ারিং! দিনে দিনে ও বুঝতে পারলো আসলে মানুষটা ভীষণভাবেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, নিজের পাকানো চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, আর অনন্যা যেহেতু দেখতে সুন্দর ছিলো তাই সবসময় ওর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতো। কারণে অকারণে ওকে সন্দেহ করতো, এবং দিনে দিনে রোগটা বেড়েই চললো।
একদিন ও মন্দিরে পুজো দিতে গেছে, লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলো শেখর লাইন থেকে বেরিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ও অবাক হয়ে যায়, তারপর দেখে একটু দূরে একটা ছেলে ওকে দেখছিল, তাকেই আড়াল করে শেখর দাঁড়িয়ে! দিনকে দিন এই পসেসিভনেস বেড়েই চললো। ও একা কোথাও বেরোতে পারতোনা, এমনকি ওর কোনো প্রয়োজনে টাকা পয়সা নিলেও তার প্রতি পয়সার হিসেব দিতে হত। কারুর সাথে ফোনে কথা বললে মোবাইলে স্পীকার অন রাখতে হতো। বাপের বাড়ি গেলে সঙ্গে করে গিয়ে আবার নিজে নিয়ে ফিরতো।
প্রতি মুহূর্তের এই নজরদারি ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল।
একবার সম্পর্ক ভাঙার কথাও ভেবেছিল। ঠিক সেই সময়েই ও সন্তানসম্ভবা হোল, অন্যদিকে ওর বাবাও হঠাৎই মারা গেলেন।
সবদিক থেকে ও যেন অসহায় হয়ে পড়লো।
(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন