শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

শমিতা চক্রবর্ত্তী


বেলা শেষের আলোয় 
-------------------------------
                            
                      -------------------------

পায়ে কোনরকম চপ্পল টা গলিয়েই দৌড় দিলো স্নিগ্ধা --ইস্ আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে ! যাবার আগে একবার নিজের ব্যাগ টা চেক করে নিলো --মায়ের প্রেসক্রিপশন টা নিয়েছে তো --মায়ের প্রেসারের ওষুধ টা আজ আনতেই হবে -ওটা ফুরিয়ে এসেছে .

               আজ প্রায় ছমাস হতে চললো এই শুভঙ্কর স্যার এর বাড়ির কাজ টা .কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে লোকটার প্রতি !  কী ভীষণ নির্ভর করছে লোক টা ওর ওপর ! ও না গেলে সকালে ব্রাশ টা পর্যন্ত করতে চায়না -রঘু দার হাতে .আসতে আসতে অবশ্য হাত -পা এখন অনেক টা ই সচল --ওয়াকার ছাড়া একটু একটু করে হাঁটছেন ও এখন . প্যারালাইজড অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল হলেও --মনটায় বোধ করি এখনও জোর পাচ্ছেন না ! 

          ডক্টর মহুয়া ম্যাম এর সময় কোথায় স্বামীর দেখভাল করার !  ভীষণ ব্যস্ত মানুষ ! ওনার নার্সিং হোম 'জীবন -দীপ ' এই শহরের নামী দামী নার্সিং হোম গুলোর মধ্যে একটা ! তার ওপর আজ দিল্লী কাল মুম্বই এ সেমিনার লেগেই থাকে !  তাই তো নিজের নার্সিং হোমের একজন কেয়ারিং নার্স কে স্বামীর দেখভালের জন্য নিযুক্ত করেছেন ! 

              স্নিগ্ধা ঠিক যা ভেবেছে তাই --উনি ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে আছেন -রঘু দা কতবার সেধে গেছে -'সাহেব চলুন ব্রাস টা করে নিন , রাতের বাসী জামাকাপড় গুলো ছেড়ে ফেলুন ' . কিন্তু ঐ এক গোঁ --স্নিগ্ধা আসুক না ! 

               ও বাবা স্যারের মুখ ভার !  গম্ভীর গলায় ----কি ব্যাপার স্নিগ্ধা এতো দেরী যে --আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি !  স্নিগ্ধা মিষ্টি হেসে ----- মাফ করবেন স্যার -আজ বড় দেরী হয়ে গেলো --মায়ের শরীর টা তেমন ভালো নেই -একটু ঘরের কাজ ও সেরে আসতে হল .

      মিষ্টি হাসি বুঝি সব কিছু ভুলিয়ে দেয় !  শুভঙ্কর সেন ও সব ভুলে বললেন ---- সে না হয় হল কিন্তু স্নিগ্ধা আজ তোমার কপালের টিপ টা কই --কেমন যেন খালি খালি লাগছে মুখ টা ! 
  
        আরক্ত হল স্নিগ্ধা র মুখ --মানুষ টা তাকে এতও খেয়াল করে !  ওর এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এতো গভীর ভাবে তাকে কেউ কোনদিন খেয়াল করেছে বলে মনে পড়েনা ! নিজের দিকে তেমনভাবে তাকাবার সুযোগ ই হয়নি কখনও !  মাত্র আঠারো বছর বয়সেই বাবার মৃত্যু আর তারপর ই তো শুরু জীবন যুদ্ধ ! মা আর ছোট ছোট তিনবোন সম্বল বলতে বাবার জমানো সামান্য কিছু টাকা আর এই মাথা গোঁজার আস্তানা   টুকু !  কোনরকমে এই মিড ওয়াইফারী নার্সিং ট্রেনিং টা করেছিল --তারপর এই নার্সিংহোম ঐ নার্সিংহোম ঘুরে ঘুরে চাকরী -বোনে দের মানুষ করা বিয়ে দেওয়া এসব করতে করতেই কখন যেন পেরিয়ে গেলো তার বিয়াল্লিশ টা বছর !  ওর সাজগোজ বলতে ঐ পরিপাটি করে শাড়ি পরা , একটা লম্বা বেণী আর কপালে ছোট্ট টিপ !  আজ তাড়াহুড়ো তে টিপ পরতেই ভুলে গেছে !
স্যার এখন অনেক টা সুস্থ হাঁটছেন ও একটু একটু করে . ম্যাডামের নির্দেশ রোজ বিকেলে বাগানের দিকটায় একটু হাঁটাচলা করাতে হবে ওনাকে --যাতে নিজের ওপর কনফিডেন্স টা একটু বাড়ে . সেদিন বিকেলেও হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক গল্প হচ্ছিলো দুজনে --হঠাত্ই স্নিগ্ধা একটু মজা করেই বললো --স্যার এবার তো দেখছি আপনি একদম সুস্থ হয়ে গেছেন --আমার তো এবার ছুটি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে !  থমকে দাঁড়ালেন শুভঙ্কর সেন --হঠাত্ই স্নিগ্ধা র হাত দুটো ধরে বললেন প্লিজ প্লিজ স্নিগ্ধা --আমাকে ছেড়ে যেও না --আমি হয়তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বো ---তুমি জানোনা -আমি কী ভীষণ একা !  তোমাদের ম্যাডামের অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কাছে আমি একেবারে সংকুচিত হয়ে থাকি !  কোথায় বিত্তশালী বাপের বিদূষী কন্যা ডাক্তার মহুয়া মিত্র আর কোথায় আমি নেহাতই মফস্বলের এক কলেজের ছাপোষা অধ্যাপক শুভঙ্কর সেন ! 

             ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা অপ্রস্তুত হল স্নিগ্ধা --কেউ দেখে ফেললো না তো ওদের !  মুখে অবশ্য হাসি টেনে বললো --কী যে বলেন স্যার ! আর মনের মধ্যে একঝলক দখিনা বাতাস বয়ে গেলো ! তবে কি কোথাও ওর ও একটু একটু করে ভালোলাগা তৈরী হচ্ছে ! 

         মনকে চোখ রাঙালো স্নিগ্ধা --এসব কী ভাবছে !  ম্যাডাম এই কাজের জন্য তাকে ভালোরকম স্যালারি দেন . নার্সিংহোমে যা পেতো তার চেয়ে অনেক -অনেক বেশী . মায়ের ওষুধ -বিষুদ ,  একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখা --সবই এই ম্যাডামের দয়ায় ! 

              ম্যাডাম মুম্বই থেকে আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরবেন --রঘু দা , মিনতি দি ভীষণ ব্যস্ত আজ --ম্যাডামের সবকিছু পারফেক্ট আর টাইমলি চাই --এসে যদি কোথাও এতটুক ত্রুটি পান তো কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন ! 

           আজ ও বাগানে হাঁটতে হাঁটতে স্নিগ্ধা র সঙ্গে গল্প করছেন স্যার --অল্প বয়সে নাকি কবিতা টবিতা ও লিখতেন --সেসব কবিতা র দু -এক ছত্র শোনাচ্ছেন ও স্নিগ্ধা কে আর শিশুর মতো হাসছেন !  হাসিতে যোগ দিচ্ছে স্নিগ্ধা ও মাঝে মাঝে তারিফ ও করছে কবিতার !  এমন করেই শেষ বেলার মৌতাত টুকু উপভোগ করছেন দুজনে ! 
   
              হঠাত্ই সম্বিত ফিরলো ম্যাডামের ডাকে --বাহ্ শুভ --তুমি তো পুরোপুরি ফিট দেখছি --এতোটা হাঁটতে পারছো !   আর এ তুমি ? তোমার তো রাতের ফ্লাইট ছিলো !  হ্যাঁ কাজ মিটে গেলো - তাই দুপুরের ফ্লাইট ধরেছি - তোমাদের জানাইনি --সারপ্রাইজ দেবো বলে ! 

                তা যাই বলো শুভ --খুব ভালো লাগছে তোমায় দেখে --বেশ ফ্রেশ লাগছে তোমায় --এর ক্রেডিট টা কিন্তু স্নিগ্ধার ই --কি বল !  তাহলে --এবার স্নিগ্ধা কে অব্যহতি দিই ?  ও আবার নার্সিংহোমে ফিরে যাক ! 

               বেলাশেষের নরম আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা স্যারের মুখ টায় কেউ যেন এক পোঁচ কালি লেপে দিলো ---হ্যাঁ মানে না পুরোপুরি সুস্থ তো হইনি --এখনই স্নিগ্ধা কে -----
চোখ পাকালেন ম্যাডাম --শুভ কনফিডেন্স লেভেল টা বাড়াও --এবার তো তোমাকে কলেজে জয়েন করতে হবে !  

         স্নিগ্ধার ও হঠাত্ই মনে হল কেমন যেন আলো কমে আসছে -সেই কবিতা টার মতো 'গোধূলি যে ক্রমশ বেগুনী ' ----- কেন জানে না বুকের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলো -কেমন যেন পাড় ভাঙার শব্দ .
               ____________

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন