সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

জয়তী রায় ( মুনিয়া)



সোনার পরী --

------------------------------------------
জয়তী রায় ( মুনিয়া)


     
আজ বড়দিন কলকাতা মেতে উঠেছে আলোতে, উৎসবে, আনন্দে, কেক, আড্ডা সব নিয়ে কল্লোলিনী যেন আজকের শহর অনু নিঃশব্দে হাঁটছিল চার্চের সামনের রাস্তা ভীড়ে ভীড় সে একটু পেছন ঘুরে যাবে ওদিক টা একটু অন্ধকার মতো অদ্ভুত এক টানে মাঝে মাঝেই চার্চে চলে আসে সে বসে সেই মহান ভালোবাসার পায়ের কাছে চোখ দিয়ে আপনি গড়িয়ে পড়ে জল অনু কিছুতেই বোঝেনা কোথায় এক বন্ধন আছে তার যীশুর সঙ্গে! চার্চে ঢুকলে  টের পায় খুলে যাচ্ছে সমস্ত অর্গল হালকা শরীর উড়ে যেতে চায় অনন্ত  শুন্যে সে কাউকে বলতে পারে না এসব কথা আজও যখন বাড়ীর সব কাজ সারছে, খাবার, মায়ের ওষুধ, বুকের মধ্যে ঘন্টা বেজে উঠলো , মনে হলো যেতে হবেই চার্চে মাকে চিন্তা না করতে বলে বেরিয়ে এসেছে আলোয় আলোময় চার্চ একলা বসার কোনো উপায় নেই তবু একটা কোনা খুঁজে বার করে সে বিভোর হয়ে রইলো তাঁর চিন্তায় রকম করুণা ঘন চোখ, যন্ত্রনায় রক্তাক্ত শরীর অথচ মুখে কেবল মায়া, ক্ষমা, অপার শান্তি অনু চোখ বুজে ছিল জল গড়িয়ে পড়ছিল বন্ধ চোখের কোল বেয়ে হঠাৎ একটা আলোর কণা ছিটকে উঠলো, এমন মনে হলো তার চমকে তাকাতেই মনে হলো,আকাশ জুড়ে এক সোনার পরী উড়ে যাচ্ছে

প্রথমে ভাবলো আলোর কোনো খেলা বুঝিবা কিন্তু তাতো নয় বড়ো দুটি পাখা আকাশ জুড়ে ছড়ানো, মাঝে ফুটফুটে এক সোনার পরী মিলিয়ে গেলো দেখতে দেখতে স্তম্ভিত হয়ে রইল অনু চিমটি কেটে দেখলো , বাস্তবেই আছে সে শরীর টা কেমন যেন করে উঠলো মাথাটাও ঘুরে উঠলো সকাল থেকে মন ভার থাকাতে ঠিক করে খাওয়া হয়নি, তার জের কিনা এসব কে জানে!

*

বড়দিনের অনুভূতি টা পরদিনও একটু একটু ছিল অফিসে এলো ঠিক কিন্তু, ভুঁরু কুচকেই রইলো তার ভালো লাগছে না ঠিক তারপরে সোনার পরী যদিও ব্যাখ্যা একটা আছে চার্চে ঢুকে তার এতো হালকা লাগছিলো যে, নিজেই উড়ে যেতে চাইছিলো, সেটাই ওমন করে দেখা দিল কিনা কে জানে? যাই হোক মাছি তাড়ানোর মতো করে চিন্তা তাড়াতে চাইলো সেই সময় রাজা এসে দাঁড়ালো টেবিলের পাশে প্রথমে তো দেখতেই পায় নি গলা খাঁকারি শুনে চমকে তাকিয়ে দেখে ,রাজা মাথা  থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে উঠলেও, শান্ত ভাব বজায় রেখে প্রশ্ন করলো," কি চাই?" আজ অনুর মন ভার আজ সে কাউকে ছেড়ে কথা কইবে না! রাজা কী একটু ঘাবড়ে গেলো? আমতা আমতা করে বললো," এই মানে, জল আছে গো তোমার কাছে?" অনু যে কী বলবে ভেবেই পেলো না জল? আবার? সারা অফিসে জল নেই? সে কি চণ্ডালিকা নাকি? জল দাও মোরে জল দাও? একটা বাজে গালাগালি উঠে আসছিলো গলা পর্যন্ত, ঢোঁক গিলে ভেতরে চালান করলো তাকে সে মোটেও ওমন মেয়ে নয়, যে কাউকে বাজে কথা বলবে তারপরে কেউ চাইছে জল!  শুকনো হেসে বোতল টা এগিয়ে দিল ওই টুকু প্রশ্রয়েই চেয়ার টেনে বসে পড়লো রাজা, নিজেই বক বক শুরু করলো," গতকাল কী করলে বড়দিনে?" 

"
বড় কাজ কিছু করিনি চার্চে গেছিলাম"

",
বাঃ আমিও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু,,," থেমে গেলো আচমকা | একটু খটকা লাগলো অনুর গলার স্বর টা আর ফাজিলের মতো লাগছে না তো! কেন? তাকালো সরাসরি উফআবার সেই মায়াময় দুটি চোখসেখানে আজ ঝিলমিল কৌতুকের বদলে একটু বেদনা ছায়া যেন?  কেন ?  তবে কী রাজার একটা ছদ্মবেশ আছে তার মতো? আসলে রাজার চোখ দুটো খুব চেনাতার বুকের ভেতর এই রকম দুটোচোখ  সেই কোন ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে নির্জন পুকুরে মাছ ঘাই মারলে একটা তরঙ্গ উঠে আবার মিলিয়ে যায়, তেমনি কাজের ফাঁকে, ঘুমের মাঝে ,আড্ডা খাপে হঠাৎ করে চোখ দুটো ভেসে ওঠে আর কী যে এক বিষণ্নতা ঘিরে ধরে তখন , ঘুম ভেঙে কেঁদে ফেলে, বন্ধুদের আড্ডা তে অন্যমনস্ক হয়ে যায় তীব্র একাকীত্ব ঘিরে ধরে এগুলো সব তার নিজের একান্ত কাউকে এমনকি বাবা মা কেও বলেনি কখনো সে বুঝতে পারে কারো অভাববোধ তাকে আচ্ছন্ন করে স্বপ্নে গভীর অন্ধকার খাদ দেখে ,জোনাকির মতো মিটমিটে আলো খাদের মধ্যে, ঘুরতে ঘুরতে পড়ছে যেন, হাত বাড়ালেও কেউ নেই এইরকম সব অবস্থায় জেগে ওঠে চোখ দুটি তার অস্তিত্ব নাড়া খায় সজোরে নিজের ভেতর একা নদী চোরা স্রোত টের পায় সে অনু জানে সে আলাদা তার কোনো সঙ্গী নেই দরকারও নেই সে বেশ আছে কিন্তু এই রাজা তার জীবনে একটা গোলমেলে প্রশ্ন নিয়ে আসছে কিছু একটা নড়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে ছেলেটা বিবাহিত ছেলেটা বারবার জল খেতে আসে তার কাছে, খুব অদ্ভুত হলেও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু তার অতি পরিচিত চোখ দুটো কী করে রাজার কাছে এলো, এই হিসেব টা মিলছেনা কিছুতেই তার খুব খারাপ লাগছে নিজেকে নিয়ে মেলাতে পারছে না আগের অনুর সঙ্গে সব তার ভেতরেই হচ্ছে কেউ কিছু বুঝছে না রাজাও নয় তবু নিজের কাছে ধরা পড়াটাও তো স্বস্তির নয় এই সব ভাবনা গুলোর মধ্যেই শুনলো রাজা খুব মায়াময় স্বরে বলে উঠলো," গতকাল আমার জন্মদিন ছিল" অনু একটু অবাক হয়ে গেলো বড়দিনের দিন জন্মদিন না হবার কোন কারণ যদিও নেই, তবু তার বোকার মতো মনে হলো,যে তার খুব প্রিয় দিনেই এই ছেলেটার জন্মদিন! যাহ!  এসব কী ভাবছে সে! বার বার নিজের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে অকারণেই 

শুকনো মুখে সে উত্তর করলো," খুব ভালো দিনে তো জন্ম দেখছি তা কী করা হলো শুনি? কেক কাটলে? বেড়াতে গেলে?"

"
ধুর ওসব আবার হয় নাকি! এমনি বসে ছিলাম মা বেঁচে থাকলে পায়েস টায়েস করতেন , আমি তো সিনেমা দেখলাম সারা সন্ধ্যে!" অনুর মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠলো মুখ নিচু করে কাজ সারছিলো সে ছেলের পরোয়া নেই সে কিছু শুনছে কিনা , সে আপন মনে বক বক করে চলেছে যেন অনুর কাজের টেবিল টা  হাইওয়ের ধারের এক চায়ের দোকান যেখানে মন খুলে বসে গল্প করা যায় অনু ভেবেছিল কড়া কথা শোনাবে কিছু, বদলে সে তলিয়ে যাচ্ছিলো আবেগ আর বেদনার মিশ্রিত চোরাস্রোতে বুঝতে পারছিল উল্টোদিকে বসা যীশুর মতো চোখের ছেলেটিও তারই মতো অসহায়, একা কেন এমন মনে হলো কে জানে? ছেলেটা কোথায় একলা? ভরপুর সংসারী অথচ সে এসব ভাবছে কেন?বুকের ভেতরে মায়ার এক ঝর্ণা বয়ে চলেছে তিরতির করে অনু খুব ভয় পেলো নিজেকে এই মায়া কি আসলে সেই চাইছে? তার একলা মন কাউকে চাইছে? সে কি রাজার মধ্যে নিজের একাকিত্বের একটি আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে? জানে না অনু সে শুধু অবাক হয়ে নিজের কানে নিজের গলাকে বলতে শুনলো," রাজা আমি আছি তো আমি একদিন তোমাকে পায়েস করে খাওয়াবো "

 *

ডিসেম্বরের শেষ শীত কামড়ে ধরছে মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরে দ্রুত হাঁটতে লাগলো অনু বাস টা সময়মতো পেতে হবে তাকে আজ মায়ের শরীর টা ভালো নেই বিশেষ মার কিছু হলে মনটা বড্ড খারাপ লাগে তার ওষুধ কিনে বাজার করে ফিরবে, দুদিন ধরে কাজের মাসীর ডেঙ্গু হয়েছে আসছে না মায়ের উপরে চাপ বাড়ছে গিয়ে একটু রান্নায় হাত লাগাবে আজ কাঁচালঙ্কা, আমলকি, আলু, পেঁয়াজ , ওষুধ সব নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে পা যেন সরছিলো না তার এতো ক্লান্ত লাগছে কেন? এত বিষণ্ন লাগছে কেন ? চারিদিকে উৎসবের আমেজ, পিঠে পুলি কেকের গন্ধ, পায়েস আরে পায়েস- সে এক ছুটে আবার দোকানে দোকানী স্নেহের হাসি হেসে একে একে তুলে দিল গোবিন্দভোগ, গুড়  আর দুধের প্যাকেট মনে পড়লো সকালে করা সেই প্রতিশ্রুতি ---" আমি আছি তো!" 

ফিক করে হেসে  ফেললো হঠাৎ ক্লান্তি কেটে গেলো যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ী এসে , মাকে জড়িয়ে ধরলো পাগলী মেয়ের ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তনের খবর ভালোই রাখেন মা পায়েস চড়ে গেলো সুগন্ধিতে মাত হয়ে গেলো ঘর তিনটি প্রাণী টেবিলে বসে গরম গরম খিচুড়ী খেলো আজ সঙ্গে মায়ের স্পেশাল পেঁয়াজি আর মাছের বড়া দুর্দান্ত ঘুম এলো সঙ্গে সেই স্বপ্ন , সোনার পরী পাখা গুটিয়ে নেমে এসেছে তার শোবার ঘরের জানলার কাছে হাসছে মিটি মিটি আলোর ছটায় ভরে গেছে ঘর কে ?কি বলতে চায়? অনু ঘুমের মধ্যে হাত বাড়ালো 

*

পায়েস খেয়ে কি আলহাদ ছেলের চেটেপুটে খেয়েও যেন আশ মেটেনা তার রেগেই গেলো অনু

"
এমন করছো যেন জীবনে পায়েস খাওনি! অদ্ভুত তো!'

 "
খেয়েছি তো কিন্তু সে যেন আগের জন্মের কথা, বুঝলে অনু এর বদলে কি দিই তোমাকে বলো তো? "


---
তাই! দিতেই হবে ? এমন রেগে যাচ্ছি যে বুঝবে মজা পরে!"

---"
অনু কবিতা লেখো তুমি?"

----"
কবিতা? বলো কি পাগল নাকি তুমি? আমাকে ওমন নেকু পুষি লাগে তোমার?" 

"
কবিতা নেকু পুষিদের কাজ বুঝি? একদিন কবিতায় ভরিয়ে রাখবে নিজেকে সারাক্ষণ

-"
উফ মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো আর পারা যাবে না আমি কফি খেতে গেলামতোমার কি  ইচ্ছে শুনি? কফি খাবে না বকবকম করবে?"

"
খাওয়াবে?"

"
যত পাচ্ছো আস্কারা বেড়ে যাচ্ছে বুঝি? "

*

গঙ্গার ধারে এমন চমৎকার কফি শপ ছিল জানতো না অনু সুন্দর হাওয়া, জলে নৌকো, ছোট ছোট ঢেউ, এক উদাস বাতাবরণ তৈরী করে দিলো, কথা যেন হারিয়ে গেল হঠাৎ অনু ভাবছিল, সে কেন বসে আছে ? সে কি নিজেকে ভোলাতে চাইছে? তার হারিয়ে যাওয়া শৈশব? তার কৈশোর? তার সবকিছু মেনে নেওয়া? গুলোর থেকে আজ কি পালাতে চাইছে সে? ভেতরে কোনো তোলপাড় চলছে অনু বুঝতে পারছে, সে উদাস হয়ে যাচ্ছে আবার এই হয় তার নিজের ভেতরের কোনো টান অনুভব করেনা সে এই ছেলে কী কিছু ভাবছে? কিছু বলতে চাইছে? সম্বিত ফিরলো রাজার ডাকে--

"
অনু জানো, আমার মনে হয় খাপ খাওয়াতে পারছিনা, দুনিয়ার সঙ্গে কতদিন ধরে পালাতে চাইছি একটা পাহাড়ে যেখানে এই মেকী মুখোশ গুলো থাকবে না পারছিলাম না কিছুতেই সব কিছুর মধ্যে কত বাধা কত যন্ত্রণা ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হতে হতে ক্লান্ত ছিলাম খুব এই নতুন অফিসে এসে নিজেকে নিয়ে যে কি করবো , ভেবে কেমন অসহায় লাগছিলো, ঠিক তখনি দেখলাম সেই সোনার পরী যাকে আমি হৃদয়ে দেখি রোজ অনু, অদ্ভুত সেটা তুমি সারা অফিসে তোমার কাছে জল খাই, তৃষ্ণা খুব গভীর পাহাড়ে তো পালাবই তুমি যাবে? " অসম্ভব এক আকুতি ঝরিয়ে প্রশ্ন করলো রাজা--

    "
যাবে অনু? সোনার পরী গেলে তবে তো সম্পূর্ণ হবে যাত্রা!"

এই ব্যাকুলতা ,এই অসহায় আর্তি--কিছুই আর ছুঁতে পারছিল না অনুকে কে যেন তাকে ডাকে? কোথায় যেন ঘন্টা বাজে? গর্জে ওঠে মন্ত্রধনি হোমের আগুন জ্বলে ওঠে সোনার পরী পাখা মেলে ধীরে ধীরে মস্ত বড়ো সেই পাখার আশ্রয়ে নিজেকে অনন্ত আকাশে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যেতে থাকে কোন সুদূরে


(
ছবি : গুগুল ) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন