সহজ কথা / তুষ্টি ভট্টাচার্য
ভারী শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা কবিতাকে আমি ছুঁতে পারি না। ফলে কবিতার ভেতরে যে ফুল ফুটে আছে, তার রূপ, রঙ, মোহ, গন্ধ আমার অধরাই থেকে যায়। আর আমার ভেতরে তখন এক অপরাধবোধ জেগে উঠতে দেখি। এ আমারই অক্ষমতা, আমারই সীমাবদ্ধতা। তাই নিজেকে দায়ী করি আর বলি, আমার মন, আমার বোধকে আরও জাগ্রত কর হে প্রভু। প্রভু অর্থাৎ আমি, আমার অন্তরের চালিকাশক্তি। যে আমাকে চালায়, আমাকে কবিতার কাছে নিয়ে যায়। আমি কবিতার কাছে গিয়ে আবার বসে পড়ি। পাথর চাপা কবিতাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করি। আর দেখি সেই কবিতার সবুজ এতদিন চাপা পড়ে থাকার ফলে কেমন হলদেটে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। অনেকখানি আলো বাতাস পেলে বোধহয় আবার ও সজীব হয়ে উঠবে।
এই ভেবে ওকে জল দিই, আলোর কাছে নিয়ে যাই, স্নেহের ছোঁয়াও দিয়ে ফেলি কিছুটা। ভাবি, একটু সময় দিই নাহয় ওকে মানে আমাকেই আর কী! আসলে তো আমারই সময় দরকার অনেকটা। আমিই তো না বুঝে বসে আছি। অবুঝ হয়ে বসে পড়েছি। আমারই তো সমস্যা। সহজের যে এক সোজা সুর রয়েছে, তার আবেদন অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে সহজের কাছে আমরা আগে এসে হাত পাতি। আর নিজেদের ঝুলি ভরিয়ে ফেলি সহজেই। অন্য সবার মত আমিও এই সহজে মজেছি। সহজ করে বলতে চাইছি। বলছিও হয়ত। কিন্তু বিঁধতে পারছি কি? একেকটা সহজ লাইন সোজা গিয়ে তিরের ফলার মত পাঠকের বুকে গেঁথে যাচ্ছে কি? নাকি পাঠকের চোখ ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে? এই সব প্রশ্ন নিয়ে আমার খুব মাথাব্যথা। তার তীব্রতা এতটাই যে আমি ছটফট করি ভেতরে ভেতরে।
সহজ করে বলা কি এতই সহজ আদৌ? সহজিয়া সুরের যে মায়ায় সাধারণকে বেঁধেছিলেন লালন, তার অর্থ উদ্ধার করা কি এতই সোজা? ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ – বলুন তো কে এই অচিন পাখি? আর কোন খাঁচার ভেতরেই বা যাচ্ছে আসছে? বা সরল রামপ্রসাদী গান? ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’ – এর অর্থ বোঝা কি খুব সহজ? চেতনাকে চৈতন্য দেওয়াও কি খুব সোজা? বাউল গানেরও যে অন্তর্নিহিত অর্থ তাও বোঝা খুব একটা সহজ নয়। বোঝার ক্ষমতা নির্ভর করে পাঠকের বুদ্ধি ও বিবেচনার ওপর। আবার সব পাঠকের যে সহজ ভাল লাগবে এমনও কথা নেই। লেখক লিখবেন তাঁর নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে, তাঁর অভিজ্ঞতা প্রকাশ করবেন তাঁর নিজস্ব শৈলীতে। এবার তিনি সহজ করে লিখবেন, না কঠিন, পুরোটাই তাঁর সিদ্ধান্ত। যেমন পাঠকেরও নিজস্ব সিদ্ধান্ত রয়েছে সহজ বা কঠিন পছন্দ করার। এই ব্যক্তিগত সংঘাতে না যাওয়াই ভাল। ‘ভাল’রও যেমন ছকে বাঁধা কোন সংজ্ঞা নেই। একজনের যা ভাল লাগবে, অন্যজনের তা তেমন ভাল নাও লাগতে পারে। কেউ স্বদেশ সেন পছন্দ করলেন তো কেউ পছন্দ করলেন শঙ্খ ঘোষ। কেউই ছোট না, কেউই বড় না। মাপ বলে কিছু হয় না লেখালেখির ক্ষেত্রে।
নিজের কথা বলতে গেলে সেই প্রথমের কথায় আবার ফিরে আসি। ভারী শব্দ, তৎসম শব্দের ব্যবহার আমি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলি। কথ্য ভাষার সঙ্গে লেখার ভাষার যে একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, আমি চাই সেই পার্থক্যটাকে মুছে দিতে। গদ্য এবং কবিতা – দুটোতেই। হয়ত অনেকেই বলবেন, এতে লেখার শৈল্পিক দিকটা বিঘ্নিত হতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষ করে এর ছন্দের যোগসূত্রে টান লাগতে পারে। অনেক আবার বলবেন, আটপৌরে ভাষায় কোন মতেই শিল্প হতে পারে না। এসব যুক্তিগুলো আমি মন দিয়ে শুনি, আর তর্কে না গিয়ে নিজেকে বলি, তাহলে আর বঙ্কিম ঘরানার লেখা বাতিল হত না। বঙ্কিম পরবর্তী লেখকদেরও অনেক কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছে। সেই আগের কথায় আবার ফিরে যাই। আমি আমার মতই লিখব। কারুর পছন্দ হবে, কারুর হবে না। এটা মেনে নিতে আমার কোন অসুবিধে হয় না। আর যেহেতু ফরমায়েশি লেখার বা কোন প্রতিষ্ঠানে বিকিয়ে যাওয়ার মত সৌভাগ্য আমার হয় নি, তাই লেখার জগতে আমার অবাধ স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা আমি ভীষণ উপভোগ করি। আমি যা লিখতে চাই, চেষ্টা করি আমার মত করে লেখার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজে সন্তুষ্ট হই না। অসম্ভব খুঁতখুঁতে একটা মন আমার লেখাকে নস্যাৎ করে দেয়। যা চাই, তা লিখতে পারি না। মনে হয় আরও কিছু যেন লেখার ছিল, আরও অন্যভাবে হয়ত লেখা যেত, বা যা লিখলাম, তা লিখতে চাই নি... এইসব আমার অতৃপ্তিকে ক্রমাগত তা দিতে থাকে। আর আবার কিছু লেখার জন্য প্রস্তুতি নিই।
সেই পাথর চাপা পড়া হলদেটে নিষ্প্রভ কবিতাগুলোর দিকে আবার একবার ফিরে তাকাই। দেখি ওরা আর ম্যাড়ম্যাড় করছে না। ওরাও ওদের আলোতে ফুটে উঠেছে। আসলে ওদের নিজস্ব আলো ছিলই। আমিই দেখতে পাই নি। সময় দিয়েছি কিছুটা, তাই নিজের চোখ খুলে গেছে। ওরা আর ভারী নেই। ওরা ওদের মত আছে, ওরাও সুন্দর, আমার থেকে আলাদা, ভীষণ আলাদা হয়ে আমার থেকে অনেক দূরে ফুটে উঠেছে। স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। আমাকে ওরা ছোট চোখে দেখলে দেখুক, আমার তাতে কোন অসম্মান হবে না, নিজের মান আমি নিজেই রাখতে জানি। আমি আমার মত লিখব – এই আমার সিদ্ধান্ত, এই আমার আত্মতৃপ্তি।
নিজের কথা বাদ দিয়ে যদি ভাষার প্রসঙ্গে আসি, যদি ভাবের প্রসঙ্গ আনি, অনেক কথাই এসে যাবে। ভাষা তো মনের ভাব প্রকাশই করে। এখন যদি ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা না থাকে, সেই আদিম যুগের মত, তখনও তো ভাব প্রকাশ করত মানুষ। আর এই মানুষই আবার ভাব প্রকাশের সুবিধের জন্য ভাষা তৈরি করেছে। প্রতিটি ভাষাই একটা নিয়ম অর্থাৎ ব্যকরণ মেনে চলবে , এমন হওয়াই স্বাভাবিক। নইলে ভাষার বাঁধুনি নষ্ট হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ভাষা কিন্তু একই ভাবে চলে না, তার ব্যকরণ বদলে যায় আপনা আপনি। কতগুলো উপাদান থাকে অবশ্য এই বদলের পিছনে। যেমন সংস্কৃতর থেকে দূরে সরতে গিয়ে আরও সরল হয়ে যাওয়া, অন্য ভাষার শব্দের ঠাঁই নেওয়া, নতুন নতুন কথ্য শব্দের জন্ম নেওয়া... এরকম অনেক কিছুই হতে পারে। ভাষা বদলালেও ভাব কিন্তু একই থাকে। ভাব প্রকাশের রূপ বদলায় মাত্র।
আর ভাষার ব্যবধান যেখানে থাকে, সেখানে কেবল চোখের ভাষা আর শরীরের ভাষাই ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। আবার এমনও হয়, হয়ত একই ভাষাভাষী, কিন্তু রাগ, অভিমান বা আনন্দ যাই হোক না কেন, মুখ ফুটে বলে ফেলল না একজন। অপরজন তা বলে কি সেই মনের ভাব ধরতে পারে না? নিশ্চই পারে। যদি একে অপরের কাছের মানুষ হন, বোঝাপড়া ঠিক থাকে নিজেদের মধ্যে, তাহলে সেই অনুচ্চারিত ভাষা বুঝতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হয়। একে অন্যকে আমরা এই অনুচ্চারেই প্রায়শ ভুল বুঝি। আর এখানেই ভাষার সার্থকতা। ভাষা সহায়ক মাত্র। যেন মনের মানেবই এক! এই মানেবই মুখস্থ করলে পরীক্ষায় পাশ করা যাবে ঠিকই, কিন্তু ভালো নম্বর পেতে গেলে মুখ ও মনের ভাষার ব্যবহার একসাথে করা দরকার।
ছবি : গুগুল
আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’ – এর অর্থ আপনার কি মনে হয়? জানতে ইচ্ছা রইল।
উত্তরমুছুন