বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

ফাল্গুনী ঘোষ

পঞ্চনদের দেশ- ২

   হরমন্দির সাহিব দেখে আসার পুলকে পরের দিন সকালে আরো পালক জুড়তে চলেছে—রাত্রে হোটেলের ডাইনিং হলে এই সংবাদটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। স্বর্ণমন্দিরের পাশের বাজারের ভিতর দিয়ে মিনিট দশেকের হাঁটাপথেই ইতিহাস বিজড়িত বহুশ্রুত ঘটনার আবাসস্থল জালিয়ানওয়ালাবাগ। আর অমৃতসর শহর থেকে পশ্চিমে ২৮ কিমি গেলেই ভারত পাকিস্থানের সীমান্তরেখা ওয়াগা বর্ডার। ভারতীয় হিসেবে গর্ব বোধ করার মতো জায়গা দুটি। রাত্রি থেকেই পরের সারাদিনের কথা ভেবে শিরায় শিরায় দ্বিগুন বেগে রক্তের প্রবাহ শুরু হয়ে গেল।
      রাত পুইয়ে সকালের রোদ উঠল যেন দেশভক্তির রঙে রাঙিয়ে। ভাবগভীর মুখ নিয়ে সবাই  জলখাবারের পর্ব সেরে গুটি গুটি পায়ে জালিয়ানওয়ালাবাগের দিকে এগোতে থাকলাম। সবার মুখের ভূগোল বলে দিচ্ছিল তারা ইতিহাসের পাতায় বিচরণ করতে শুরু করেছে। হোটেল থেকে হরমন্দির সাহিবের পথে গুরু মান্ডি বা গুরু বাজার—সেই বাজারের পাশ দিয়ে গেলেও কেউ দেখলাম মার্কেটিং-এ মন দিল না। পায়ে পায়ে দোকান বাজার পেরিয়ে চৌমাথার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাতেই ইতিহাস বই-এর পাতা থেকে যেন উঠে এল সেই জালিয়ানওয়ালাবাগ। ‘বাগ’ তো বাগান কিন্তু, আমার চোখ ততক্ষণে ভয়ানক ইতিহাসের সাক্ষ্য খুঁজে চলেছে। প্রাচীর ঘেরা উদ্যানের প্রতিটি ইঁটে সেই সাক্ষী, গুলির দাগ, নম্বরের খতিয়ান! তা দেখতে দেখতে কোথাও যেন হৃদয় ক্ষরিত হচ্ছিল। এই যে গুলির গভীর গর্ত ইঁটের গায়ে স্পর্শ করার আগে তা কত হৃদয়, পাঁজরা ভেদ করে মায়ের কোল শূণ্য করেছে সে ভাবতে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।


       কুয়োর মুখে জালবাঁধা গর্তের অন্ধকারে ঢিল আর গুলির আঘাতের দীর্ঘশ্বাস বুঝি এখনও কান পাতলে শোনা যায়। সে কারণেই হয়ত এই বাগের গাছ গাছালির মধ্যেও কাটছাঁট করে সেই ঘটনার দৃশ্য ফুটে ওঠে বন্দুকধারী বৃটিশ সৈনিকের আদলে। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিলকে বুকে ধারণ করে শহীদ স্মরণে সবসময় অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনে বাগের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে সর্বক্ষণ। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছিলাম এখানে ঘুরতে ঘুরতে কমবেশি বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই কথা বলার স্রোত হারিয়ে যাচ্ছিল। সুদূর পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েও কেমন যেন একটা নাড়ির টান অনুভব করলাম। আমাদের দলের সকলে বাগের ঘাস, ইঁট পাথরে মগ্ন হয়ে কোথাও না কোথাও বসে ছিল। দেখার পালা শেষ হয়ে গেলেও ইতিহাস অনুভবের পালা সহজে শেষ হয়নি।



      তবুও শেষ হতে হয়। ভাগ্যক্রমে সঙ্গীদের মধ্যে দু-চারটে বালক বালিকা, কিশোর কিশোরী ছিল। তাদের আইসক্রিম আর চকোলেট তৃষ্ণা আমাদের বাজারমুখী করল। জালিয়ানওয়ালাবাগ আর হরমন্দির সাহিবের মাঝামাঝি এলাকায় ‘হল’ বাজার, ‘গুরু’ বাজারে রাস্তার উপরে খুব সহজলভ্য জিনিসের পসরা। কি পাওয়া যায় না সেখানে! শিখদের ধর্মশাস্ত্রীয় নিশান—কৃপাণ, বালা’র বড় এবং ক্ষুদ্র সংস্করণ বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে পাঞ্জাবি নান কুলচার গন্ধ ভেসে আসছে! প্রাণ জুড়াতে আছে ‘কুলফা’। এই কুলচা আর কুলফা’র গল্পটি আপনাদের যথাসময়ে বলব। এখন মার্কেটিং-এর সময়। পাঞ্জাবি ‘জুতি’, পাতিয়ালা, ‘জাদাউ’(Jadau) এসব কিনে ব্যাগ ভর্তি না করলেই তো নয়! কথায় আছে ‘সখের প্রাণ গড়ের মাঠ’। পকেট না হয় গড়ের মাঠ হল, সখ তো হেলাফেলার নয়।
   সে ধরুন কলকাতা বা ছোটোখাটো মফস্বলেও আজকাল ‘পাতিয়ালি’ সেটের ছড়াছড়িকিন্তু না, না, ঐ কতগুলি ভাঁজবিশিষ্ট ঢোলা পা হলেই পাতিয়ালি নয়। পাতিয়ালার সেলাই শৈলীতে আপনার মনে হবে কাছা দিয়ে ধুতি পড়ে আছেন। আর পাঞ্জাবি ‘জুতি’, আহা সে যেন মাখন। এই ফুলকাটা, চুমকুড়ি কাজের জুতো পায়ে দিলে আর হাঁটতে ইচ্ছে করবে না! তাছাড়া পাঞ্জাবিরা শুকতলা ছাড়াই জুতো পড়ে। ওদের জুতোর শুকতলা খুইয়ে কিছু পেতে হয়না বোধহয়। জুতো কিনলেন কি ফাঁসলেন। তাল মিলিয়ে পোশাক আশাক, গয়না বাকি রাখলে এক্কেবারে বেমানান। তাছাড়া মেয়েরা গয়না, শাড়ি কিনবে না- এমন উলট পুরান ভারতীয় সংস্কৃতিতে হওয়া ঘোরতর অন্যায়। অসংখ্য, অজস্র মীনাকারী, ফুলকারি, পোলকি আর জাদাউ এর সম্ভার। আসলি, নকলি চিনে নেওয়ার ভার আপনার। মীনাকারী, ফুলকারি, পোলকি সম্পর্কে কমবেশি অনেকেই জানেন, তবে জাদাউ হল সবগুলি শিল্পের একত্রীকরণ। জাদাউ-এর মূল জায়গা শুনলাম রাজস্থান। মোগল আমল থেকে এই শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ। সে গয়নার চমকে দমকে আপনি পকেট ফাঁকা না করে পারবেন না।
   হোটেলে ফেরা, স্নান, খাওয়া এই পরবর্তী পর্বগুলি খুব দ্রুত সারতে হল কারণ ওয়াগা বর্ডারের বিশেষ ‘শো’টি বিকেল ৫.৩০/৬টায় অনুষ্ঠিত হলেও বসে দেখবার স্থান দখলদারির জন্য ৩.০০/৩.৩০ এর মধ্যেই রওয়ানা দিতে হল। চুয়াল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার হলকা উপেক্ষা করে আমাদের টাটাসুমো ছুটলো দেশভক্তির জোয়ারে। বর্ডার লাইন যত কাছে আসতে থাকল চেকিং-এর কড়াকড়ি নজর করার মত। মূল বর্ডারের বেশ কিছুক্ষণ আগে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল আর আমরাও জলের বোতল, ব্যাগব্যাগেজ গাড়িতে রেখে ছাতা বগলে পয়সাকড়ি হাতে নিয়ে চরণবাবুর ট্যক্সি ভরসা করলাম। অনবরত দ্বিভাষিক(ইংরাজি, হিন্দি)ঘোষণা চলছে সেই স্থানের নিষেধাজ্ঞা আর আচার আচরণ সম্পর্কে। শুধু পিলপিলে কালো মাথার ভিড়ে নজর করার মত খাকি পোশাক ও মাথায় লাল মোরগঝুঁটি টুপি মিলিটারিদের। কখনও বা ঘোড়ায় চড়ে দুলকি চালে চলেছে। আবার কৌতূহলী জনতার সাথে হাত মিলিয়ে সেলফিও উঠছে ঘোড়াসমেত।



    নাহ, অত আগে বেরিয়ে এসেও ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’। অগত্যা ইতিউতি চেয়ে দুচার কদম আগিয়ে পিছিয়ে মার্চ ফাস্ট করে তাল মেলাতে থাকলাম। হঠাৎ ‘বর্ডারকে উস পার সে সেনা আ রহা হ্যায়’- সমবেত জনতার বুককাঁপানো আওয়াজে চোখ মেলে দেখলাম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি আসন্ন প্রায়। গোল্লা পাকিয়ে দেখলাম দু-দেশের সৈন্যদের কৌশল, লম্ফঝম্ফ শেষ হল উভয়ের পতাকাকে সম্মান জানিয়ে। গরমে জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু থামা নেই দৌড় লাগাও। এমতাবস্থায় প্রাণে হিমের পরশ ছোয়াতে হাজির পাঞ্জাবি ‘কুলফা’। কুলফির উপর ফলকুচির সাথে সেদ্ধ নুডলস জড়িয়ে হ্রস্ব-ই কার বিদায় নিয়েছেন আর ‘আ’এসে আদর জমিয়ে কুলফা বানিয়ে তুলেছে। গরমে আরও একটু এনার্জি শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা। আরও আছে রাস্তার দুপাশে বাহারি হাতপাখার মেলা। আমাদের দেশ ঘরের তালপাতা পাখার মতো দেখতে হলেও তারের উপর পুরোটাই বাহারি উল দিয়ে হস্তশিল্প। হস্তশিল্প হস্তগত হল। গাড়িতে ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, মাত্র দু-দশদিনের জন্য বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়েছি, সে ফাঁকেই পাঞ্জাবের খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে মনে মনে মাপ করে নিচ্ছি জন্মস্থানের। অথচ এই জওয়ানরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা উপেক্ষা করে আমাদেরকে অবিরত নিরাপত্তা দিয়ে চলেছে নিজেদের বাড়ি ঘরের মায়া দূরে সরিয়ে রেখে। ভাবলে চোখে জ্বালা ধরে। আপাতত পঞ্চনদের পালা সাঙ্গ। রাতের ট্রেনে পাড়ি দেবো জম্মুর উদ্দেশ্যে।       



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন