বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

মানসী গাঙ্গুলী

#পরাজয়

      দুটি মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার সুমিত ও রত্নার।ভালবেসে বিয়ে করেছিল দু'জন,দু'বাড়ীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। ভাড়া বাড়ীতে সংসার পেতেছিল দু'জনে।বাড়ীওয়ালি মাসিমাই ছিলেন তখন অভিভাবক, রত্নার শাশুড়ীর মত।রান্না শেখানো থেকে সর্ব খুঁটিনাটি ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া,খুব ভাল বাসতেন ওদের দু'জনকে।নিজের সন্তান না থাকায় ওদের নিয়েই ছেলে বউয়ের সাধ মেটাতেন।রত্নাও নিজের শ্বশুর -শাশুড়ীর মতই শ্রদ্ধা ভক্তি করত ওনাদের।সুমিত ব্যাঙ্কের অফিসার,তাই আর্থিক অসুবিধা ছিল না কিন্তু বিয়েতে বাড়ীর বড়রা না থাকায় দু'জনেই খুব কষ্ট পেয়েছিল তবে স্নেহময়ী মাসীমাকে পেয়ে কষ্টের কিছুটা লাঘব হয়েছিল।
      বছর দুই পরে সুমিত একটা 2BHK নেয় যদিও একটু interior এ কারণ এর বেশী তখন সুমিতের ক্ষমতায় কুলায় নি।কত আনন্দ করে দু'জনে মিলে সংসার গোছায় সেখানে।মাসীমাও ক'দিন এসে থেকে সাহায্য করেছিলেন।মাঝেমধ্যে মাসীমা-মেসোমশাইকে আসতে বলত রত্না ও সুমিত।ওনারা ক'দিন করে থেকে যেতেন তখন।রত্না যথাসম্ভব আদর যত্ন করত।কিন্তু কিছুটা দূরত্ব হওয়ায় আর বয়সজনিত কারণে আসাযাওয়া সম্ভব হত না তাঁদের।এরপর ক্রমে দুই সন্তান এলো ওদের ঘর আলো করে।ফুটফুটে দুটি মিষ্টি মেয়ে।সুখের সংসার।সুমিত মেয়েদের বড় স্কুলে ভর্তি করেছে,গাড়ী কিনেছে।হাসিখুশি আনন্দের জোয়ারে ভাসছে যখন,দুর্যোগ নেমে এল ওদের জীবনে।ব্যাঙ্কে কাজের সময় ব্যস্ত অবস্থায় একটা কাগজ ভাল করে না দেখে, না পড়ে সই করে দেওয়ায় প্রচুর টাকা তছরূপের কেসে ফেঁসে যায় সুমিত,যা থেকে মুক্তি পাবার মত কোনো প্রমাণ যোগাড় করতে না পেরে চাকরীটা খোয়াতে হয় এবং জেলও হয়।যদিও কিছু শুভানুধ্যায়ী ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন সুমিত এমন কাজ করতে পারে না কিন্তু প্রমাণাভাবে তাদের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয় না।খবরের কাগজে এই সংবাদটি পড়ে মেসোমশাই এসেছিলেন দেখা করতে,কিছু আর্থিক সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রত্না জানে ওনাদের ভাড়ার টাকায় ও পেনশনের সামান্য কিছু টাকায় সংসার চলে,তাই বলে প্রয়োজন নেই,প্রয়োজন পড়লে নিশ্চই জানাবে তাও বলে।এ হল কথার কথা,মেসোমশাইও বুঝলেন কিন্তু ওনার আর কিই বা করার ছিল।
       একটা সুন্দর, সুখের সংসার তছনছ হয়ে যায়।বড় মেয়েটা তখন ক্লাস 9 ছোট 3।রত্নার পক্ষে তাদের আর বড় স্কুলে পড়ানো সম্ভব হয় না,তাছাড়া পথেঘাটে চলাফেরা দায় হয়ে উঠেছে,চেনা পরিচিতের মাঝে ওরা তখন আলোচনার বিষয়বস্তু, মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।খুবই অভাবের মধ্যে পড়তে হয় ওদের।রত্না খুব গুণী মেয়ে,নানারকম কাজ জানে,তাই এটাসেটা করে কোনোরকমে সংসার চালায় আর জেলে গিয়ে সুমিতের সাথে দেখা করে।সুমিত রোজ রোজ ওকে জেলে যেতে বারণ করে,মেয়েদের সামলে নিয়ে থাকতে বলে আর তাছাড়া রোজ যাতায়াতে যে গাড়ীভাড়া লাগবে সেটাই বা জুটবে কোথা থেকে তাই।নিজে সে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।নিজের ক্যালাসনেসের জন্য নিজেকে ওর শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু রত্নার কথা ভেবে অসহায় মেয়েদুটোর মুখ মনে করে সংযত থাকে।
      বড় মেয়ে মণি টিউশন খোঁজে কিন্তু ওদের কাছে কেউ বাচ্চাকে পড়াতে দিতে চায় না।এত প্রতিবন্ধকতা মাথায় করে মণি ভাল স্টুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কোনোরকমে খুবই নিম্নমানের result নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে।হাসিখুশি মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।কেবল চেষ্টা করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে আর বোনের গায়ে যেন আঁচ না পড়ে।মাত্র ১৮ বছর বয়সে মণি একজন পরিণত মহিলায় পরিণত হল।
        কোনোরকমে কলেজে ভর্তি হতে পারল কিন্তু আর যে চলে না,নুন ভাত,ফ্যান ভাত খেয়ে,পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে।রত্নাও ঘরের সব কাজ একাই করে যা ওর কোনোদিন অভ্যেস ছিল না।এই সুযোগে অল্পপরিচিত এক মহিলা কদিন ধরে ওর সাথে খুব আলাপ জমায় আর বুঝিয়েসুঝিয়ে ওকে নোংরা পথে নিয়ে যায়।মণি প্রথমে রাজী হয় না কিন্ত মহিলা বোঝায়,কলেজের পরে অনেক মেয়েই এভাবে রোজগার করে সংসার চালায়।মণিও আর বাঁঁচার আর পথ খুঁজে না পেয়ে একপ্রকার রাজী হয়ে যায়।মহিলাই সঙ্গে করে ওকে নিয়ে যায়।মণি বুঝতে পারে মহিলাটি দালাল, এভাবেই মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কুপথে নামিয়ে এরা রোজগার করে।প্রথমদিন বাড়ী ফিরে বাথরুমে ঢুকে খুব কেঁদেছিল মণি,সারাশরীর জল ঢেলে ধুয়ে পবিত্র করার বৃথা চেষ্টা করেছিল।পরে এটাই দস্তুর হয়ে গেলো। মা জিজ্ঞেস করলে বলে কলেজের পরে টিউশন করে আস্তে রাত হয়ে যায়।সংসার একটু সচ্ছলতার মুখ দেখে আর চোখের জল মণির নিত্য সঙ্গী হয়।এরই মাঝে সুমিত ছাড়া পায় জেল থেকে।এই ক'বছরে যেন কত বুড়ো হয়ে গেছে,মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল,খোঁচা খোঁচা দাড়ি,গোঁফ পাকা,বিধ্বস্ত চেহারা।
      বাড়ী ফিরে সুমিত চারিদিকে চেষ্টা করে যদি কিছু কাজ পায়,কিন্তু না, কোথাও কিছু জোগাড় করতে পারে না।রত্না একবার বলেছিল,পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু সুমিত কোনো কথার উত্তর দেয় না,কেমন যেন হয়ে গেছে সুমিত,বাড়ীতে কারো সাথে কথা বলে না।বউ মেয়ে কারো মুখের দিকে তাকায় না,ওদের ধারেকাছেও ঘেঁসে না।ওদের কাছে সুমিতের নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।দিনে দিনে সুমিত অবসাদের শিকার হয়ে উঠছে।মনের দুঃখে যেখান সেখান চলে যায়,নদীর ধারে বসে থাকে।এভাবে চলতে চলতে একজনের সাথে আলাপ হয় যে তাকে বাড়ী থেকে বেশ দূরে একটা দোকানে সামান্য মাইনের বিনিময়ে খাতা লেখার কাজ দেখে দেয়।এতই সামান্য যে সুমিতের বাড়ীতে বলতে লজ্জা করে।দেখে,বউ মেয়ে উদয়াস্ত এত পরিশ্রম করছে,সুমিত সর্বদা নিজেকে দায়ী করে আর তাই ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারে না।এভাবে অবসাদে ক্ষয়ে যেতে যেতে মদ খেয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে।প্রথ যেদিন মদ খেয়ে বাড়ী এল,রত্না চমকে উঠল,না জানি আরো কত কি অপেক্ষা করছে তার জন্য।আগে সুমিত কখনো মদ ছুঁতো না,পছন্দই করত না।বন্ধুবান্ধব কখনো একসাথে আনন্দ করার সময়,সবাই একটু আধটু মদ খেলেও সুমিত মোটে ছুঁতো না।রত্না সব দেখছে,সব বুঝছে তবু মুখ বুজে সব শ্য করে চলেছে,সহ্য করাটা এখন তার অভ্যেস হয়ে গেছে।কেবল আশায় আশায় থাকে যদি ওর সুমতি হয়।
      ক্রমে সুমিত প্রায়ই নেশা করে বাড়ী ফিরত,বাড়ীতে কিছু বলত না সারাদিন কোথায় থাকে,কি করে।রত্নাও ওর মানসিক অবস্থা দেখে ওকে বিশেষ ঘাঁটায় না।মানুষটা বাড়ী এসেছে এটাই যথেষ্ট। দুটো মেয়ে নিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিল বড়,তাই সুমিত ফিরে আসায় রত্না খানিকটা নিশ্চিন্ত। ও তো আর জানে না,মেয়েরা বড় হচ্ছে বলে যে এত চিন্তা,সেই বড় মেয়ে মণি কোন পথে চলাফেরা করছে।সুমিতের বাড়ী ফিরতে রাত হয় আজকাল,বাড়ীতে খায়ও না,রত্না তাও কিছু জিজ্ঞেস করে না।কোনোভাবেই বাড়ীতে যেন কোনো অশান্তি না হয় তাই সব হজম করে মুখ বুজে,কিন্তু এ যে আর বাড়ী নেই শ্মশানপুরী হয়ে গেছে,নিস্তব্ধ, হাসি নেই হুল্লোড় নেই,গল্পগুজব নেই।ছোট মেয়ে রিনি বড় হয়ে উঠছে,মণি যথাসাধ্য চেষ্টা করে বোনের পড়াশুনোটা যাতে ভাল হয়।বোনকে টিউশন দিয়েছে যা ও পায়নি।মনেপ্রাণে চায় বোনটা ভালভাবে মানুষ হোক,নিজে তো ধ্বংস হয়েই গেছে।কচি মনটা ওর কঠোর হয়ে গেছে,ভাবে নিজের যা হয় হোক,মা-বাবা-বোন যেন ভাল থাকে।
        কিন্তু ভাল থাকাটাও যে ভাগ্যে থাকা চাই,চাইলেই ভাল থাকা যায় না,বেচারী মণি তা আর জানবে কি করে,হাজার হোক ছেলেমানুষ। জীবনযুদ্ধে তার এতবড় লড়াই,নিজেকে তিলেতিলে শেষ করে দিয়েও বুঝি হেরে যায় জীবনের কাছে।কলেজ শেষে রোজের মত বেরিয়ে পড়ে মণি রোজগারের ধান্দায়।অন্ধকার ঘরে অপেক্ষায় থাকে খদ্দেরের,রোজ যেমন থাকে।আজকের মানুষটাকে তার মনে হয় যেন অতিমাত্রায় কামুক, কিছুতেই যেন তার আশ মেটে না।বহুকাল খেতে না পেলে মানুষ যেভাবে খায়,এ যেন সেইরকম। তৃপ্তি যেন আর হয় না তার,ছাড়তেই চায় না কিছুতে।মণি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে,রাত বাড়ছে,অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে,মা চিন্তা করবে।অবশেষে নিজেকে নিংড়ে শেষ করে দেবার পর যখন টাকার লেনদেন হয়, রোজের মত ঘরের আলো জ্বালিয়েই মণি আর্তনাদ করে ওঠে দু'হাতে মুখ ঢেকে "নাআআআআ" করে।আর লোকটি দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
          যে মহিলা মেয়েদের দিয়ে এইসব কাজ করাত সে শুনতে পায় এই আওয়াজ কিন্তু অন্য ঘরে লোক পাঠানোয় ব্যস্ত থাকায় আসতে একটু দেরী হয়ে যায়।মণির ঘরের দরজা ঠেসানো ছিল।দরজা ঠেলতেই খুলে যায়,দেখে মণি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে ফ্যান থেকে।ততক্ষণে শেষ,তার জিভ বেরিয়ে আছে।
       আর কিছুদূরে রেললাইনে পাওয়া যায় সুমিতের মৃতদেহ।অনুতাপে,অবসাদে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সুমিত ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে আর সেদিনই প্রথমদিন, যেদিন ওর যৌনক্ষুধা তীব্র হয়ে উঠেছিল,ও কোনো মেয়ের সংস্পর্শ ভোগ করতে চেয়েছিল কারণ রত্নার কাছে এগোতে ওর লজ্জা করে।কিন্তু দীর্ঘদিনের বুভুক্ষু শরীর যেন কিছুতে বাধ মানছিল না,পেতে চাইছিল নারী সঙ্গ।তার জন্য যে এমন মূল্য দিতে হবে, ভাবেনি সুমিত।
     ভাবে নি মণিও,জীবনযুদ্ধে এমন চূড়ান্ত পরাজয় তার হবে।

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন