বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

শাপলা সপর্যিতা



গুরু (পর্ব-৪)
এরই মাঝে ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দেব। সবাই পড়াশোনা করে। আমি করিনা।আমি অংকে কাঁচা। ঘরে বাবা বড় ভাইরা সব অংকের পন্ডিত। দারুন দারুন রেজাল্ট। বড় ভাই বোর্ডে তখন স্ট্যান্ড করে ফেলল।স্কলারশীপ নিয়ে প্যাটরিস লুমুম্বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং।মেঝো ভাই এপ্লাইড ফিজিক্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।সেজোভাই দূদান্ত রেজাল্ট করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি অংকে কাঁচা। এও হয়? হতে পারে? পারে। কারন আমি প্র্যাকটিস করিনা। ঘরের বাপ ভাই দিয়ে হবেনা। লাগবে গৃহশিক্ষক।মা নিয়ে আসলেন শিশিরদা’কে।তিনি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আমি দারুন মনোযোগ দিয়ে তার কাছে অংক পড়ি। সত্যি এবার আর গৃহশিক্ষকের প্রতি আমার কোন অভিযোগ বা বিতৃষ্ণা নেই। কারন আমি প্রেমে পড়েছি। হ্যা প্রথম ধ্বংশযজ্ঞ। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্রাশ ‘ফার্ষ্ট ক্রাশ।’ শিশির’দা পড়ান আর আমি মুগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে চেয়ে থাকি। যা বলেন তাতেই ভালোলাগে। গ্রামের ছেলে। হিন্দু উচ্চ ব্বংশীয় ব্রা্হ্মণ।পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অসাধারণ সব গল্প করেন। গল্প বলেন- তার ছেলেবেলার। কি করে মাছ ধরতেন পুকুরে।গ্রামে গেলে কি করে ধানের ক্ষেতে আজও নিড়ানী দেন।এই এদো আর হাজার গলির শহরে আমার সেই বন পাহাড়ের লালমাইর গল্পের মতো যেন তার গল্প।শহরের আরও দশটা ছেলের মতো তেমন কিছুইতিনি নন।লিকলিকে শ্যামলা চেহারার একহারা গড়ন। মাঝারি তার উচ্চতা। দেখে মুগ্ধ হবার মতো একেবারেই কিছু নন। অন্য অনেক স্মার্ট ছেলেরা আমার কথা কি ভাবছে তা ভাববার মতো সময় তখন আমার নেই। শিশিরদা নিরাসক্ত। আমি মুগ্ধ। মুগ্ধ আমি একজন গাঁয়ের ছেলের অসাধারণ সাধারনতায়। আমি প্রথম প্রেমে পড়লাম।আমার দিনরাত শুধু মোহনীয় আবেশে জড়ানো। তিনি পড়াতে পড়াতে যখন আমার দিকে একবার তাকান আমার সদ্য কৈশোর উর্ত্তীণ মন জানে, তিনি ঠিক পড়ে ফেলছেন আমার মন। জেনে ফেলছেন আমার ভেতর। আমি চোখ নীচু করে অমনোযোগে পড়ায় মন দেবার চেষ্টা করি।বয়স কতই আর।অবদমন তখন ভীষণ কঠিণ বিষয়। খুব গোপনে চিঠি লিখি একদিন। এবং যথারীতি মার কাছে ধরা পড়ি। চিঠিটি আর তার হাতে পৌঁছায় না।অংকেও আমার আর ভালো করা হয়না।ফিজিক্স ক্যামিষ্ট্রি বায়োলজিতে ৮৫ ৮২ ৮৮ নম্বর নিয়ে অংকে কোনমতে পাশ করি। অংকে পাশ করি স্ট্যাটিক্স ডিনামিক্সের উপপাদ্য দিয়ে কোনোমতে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করি।আমার রেজাল্ট দেখে আমার মা কাঁদেন। অংকে যদি ভালো করতাম তাহলে আমি কত ভালো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতাম সেই আক্ষেপ আমার মায়ের রয়ে গেল সারাজীবন। আর প্রথম ধ্বংসাত্বক অনুভব সত্যি সব কিছু ধ্বং করে কোথায় যেন চির অমলিন এক বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেল। শিশিরে প্রদীপ। বহুদিন জ্বলছিলেন তিনি আমার মনের আকাশে। পড়ে ছিলেন আলসে শরীর বিছিয়ে মনের সবুজ ঘাসে শিউলীর ঘ্রাণে। অনেকদিন অনেক বছর আর তার কোন খবর পাইনা। ২৪ বছর পর এই সেদিন খবর পেলাম নিভেছে সে প্রদীপ। সত্যি সত্যি ক্রাশ হয়ে গেছেন।কোন এক শ্মসান ঘাটে। গভীর বিষাদে বিশুদ্ধ প্রথম প্রেমের স্থির নিশ্চল আবেগে এখনো এতটা জড়িয়ে আছেন তিনি মনোবেদনায় তার মৃত্যু আমাকে জানিয়ে গেছে। তিনি আমার গুরু.......(চলবে)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন