বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

জয়তী রায়


ভালোবাসা ভগবান এবং ভূত
-----------------------------
        
-------------------------------
  ভূত আমি বিশ্বাস করি। বিশেষ করেই বিশ্বাস করি। তাই ভূত মোটেও গল্প নয় আমার কাছে। আমাকে যদি কেউ বলে ভূতের গল্প লেখো, খুব রাগ হয় আমার। ভূত হলেই বুঝি কেবল গল্প হবে? আচ্ছা, এই যে, সবাই মন্দিরে মসজিদে হাত জোড় করে আছে, তাই বলে কি  ভগবান কে দেখেছো? ভগবানের গল্প বলে কেউ? কেবল ভূতের বেলা যত অদ্ভুতুড়ে আবদার
      এই তো সেদিনের কথা, গত শনিবার, স্বপ্নার বাড়ি গেলাম। মধ্যমগ্রামে বাড়ি। খাওয়া  দাওয়া , জম্পেশ সাহিত্য আড্ডা দিয়ে রাত দশটার ট্রেন দলে সঙ্গে জনা আট লোক। চিন্তা কি? কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা। সবাই যে যার মতো জায়গা করে বসে আবার গুলতানি। কোনের দিকে একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিমোচ্ছিলো , আমাদের হাউ মাউ শুনে খুব বিরক্ত হয়ে গলা খাঁকারি দিল দুবার। ট্রেন যাচ্ছে হুড় হুড় করে। চুপ করে থাকা যায়? লোকটা বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। গেল তো গেল। আমাদের ভারি বয়েই গেল। কিন্তু হঠাৎ সব চুপ হয়ে গেলাম। দরজার দিকে যাওয়া লোকটা কই? হু হু করে হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। কামরার প্রান্ত থেকে প্রান্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার কেউ নেই
  উফফ! প্রশ্ন চোখে তাকান কেন? ভূতের গায়ে চাদর? আর হঠাৎ ভূত আসবেই বা কেন ট্রেনের কামরায়? জানি না এত উত্তর আমি দেব না। আপনার দরকার হলে ট্রেনে আরো যারা ছিলো,  জিজ্ঞেস করুন গিয়ে তাদের
     তবে, ওই ঘন্টা ঘরের কেস শুনলে কি বলবেন আপনারা? যারা মরীয়া হয়ে প্রমাণ করতে চান ,ভূত বলে কিস্যু নেই, এদিকে ছোট বাইরে যাবার সময় বউ কে পায়ে ধরতে বাকি
 সাহেব আমলের পুরোনো ঘন্টা ঘর। রাত দুটোয় ঢং ঢং বাজবেই ঘন্টা। রাত দুটোর সময়  কে তদন্ত করবে বাবা? তারপর দু চারবার বেজে বেচারা ঘন্টা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে আর মাথা কে ঘামায়? শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, যদি না রজব আলীর ছেলেটার মৃতদেহ ওই ঘন্টার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যেত। কেন? কি হয়েছিল ? সে তো এক রহস্য
     ছেলেটা  বাবার সঙ্গে মাছের ব্যবসা করতো আর মাঝে মাঝে বাইক চড়ে বন্ধুদের সঙ্গে এদিক ওদিক  চ্যাংড়া পনা। উঠতি বয়েসে যেমন হয় আর কি!  ঘটনার পরে, চেপে ধরতে ফ্যাকাশে গলায় বন্ধুরা বললো, তাদের মধ্যে বাজি হয়েছিল, যে  রাত দুটোর সময় যে যেতে পারবে ঘন্টা ঘর, এবারের ঈদে তার   বিরিয়ানী ফ্রী।  শেষ পর্যন্ত কেউই গেলনা, ওই ছেলেই গেল কেবল! অনেক ক্ষণ বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যায় সকলে। বাড়ির লোক জানতো, রাতে বন্ধুর বাড়ি থাকবে।  তারপরে তো  ঘন্টার সঙ্গে ঝুলন্ত মৃতদেহ মিললো পরের দিন সকালে
     এরপরেও  রাত দুটোয় ঘন্টা বাজলে আমরা ভয় পাবো না?  হাওয়া বাতাস ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দেব?
  নাঃ মশাইরা। ভূতের কোনো গল্প হয়না। ভূত আমার আপনার মতোই সত্যি। তাকে গল্প বলে অপমান আমি অন্ততঃ করতে পারবো না। রাসু দিদিমা রোজ ভূত দেখতেন। রাতে দুধ সাবু খেয়ে বাটি ধুতে কলতলায়, গিয়ে চেঁচান-- এই ক্যারে? ক্যাডা রে? আবার আইছস? সে বাইচ্যা থাকলে আইতে পারতি? গু খোরের ব্যাটা। পালা পালা !’
    আবার একদিন--’ তোরে মাইরাই ফালাম। গতরখাগী , মোর পোলাটারে ফাঁসাইয়া নিজে গলায় দড়ি দিলি? মুখ দেখানের উপায় রাখস নাই। আবার অহি হানে রোজ খাড়াস ক্যান? কি চাস? ‘
  প্রতিটি ভূতের সঙ্গে একটা করে দারুণ গল্প। আর এই একতরফা সংলাপ হতো রোজ রাতে দুধ সাবু খাবার পরে কলতলায়। বাটি  মাজা হয়ে, কুলকুচি সেরে, ভেজা পায়ে বারান্দায় উঠে আসতেন দিদিমা। দিদি তখন খুব ছোট। আমার জন্মই হয়নি। হ্যারিকেনের কাঁপা আলোয়,  রাসু দিদিমার নস্যির গন্ধ ওয়ালা কাঁথার তলায় শুয়ে দাদা দিদি মামা মাসি ভূতেদের কান্ড শুনতো। বউয়ের জ্বালায় বিবাগী বড় মামার কথা বলতেন, সেই মামী গলায় দড়ি দিয়ে মরে পেত্নী হয়ে, রোজ আসে কলতলায়। আর একটা ভূত টাকা ধার নিয়ে ফেরৎ দেয়নি। নৌকা ডুবি হয়ে মারা যায়। সে নাকি খুব লোভী বজ্জাত লোক ছিল। মরার পরেও এটা ওটা বাগানোর চেষ্টায় চলে আসে কলতলায়
  যুক্তি খুঁজবেন না মশাইরা। তাহলে তো বলতে হয় দিদিমা মিথ্যেবাদী। যা আপনারা দেখতে পাবেন না, তাই যদি মিথ্যে হয়, তবে চাঁদে গেছেন কখনো ? তব্বে?
  ওতো দূরে যাবার দরকার কি? এই তো সেদিনের কথা। মাঝরাতে জল খেতে উঠেছি, ঘুমচোখে দেখি ,আবছা কি একটা ঘুরে যাচ্ছে। চোখ মুছে তাকালাম , ঘরে কি ঘুরছে। জল খাওয়া মাথায় উঠলো, চাদর মাথা অব্দি মুড়ি দিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পড়লাম অবিশ্যি। আমার ব্যাপারে কোনো কথা কেউ শুনবে না জানি। সবাই জানে আমি বিশ্ব ভীতু। আসলে আমি তেনাদের সম্মান করি। শ্রদ্ধা করি
  দেখুন যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তেনাদের স্ট্যাটাস বদলে গেছে। এখন ভূত দেখতে হলে, শপিং মল, ঝাঁ চক চক করছে সব কিছু, তিনি সেখানেও আছেন। খুব নিঃশব্দে দেখছেন আপনাকে ফিটিংস রুমের নিরাপত্তায় নিজেকে খুলে ফেলছেন হয়তো, কোন ক্যামেরা আপনার ছবি তুলে যাচ্ছে, টের পেলেন না। অবশ্য মানুষ।  অতি বজ্জাত , নোংরা চরিত্রের মানুষদের ভূত বলে গালি দেওয়া যাবে না কিছুতেই
  তবে, এক্সলেটরে শাড়ী আটকে আমার শ্বাশুড়ী পড়ে যাচ্ছিলেন যখন, তখন কে যেন তাকে পেছন থেকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো। তিনি দর দর করে ঘেমে নেয়ে মাটিতে নেমে ভগবানের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করলেন। কিন্তু ভূত না ভগবান কে বাঁচালো , গ্যারান্টি আছে কিছু?
  লোক কম এমন সিনেমা হলে গিয়ে দেখুন একবার। আপনার পাশে বসে পায়ের উপর পা তুলে তিনিও আরামে সিনেমা দেখছেন , বুঝতে পারবেন। মাথার চুল আপনার খাড়া হয়ে উঠলেও কিছু করার নেই। কে জানে? মারা যাবার আগে ওনার ওই সিনেমা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল কি না?
    সব ব্যাপারে তক্ক করতে নেই মশাইরা।  তর্ক অনেক সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কি দরকার সেধে সেধে দরজা খুলে বিপদকে ডেকে বসতে দেবার? তার চেয়ে যা জানেন না, তার জন্য প্রমাণ চাই, প্রমাণ চাই -- বলে গলা ফাটাবেন না শুনুন, ভালোবাসা , ভগবান আর ভূত ---কোনো প্রমাণের পরোয়া করে না
    বাবুর কথাটা এই ফাঁকে বলে নি। দশ বছরের অতি বাধ্য ছেলে। বাবার খুব ন্যাওটা। রোজ বাবার সঙ্গে সাইকেল চেপে স্কুল যেত। একদিন এক মাতাল লরি ওয়ালা উড়িয়ে দিলো বাবুকে আকাশের দিকে। বাবা বেঁচে গেলেন। গভীর শোকে সাময়িক পাথর হয়ে গেলেও, সকলের অবাক চোখের সামনে দিয়ে বাবা দ্রুত স্বাভাবিক হতে লাগলো। মৃদু হাসি লেগে থাকতো মুখে। ওনার স্ত্রী লক্ষ্য করতেন বাবুর বাবা কথা বলেন বাবুর সঙ্গে--
‘  বকিসনি বাপ। ওষুধ খাবো। তোর মার প্রেসার ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। আমি একদম ভালো আছি। তোর বন্ধুরা? তারাও বেশ আছে রে। সেদিন জিজ্ঞেস করলো তোর কথা , বললুম বাবু খুব ভালো আছে। কি বললি? বলবোনা তোর কথা?  পাগল ভাববে আমাকে? ভাবুক! আমি কিন্তু খুব ভালো আছি রে বাপ। অফিসে কাজ করছি মন দিয়ে। মরেই যেতাম বাবু, দেখা দিয়ে  তুই আমার প্রাণ বাঁচালি। ভাবছি তোর মা কে নিয়ে এই ছুটিতে হরিদ্বার যাই। কি বলিস বাবু?’
    খালি ঘরে একলা কথা বলে যেতেই থাকেন বাবুর বাবা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ মোছেন মা। বিজ্ঞানে অনেক ব্যাখ্যা হয়। দরকার কি? একটা মানুষ বিশ্বাস করে নতুন জীবন ফিরে পেল, সেটাই থাকুক না হয়। ওই যে বললাম
  ভালোবাসা ভগবান আর ভূত -- এই তিন বস্তু দেখা যায় না, ছোয়াঁ যায়না, শুধু অনুভব করা যায়। কাজেই নিয়ে তর্ক করে সময় নষ্ট করে হবে কি বলুন? যুক্তি তর্ক শিকেয় তুলে আপনি বরং লক্ষ্য করুন, পাশে যে বসে আছে, সে আপনার জানা মানুষটি তো না কি অন্য কেউ?


ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার :Cesar Legaspi

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন