বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

ঈশানী বসাক

শুদ্ধতা

এক

ঠিক করে কাঁটাচামচে বিঁধে ফেলা মাংসের টুকরো টা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে। প্লেটটা এসব বহুদিন দেখে কিন্তু রোজকার এই খাদ্যাভ্যাসের দৃশ্য সতত তার ক্ষুধার জ্বালা কে এড়াতে শিখিয়েছে। যতটা সম্ভব রাসায়6নিক সারযুক্ত তারিখ লিখে যে খাবার সুসজ্জিত সুস্থতা নিয়ে বসে তাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় রক্তচাপের মাপ কত ? থ্রিলারের মত খাবার সরে যেতে যেতে মন্ডপে পড়ে থাকে পায়ের ছাপ , বসে থাকা মানুষের চাপে কুঁচকে যাওয়া চেয়ারের কাপড়। এসব একটু ঠিক করে নিলেই বুঝবে যে আর কেউ জানতে পারবে না এখানে পুজো হয়েছিল। একটা খুনের মত নিঁখুত উধাও হয়ে যাওয়াটা কার্যপ্রসাধনী।
 

দুই

যারা ঘরময় টেলিফোনকে অপেক্ষা করিয়ে বসিয়ে রেখেছে তাদের পুজোর সময় নেই। রাতদিন মনে রাখতেই হিমসিম হতে হতে একটা ফোন আসে এবং শেষটা ঠিক বিরক্ত কোরোনা মা ভারতে আসছি না এটা বলেই চুপ। আবার অপেক্ষা করতে করতে যে বেড়ালটাকে খাবার দিচ্ছেন ওনারা তারা জানেন যে পাশের বাড়িতে খাবার বলতে টকে যাওয়া ভাত। যেদিন আত্মহত্যার গল্প ঘরের মেঝেতে ভেসে আসলো সেদিন চেঁচিয়ে পাশের বাড়িতে বিড়ালটা চলে গেলেই ওরা খাবার দিলো ভালোই। ওদের সেদিন অনুষ্ঠান। চুপ করে খেতে খেতে বিড়ালটা তাকালো। মৃত্যুটা ও সাথে করে নিয়ে বসেছিলো।
 

তিন

পা থেকে প্রণাম চলে যাচ্ছে ছোটো ছোটো ছোঁয়ায়। আর না করতে করতে কোথায় না বলার আশাতেই বিজয়া করতে চলেছে কতজন। একটা ছোটো কবর থেকে যে নমাজ পাঠ হচ্ছে তাকে দেখতে দেখতে মনে হয় কেউ চলে যেতে চায় বলেই চিৎকার ফেরায়।শুদ্ধতা লুকিয়ে থাকছে বিষাদেই।

ঈশানী বসাক
 



রঙ


এক

ছোট থেকে এক একটা রঙের প্রতি আমাদের এক একটা ধারণা জন্মায়। অক্ষরজ্ঞান পূর্বেই সে সব রঙের প্রতি পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দের দাবি বসতি গড়ে তোলে। শৈশবে হাসি , রাগ, ঝগড়া সবেরই এক ভঙ্গিমা ছিল , তার নাম কান্না। অত পরিমাণ কান্না জমেছে বলেই হয়তো বয়স বাড়লে দুঃখ পেলেও জল আসে না, ক্লান্তি বাড়লেও ঘুম আসে না। দিন রাতের ঘূর্ণণের হিসেব সঠিক সবসময়। মানুষ ছাড়া বাকি সমস্ত জীবন এমনকি এ বাসভূমির কখনো অঙ্কে ভুল হয়নি।

দুই

এই রঙের সঙ্গে আশৈশব ধারণা নামক একটি শব্দের সম্যক সম্পর্ক। গোলাপী রঙ বলতে যে বিষ এটা কেমন করে জানি বদ্ধমূল শিকড়ের সন্ধান দিচ্ছিল। নীল বড় ভয়ঙ্কর নীরব। নীল দেখলেই কেন জানি আমার বনের মধ্যে হারিয়ে যাবার দৃশ্য ভেসে উঠত। অথচ গাছের তো সবুজ রঙের। এই ঠিক এখানেই ধারণার অবতরণ। জেনেশুনে অভিমান আর জ্ঞানপাপী হওয়ার হাতেখড়ি।

তিন

প্রতিমা সেজেগুজে মন্ডপে আসলে বড় খুঁতখুঁত করে মন। শিল্পীর কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই প্রতিমার মুখে রাগ , হাসি কিভাবে ফুটিয়ে তোলেন ? উত্তর আসে অনুভব তো হাতে নেই বাবা। তবে মানুষ সবকিছুই সৃষ্টি করতে ভালবাসে। তাই খানিক অহংকার , হাসি , কান্না দিলাম মূর্তিকে। মাংস কে জীবনভর রক্ত জমা দেওয়ার ঋণ বুঝি একেই বলে।

চার

তোমাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম ভেবে বলো দেখি ঠিক কাকে প্রথম নগ্ন দেখেছিলে নিজেকে ছাড়া। তুমি বলেছিলে এক বালিকার কথা ঘাটের কাছে বহুদূর থেকে। আমি বলেছিলাম মিথ্যা। কেন জানো ? এই মন্ডপে যে তিন মাস নগ্ন দেহে মা দাঁড়িয়ে থাকেন রঙহীন হয়ে তখন দিনের পরদিন তাকে দেখেছি। কই মাকে দেখে তো কখনো লজ্জা হয়নি ?
 

পাঁচ
 

ছোটো থেকেই ছোটো গাছ দেখলে তার ঝাঁকড়া পাতা দেখলেই ভয় করে। মনে হয় এ শরীরে প্রথম ধুরন্ধর ছোঁয়া তার ই। এসব পাগলামো বললে বাড়িতে আমি বড় গাছের গুঁড়িতে বসতাম। সেখানে যে কোল আঁকা তাকে মানতের মতো এক গভীর আত্মবিশ্বাস বহন করতে দেখতাম। এইসব সুতোর প্যাঁচে যুঝতো ভবিষ্যত। আর সর্বক্ষণ সবুজ দেখলেই মনে হয় পরম মমতায় প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গল অথচ তবু অভদ্র এক লোভ নিয়ে আমরা ছুটে তার মধ্যে প্রবেশ করি। একে কি ধর্ষণ বলে না ?

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন