রবিবার, ৯ মে, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                                     



খোঁজ 


(১)

"চাই---- শো-ও-ও-ওন পাপড়ি-ই- ই-ই ..." কালো টিনের বাক্স মাথায় শোনপাপড়িওয়ালা ঢুকলো তিন ফুট সরু গলিটার ভিতর l এটা একটা অন্ধগলি l ডানদিকে যে বাড়িটার টানা  দেওয়াল রয়েছে সেটা মুসলমানদের । ওপরদিকে খুব ছোট ছোট ঘুলঘুলির মত দুটো জানালা, দিনের বেলাও এত অন্ধকার যে সেটা দিয়ে ঘরের ভিতরের দৃশ্য কিছুই দেখা যায় না, শুধু মাঝে মাঝে একটা জানালার চিটচিটে পর্দার আড়ালে একটা কচি মেয়ের মুখ উঁকি মারে । ও বাড়িতে আরো অনেক বাচ্চার কিচিরমিচির  শোনা গেলেও, তাদের এ জানলায়  দেখা যায়না  কখনো l বাঁদিকে তিনটি বাড়ি, প্রথম বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে একটা কাঠের দরজা, প্রবেশদ্বার l শেষ বাড়িরও তাই ।  শুধু দ্বিতীয় বাড়ির দরজার পাশে একটা ঘরে কাঠের পাল্লা আর গরাদ দেওয়া দুটো ছোট্ট ছোট্ট  জানালা খোলা l শোবার ঘরের খাটে দাঁড়িয়ে একটা ফুটফুটে পুতুলের মতো বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে গরাদের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে রিনরিনে স্বরে  বলে উঠল 
--ও শোনপাপড়িওয়ালা ...আমাকে একটা শোনপাপড়ি দাও না l 
তার হাতের মুঠোয় পাঁচ পয়সার কয়েন l অনেক বায়না করার পর অফিসে যাওয়ার আগে বাবার কাছ থেকে আজ আদায় করেছে সে l 
ঘুলঘুলির জানলা দিয়ে অন্য বাড়ির  মেয়েটা জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে,  তারপর জানালা থেকে সরে যায়।শোনপাপড়িওয়ালা তার কালো ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে একটুকরো কাগজ বের করে তার ওপর সাজিয়ে দেয় নরম হলুদ রঙের চৌকো এক অমৃতখণ্ড ! যার প্রতিটি স্তরে স্তরে রয়েছে অফুরন্ত আনন্দের ভাণ্ডার । সেই স্বাদ পরবর্তীকালে কোনো বিখ্যাত ভুজিওয়ালার শোনপাপড়িতে খুঁজে পায়নি মেয়েটা ।

সময়টা বাহাত্তর -তিয়াত্তর সাল, মধ্যকলকাতার পার্কসার্কাস অঞ্চলের  একটা পুরোনো হিন্দুপাড়ায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর মধ্যে শেষ হিন্দু গলিটায় ওদের বাড়ি ছিল । গলির ওপাশেই মুসলমানদের বাড়ি, যদিও এটা  তাদের বাড়ির পিছনদিক, তবু দু-বাড়ির জানালা দিয়ে দুজন কচিকাঁচার চোখাচোখি বা মুখ ভ্যাংচানোর মাধ্যমে অল্পস্বল্প ভাব হতে দেরি হয় না । কিন্তু ওই পর্যন্তই ... সালমা খাতুন বা শর্মিলা বসুর এর থেকে বেশি আলাপ এগোয়নি ছোটবেলায় ।

বাংলাদেশ যুদ্ধের সামান্য পরবর্তী সময়ে রেডিওতে তখনও "আমার সোনার বাংলা "বেজে উঠত প্রায়ই l সন্ধ্যেবেলা তোলা উনুনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে মা গুণগুণ করে উঠতেন, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী " l সেসময় ঠাম্মার ছলছলে চোখে ভেসে উঠত ঢাকা বিক্রমপুরের নদীঘেরা সবুজ ল্যান্ডস্কেপ । তার কাছে গল্প শুনে শুনে ওদেশটা খুব আপন মনে হত । তার বছর কুড়ি আগে বাহান্ন সালে ওদেশ থেকে এসে বৌ আর ছেলেমেয়েসহ এবাড়ির একতলার একটা অংশ  ভাড়া নিয়েছিলেন শর্মিলার ঠাকুরদা l আড়াইখানা ঘর, সামনে একটা ছোট বাঁধানো উঠোন, উঠোনের একধারে টালির চালা দেওয়া রান্নাঘর আর অন্যদিকে টিনের চালা দেওয়া বাথরুম l তার সামনে বাঁধানো কলতলা। ভাড়া দশ টাকা । তিনি চলে গেছেন শর্মিলার জন্মেরও আগে,বাবাও  একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির অতি সাধারণ চাকরির ভরসায় মা -ভাই -বোন আর স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে এর থেকে ভাল কোনো বাসস্থান যোগাড় করে উঠতে পারেননি । যদিও ভাড়া বেড়ে তখন একশ কুড়ি টাকা হয়েছিল ।

#খোঁজ 

(২)

দোতলায় সপরিবারে থাকত বাড়িওয়ালা , একটি বাঙালি খৃষ্টান পরিবার । ওদের আচার-আচরণ ,সাজগোজ ,পোশাকআশাকে হিন্দুদের সঙ্গে কোনো পার্থক্য ছিল না । বিধবা ঠাম্মা সাদা থান পরতেন ,কাকিমারা শাঁখা -সিঁদুর সবই ব্যবহার করতেন । কিন্তু ওরা ছিল পাক্কা ঘটি ,শর্মিলারা বাঙাল ...তা নিয়ে খুনসুটি আর টিকা-টিপ্পনী চলতেই থাকত দু পক্ষে । আবার  শর্মিলাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় পাড়ার লোকজন , আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ওরাও একসঙ্গে বসে খিচুড়িভোগ  খেতেন । দুর্গাপূজার পর বাবা -কাকুর সঙ্গে কোলাকুলি করতেন ও বাড়ির কাকুরা । শর্মিলার ঠাম্মার সঙ্গে ও বাড়ির ঠাম্মাও  রোজ বিকেলে যেতেন শিবমন্দিরে ,সেখানে পাড়ার বুড়িদের বেশ একটা মিষ্টি আড্ডা হত । আবার শর্মিলাও ওবাড়ির পিকলু ,শেলীদের সঙ্গে শুক্রবার হলেই সেজেগুজে চার্চে ছুটত । বড়দিনে যে কতরকম লোভনীয় কেক-পেস্ট্রি  বানাত ওপরের কাকিমা ! বাবার অফিস থেকে ক্রিসমাস ঈভে বাক্সভর্তি যে ট্রিন্কাসের কেক দিত ,তার ধারেকাছে লাগত না ।

পাশের মুসলমান পাড়ায় যাওয়া অবশ্য নিষিদ্ধ ছিল ওদের । তবু মুখচেনা ছিল অনেকের সঙ্গেই । কাদের চাচার রিকশায় স্কুলে যেত শর্মিলা । আবার ও পাড়াতেই ডিস্পেনসারি ছিল ডক্টর বাগচীর,শর্মিলা ডাকত ডাক্তার জেঠু । জ্বরজারি হলে মাঝে মাঝে ওখানে গেলে দেখত  বিশাল বিশাল কাচের বয়ামে লাল-নীল মিক্সচার রাখা l জ্বর আর পেটখারাপের ওষুধ । কম্পাউন্ডার মামুনভাই প্রেসক্রিপশন দেখে দাগ দেয়া কাচের শিশিতে সেই মিক্সচার ঢেলে দিত । আর দিত ট্যাবলেট গুঁড়ো করে ওষুধের পুরিয়া l ডাক্তার জেঠুকে ও পাড়ার মানুষজন আল্লাহর মতই ভক্তি করত l প্রবল জ্বরে কাতরাতে কাতরাতে অথবা প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে ইব্রাহিম বা অন্য কোনো রিকশাওয়ালা বা কারখানার মজুর ডাক্তারখানায় এসে বলত 
--ডাগদারসাব মুঝে সুঁই দে দিজিয়ে না ! 
তখন ডাক্তারজেঠুর হাতে মোটা সিরিঞ্জটা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যেত শর্মি l আর অবাক হয়ে দেখত যে লোকটা সোজা হয়ে হেঁটে আসতে পারছিল না, সে কেমন টাট্টুঘোড়ার মত সাবলীলভাবে হাসিমুখে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে l ডাক্তারজেঠু ধমকাতেন ওদের 
--আর যদি নেশা করে করে লিভারের বারোটা বাজাবি তো, না দেব ওষুধ, না দেব সুঁই l
এই ধমকের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন ভালোবাসাটুকু থাকত তা ছেঁকে নিত ওরা কিন্তু  নেশায় লাগাম টানতে দেখা যেত না কাউকে l ওরা জানত ডাক্তারবাবু ভগবান l তিনি একটি ইনজেকশন দিলেই অসুখ দূরে পালাবে l এমনটাই ছিল ওদের বিশ্বাস l আসলে বাস্তুহারা ছিন্নমূল মানুষগুলোর জীবনে তখন প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই l নিম্নবিত্ত মানুষ বরাবরই নেশার দাস l ওই নেশাটুকুই ওদের জীবনের একমাত্র বিনোদন l আসলে  রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আমজনতাকে ধর্মের আফিম খাওয়ানো শুরু হয়নি তখনও l

#খোঁজ 
(৩)
এরমধ্যেই একদিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল শর্মিলার ছোটকা । তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল পশ্চিমবঙ্গে । ওদের গলিতে ঢোকার প্রথম বাড়ির একতলার সামনের অংশটা ছিল পার্টিঅফিস, মাঝেমাঝেই পুলিশ  রেড হত । দুই বাড়ির  মাঝখানে ছিল একটা বড় চতুর্ভুজাকৃতি উঠোন l সেই উঠোনের দিকে ছিল শর্মিলাদের বাড়ির পিছনের দরজা l ছোটকার কমরেড বন্ধুরা  উঠোন পার হয়ে পিছনের দরজায় মৃদু  ঠকঠক করলেই সদা সতর্ক মা দরজা খুলে ঢুকিয়ে নিতেন সক্কলকে l কেউ পালাত পিছনের উঠোনের দেওয়াল টপকে, যারা পারত না তারা সেঁধিয়ে যেত মায়ের আর ঠাম্মার খাটের তলায় l পুলিশ এসে সদর দরজা খুলতে বললেও মা দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিতেন, বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষের  অনুপস্থিতিতে তিনি কিছুতেই দরজা খুলবেন না l

দিনকয়েক পরে ছোটকার খবর পাওয়া গেল l মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি l সরকারি হাসপাতাল, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মী সেখানে নিরাপদ নয় l শর্মিলার বাবা বন্ড দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন ছোটকাকে l ডক্টর বাগচী প্রতিদিন এসে দেখে যেতেন আর পরম মমতায়, যত্নে ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করতেন মা l গা মোছানো থেকে খাওয়ানো সবটাই মাই করতেন l বয়েসে সামান্য ছোট হলেও এই ছোট দেওরটিকে সন্তানবৎ স্নেহ করতেন তিনি l ছোটকার সমস্ত কাজকর্মেই  অবাধ প্রশ্রয় ছিল তাঁর l ঠাম্মা আর বাবার সমস্ত শাসন থেকে আড়াল করে রাখতেন বলেই ঠাম্মার ভাষায় ছোটকা 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারত l'

ছোটকার সারা ঘরে ছড়ানো ইস্তেহার, কাস্তে -হাতুড়ি -তারা আঁকা লাল পতাকা l বিছানার ওপরে আধখোলা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো l দুটো হাতই ভেঙে গিয়েছিল ছোটকার, তবু ধর্মগ্রন্থের মত প্রতিদিন তার পাতা ওল্টাতেন  l সেই অসুস্থতার সময় শর্মি বোধহয় তখন  ক্লাস থ্রি -ফোর , বই পড়ে শোনাত ছোটকাকে l  ম্যাক্সিম গোর্কির "মা" উপন্যাসটা তখনই পড়া হয়ে গিয়েছিল l সোভিয়েত রাশিয়া থেকে তখন প্রকাশিত হত আকর্ষণীয় ছবিওয়ালা বাংলা বই l বড়োদের সঙ্গে সঙ্গে ছোটদেরও বইও পাওয়া যেত বইমেলার স্টলে l সুন্দর ঝকঝকে পাতায় ঝলমলে ছবি আর ঝকঝকে প্রিন্ট l প্রচুর বই কিনে দিতেন মা l বাংলা তো বটেই, সারা বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্যের ভাণ্ডারও ক্রমশ উন্মুক্ত হচ্ছিল চোখের সামনে l মায়ের বুককেসও  তখন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী তো বটেই...সমকালীন নানা লেখকের বই দিয়ে ভরে উঠছিল l অভাবের সংসারে কিভাবে যেন বই কেনার টাকা ঠিক জোগাড় হয়ে যেত l সাপ্তাহিক এবং মাসিক বড়দের এবং  ছোটদের কিছু পত্রপত্রিকাও আসত বাড়িতে l এছাড়াও দু তিনটে লাইব্রেরির মেম্বারশিপ ছিল মায়ের l সেখানে শিশু বিভাগ থেকে শর্মিলাও বই নিয়ে আসত  প্রতি সপ্তাহে l  এরমধ্যে কবে যেন  উল্টোদিকের বাড়ির জানলাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল l শর্মিলা লক্ষ্যই করেনি l সালমার মুখটা ক্রমশ ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছিল l স্কুলে, পাড়ায় তখন কয়েকজন বন্ধু হয়েছে শর্মিলার l তার মধ্যে সাগরিকার সঙ্গে বন্ধুত্বটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল l একটু দূরে, বাসরাস্তা পেরিয়ে যেতে হলেও প্রায় রোজই শর্মিলা যেত ওদের বাড়ি l 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন