তখন বেশ ছোট | স্কুল থেকে ফিরে নেশার মতো খেলার মাঠে চলে যেত মেয়েটি | জানতো কেউ খেলতে নেবেনা, এই বোকা সোকা রুগ্ন শান্ত মেয়েটাকে | তবুও যায় যদি ডাকে ভুল করে কিন্তু তা হয়না কোনো দিনই | খেলা যখন জমে ওঠতো, সে তখন মনমরা হয়ে আস্তে আস্তে মাঠ থেকে একলা ফিরে এসে বারান্দার রেলিং ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতো | যতক্ষণ না মাঠের শেষে নিম গাছের মাথার কমলা আলোটা আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে | একদিন মা দেখে তার মেয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে, বারান্দার গ্রিলে চিবুক ঠেকিয়ে | আলতো ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করে,
-- “ কি হলো সোনা ? খেলতে যাওনি ??”
মেয়ে ফোঁপায় তারপর মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,
--” আমারতো বন্ধু নেই, কার সাথে খেলবো ! কেউ আমায় খেলতে ডাকে না |”
-- সত্যি সত্যি বন্ধু চাস ? যে কোনোদিন ছেড়ে যাবে না | বড়ো বড়ো চোখ করে ছোট মেয়েটা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “ সত্যি !! কোথায় পাবো তাকে ???”
মা তখন মেয়ের হাত ধরে নিয়ে যায় তাদের বইয়ের আলমারির কাছে | হাতে তুলে দেয় অবন ঠাকুরের ‘রাজ কাহিনী’ | সেই থেকে শুরু বন্ধুত্বের, আজও সে বন্ধন অটুট | আর কোনোদিন মেয়েটা ভেবেও দেখেনি তার বন্ধু আছে কিনা !! সে যত বড় হয়,যত বাড়তে থাকে তার মনের খিদে পাল্লা দিয়ে তার বইবন্ধুও ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা পরিবেশন করে| সে মনে মনে তৃপ্ত হয় | বাহ্যিক অতৃপ্তি তাকে গ্রাস করতে পারেনা | সেই আত্মমগ্ন বালিকা আসতে আসতে বড় হতে থাকে| সবার মাঝে থেকেও মনে মনে সে বই বন্ধুর সান্যিধ্যের জন্য উতলা হয়ে ওঠে | জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আজও সেই টান এতটুকু কমেনি |
কিশোর সাহিত্য শেষ করে মনে তারুণ্যের রং লাগে এই বন্ধুর হাত ধরেই | কত কবিতা, কত উপন্যাস - গল্প যে সারাদিন তার মন জুড়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই | একদিনের কথা মনে পড়লে এখনো সে লজ্জার পায়, আবার আপনমনে হেসেও ফেলে | সে তখন ক্লাস নাইন, ক্লাসে বাংলা স্যার রচনা লিখতে দেয় বিষয় “তোমার প্রিয় উপন্যাস “--- মেয়েটি তখন শরৎসাহিত্যে বুঁদ সে আবেগের বশে কলম বাগিয়ে লিখে দিলো ‘দেবদাস’ এবং প্রিয় হবার কারণটিও সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলো | স্যার পড়ে যথারীতি ‘থ’| শুধু গম্ভীর মুখে বললেন তুমি একটি অকালপক্ক মেয়ে, বোর্ডের পরীক্ষায় যেন এটি আবার লিখে বসনা !! কোনো শিক্ষামূলক গ্রন্থের নাম লিখো দয়া করে |
এই বই তাকে শিখিয়েছে জীবনের পাঠ , শিখিয়েছে উচিত অনুচিতবোধ , দিয়েছে সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি, খোলা মনে সব কিছু বিচার করার শিক্ষা | বইয়ের হাত ধরেই লাবণ্যর ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করে , সুবর্ণলতার জেদের সাথে তার পরিচয় হয় দীপাবলির লড়াই তাকে শিক্ষা দেয় নিজের পায়ে দাঁড়াবার সাহস | মনে মনে রম্যানিবীক্ষ’র গোপালদার সাথে ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ সেএকসময় চষে বেড়িয়েছে | বই ভালোবাসার জন্যই ভবিষ্যতে ইতিহাসে অনার্স পড়তে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি |
ছোটবেলায় বর্ষা কাল ভীষণ প্রিয় ছিল মেয়েটার | ঝমঝম বর্ষায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে বইএর জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার পিছুটান আজও তাকে বড় লোভাতুর করে তোলে |
সে তখন কলেজ, যেতে আসতে হাতে বই ধরা | ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছে হাতে বুদ্ধদেব গুহ | অচেনা একজন প্রায় দেখে মেয়েটিকে ট্রেনের অপেক্ষার ফাঁকে বইয়ে ডুব দিতে | কৌতূহলবসত একদিন জিজ্ঞেস করে বসলো কি বই? মেয়েটি বলে ‘কোজাগর’| ছেলেটি তারিফ সূচক ঠোঁট মোচড়ায় | পরদিন আবার স্টেশনে হাজির সেই অচানক| এবার তারও হাতে বই | মেয়েটি চোখ মেলে তাকালে ছেলেটি বলে পড়বেন ‘বাংরিপোসির দুরাত্রি’ বুদ্ধদেব গুহর | -- হঠাৎ বই !
-- আপনার জন্য | আপনি পড়েন দেখি তাই!! ইচ্ছে না হলে থাক |
মেয়েটি হাত বাড়ায় | বোধহয় সেদিন বইয়ের সাথে আঙুলটাও অজান্তে ছুঁয়ে ছিল , যা আজও ধরা আছে যার যোগসূত্র সেই বই …...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন