#ইচ্ছের_বই
‘বই’ শব্দটা কানে গেলে চোখে ভেসে ওঠে, সামনে বন্ধুর নানা রঙের পাথরে ঢাকা এক উপত্যকা, ওপরে তুষারাবৃত মানা পর্বত, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে নর-নারায়ণ, ত্রিশূল, নীলকণ্ঠ, আরো অন্য কত শৃঙ্গ। এক ছোট্ট গুহার ভেতরে, নাভি অবধি নেমে আসা সাদা ধবধবে দাড়ি নড়ছে এক সুদর্শন শান্ত, সৌম্য চেহারার বৃদ্ধের। তার অনতিদূরে ভূর্জ্যপত্রের ওপরে দ্রুত হাতে লিখছেন একজন। একি, মানুষের শরীরে হাতির মাথা কেন? তার হাতে কলমের বদলে এটা কি? এযে ওনারই ভাঙ্গা দাঁতের একটা অংশ। সেটাকেই মসীপাত্রে ডুবিয়ে লিখে যাচ্ছেন একমনে। রচনা হচ্ছে মহাভারত।
কে আগে কোনটা লিখেছিলেন কে জানে, কিন্তু গুটেনবার্গ ১৪৫৪ সালে ছাপা বই বের করার আগে সম্ভবত প্রাচীনতম বই ছিল ঋগ্বেদ। আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগে শ্রুতি হিসেবে পরিচিত বেদকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল ভারতবর্ষে। ভুর্জপত্র বা ভুজপাতা আসলে ভুজগাছের পাতলা ছাল। এই ছাল একবার ছাড়িয়ে নিলে আবারো গজিয়ে যায়। ভুজ একধরনের বার্চ, মূল বাসস্থান বলা ভুল হবে কিন্তু এই ধরণের গাছ উত্তর অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। পেপার বার্চ-ই খুব সম্ভবত আমাদের ভুর্জপত্র। উচ্চতায় আশি ফুট মতো হয় এই গাছ তাই লেখার কাগজের অভাব হয়না।
ছিলাম বইয়ে চলে গেলাম গাছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে লেখা মহাভারতের সেই পান্ডুলিপি, কথক ও লেখকের মতো কালের গর্ভে চলে গ্যাছে। হয়তো বিজ্ঞান আরো উন্নত হবে। একদিন, আজ থেকে কয়েকশো বছর পরে সেই পান্ডুলিপি কোন ভূমিকম্প, সুনামীর মতো কিছুর পরে আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু হাতের কাছে পুরোনো আর কিছু আছে যা দেখা যায়। প্যাপিরাসের ওপরে লেখা, পার্চমেন্টের ওপরে লেখা সবচেয়ে পুরোনো পুঁথি বোধহয় ডেড সী স্ক্রোল, যা এখনো সঠিক ভাবে পাঠদ্ধার হয়ে ওঠে নি।
এছাড়াও ইতালীর ইট্রাস্কান হারানো সভ্যতার আমলে লেখা খাঁটি সোনার পাতলা পাতের ওপরে লেখা বইটি যা আড়াই হাজার বছরের চেয়েও বেশি পুরনো, নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার এক দাবীদার। এরকম আরো অনেক বইই আছে তালিকায় কিন্তু আলোচ্য বিষয় সেটা নয়। এত খেটে গাছের ছালে, সোনায়, পশুচর্মে, পাথরে, পূড়া মাটির ফলকে যারা তাদের সময়কার কথা লিখে গেছেন, তাদের কৃতিত্ব গুটেনবার্গের চে একটুও কম নয়। একেকটা সভ্যতা, সংস্কৃতি, শাসনকালের ইতিহাস এইসব বইয়েরা বহন করে আসছে আজো।
একটা সময় ছিল, অনুষ্ঠান বাড়িতে বই ছাড়া অন্য কিছুর উপহার তেমন ভালো চলত না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এমন এক রত্নভান্ডারের সন্ধান পেয়েছিলাম আমার নিজের বাড়িতেই। পাতলা প্লাইউডের তৈরি বড় বড় বাক্সে চাপাতা রপ্তানী হতো সেযুগে। ষাট সত্তর কেজি চাপাতা ধরত একেকটায়। এমন চারটি বাক্স বোঝাই বই, নানা ধরণের পত্রিকার সন্ধান পেয়ে নিজেকে আলাদীনের চেয়েও বড়লোক ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম তখন। পড়ে পড়ে সব যখন শেষ করে এনেছি প্রায় সেসময়, সেগুলির সদ্গতি করা হল। পুরোনো বই, কাগজ ওয়ালার কাছে বিক্রি করার সময় দেখা গেল মোট দেড়শো কেজি ওজন হয়েছে।
আমার বাবা মা বইয়ের ব্যাপারে কখনো বিরক্ত হতেন না। খুব ছোটবেলাতেই, শুরু থেকে হাতে পেয়েছিলাম ইন্দ্রজাল কমিক্সের অরন্যদেব, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডনকে। তারপর এল কিশোরভারতি, শুকতারা ইত্যাদি পত্রিকা। ভাসতে লাগলাম কল্পনার জগতে। কখনো ডেনকালীর ঘন জঙ্গলে, জানাডুর আশেপাশে, মহাশূণ্যে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, জুরা কুচাক জয়নাবের সাথে তুষারাবৃত পামীরে, বাসমাচী ডাকাতদের পিছে কাশগড় থেকে তাকলামাকান মরুভূমি হয়ে কিরঘিজস্থান, উজবেকিস্থানের দুর্গম পথে। স্কুলের পড়াশুনার সাথে সাথে চলতে লাগল বইয়ের জগতের সাথে সহবাস। ধীরে ধীরে হাতের কাছে পাওয়া বাংলার সংগ্রহ শেষ করে বিদেশি ভাষার অমোঘ টান টেনে নিয়ে গেল দূর থেকে দূরান্তরে।
পল বাউমার, কাটজেনেস্কী, জাদেন, ক্রপদের সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে বারুদের ঘ্রাণ নিলাম নাকে, ওয়াং-লাং, ওলানদের সাথে চীনের পথে ঘুরে দেখলাম দারিদ্রের সাথে অসম লড়াই, নাকে পৌঁছল অ্যাঙ্গোলা, ভিয়েতনাম, কোরিয়ার মানুষদের রক্তের লোনা গন্ধ। শরীর জুড়ালো কিলিমাঞ্জারোর ঠাণ্ডা হাওয়ায়। হান্টারের সাথে আফ্রিকার ঘন অরণ্যে শিকারের সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি। অ্যামেরিকার কাউবয়দের সাথে ঘোড়ায় চেপে কেটেছে রাতের পর রাত, অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে রেড ইন্ডিয়ানরা, সোনার খোঁজে মরুভূমিতে প্রাণান্তকর পরিস্থিতি কতবার এসেছে সামনে। আলাস্কায় টানা তিন মাস বরফের মধ্যে আটকে থাকা, ক্যাপ্টেন নিমোর জাহাজে পাড়ি দিয়েছি সাতসমুদ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চোখের সামনে মরতে দেখেছি লাখো ইহুদিকে, আইফেল টাওয়ারের নীচে জমতে দেখেছি বিস্ফোরকের স্তুপ। দেখেছি মাথা উঁচু করে সেবাস্তিপোলের লড়াই। লাল ফৌজের বার্লিন দখল।
দেখেছি সবার চোখে ধুলো দিয়ে হিটলার আর ইভা ব্রাউনের আর্জেন্টিনা পালানো। তৃতীয় রাইখ গড়ে তোলার দানবিক চেষ্টা। দেখেছি মুহুর্তে শেষ হয়ে যাওয়া দুটো শহর। দেখেছি দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর লড়াই। দেখেছি বহুরূপী ফড়েদের করে খাওয়ার বিকৃত লালসা, আজো দেখে যাচ্ছি, মানুষে মানুষে লড়াই বাঁধিয়ে, ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে কিভাবে শুষে খাচ্ছে একদল হিংস্র মানুষ (জানোয়ার বললাম না, কারণ তারা অনেক বেশি মানবিক)।
এই ভ্রমণ, আমার মানসভ্রমণ সম্ভব হয়েছে নামী, অনামী লেখকদের কলমের সাথে কাগজের প্রেমের থেকেই। আমার সন্তানকে ছোট থেকেই বলেছি এসব গল্প, ধরিয়ে দিয়েছি বই, আজ আমার সার্থকতা এখানেই যে আমার সন্তান ভাবছে তার সন্তানকে বইয়ের জগতের সাথেই জুড়ে দেবে ছোটবেলা থেকেই। আমার মনে হয় একজন পিতার, একজন মাতার জীবনে এর চেয়ে বড় সুখের সময় আর আসতেই পারেনা।
কাগজের সাম্রাজ্য ছেড়ে আজ বই নিজের চেহারা পাল্টেছে, আধুনিকতার মোড়কে মুড়েছে নিজেকে, পরিবর্তিত হয়েছে মাধ্যম। হয়তো ভালোর জন্যই। ভবিষ্যৎ এর উত্তর দিতে পারবে। নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে সেই মাধ্যমে। কিন্তু স্বপ্নগুলো দেখেছি আজো একই ভাবে চলে আসে চোখের সামনে। ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ায় পরিচিত বই, পরিচিত চরিত্রেরা। আরেকটা ভোর আসে, নিজেকে তৈরি করি আমার লেখক লেখিকা বন্ধুদের লেখায় ডুবিয়ে দেবার জন্য। সার্থকতা হয়তো একেই বলে। জীবনের সায়াহ্নে এসে একটাই কামনা মনে জেগে থাকে। শেষবার চোখমেলে পৃথিবীটাকে দেখার সময় একটা খোলা বইই থাকে যেন চোখের সামনে আমার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন