বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৯

মেঘশ্রী ব্যানার্জী

ছোটগল্প

লাল-সাদা



আজ ভীষণ খুশি ইভান, এইলি আর ডাফিল্ড। একরাশ হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে মম আর ড্যাডাকে গুডনাইট জানিয়ে এইমাত্র শুতে গেছে। রোঁয়া ওঠা কম্বলটায় বাড়ন্ত তিন বাচ্চার আর কুলায় না। তাও গুটিসুটি মেরে যুদ্ধ করতে করতে, একে অন্যের ওম নিতে নিতে একসময়ে ঠিক ঘুময়ে পড়ে ওরা। মার্থা বাকি খাবার গুছিয়ে তুলে রাখছে। ডেরিক লক্ষ্য করে মার্থার বসে যাওয়া গালের কালো খসখসে চামড়ায় কুঞ্চন। দুহাত কঙ্কালসার। তবু আজ মুখে তৃপ্তি।

ডাউনটাউনে এক অপরিসর ভাড়ার কামরা আর নামমাত্র ডাইনিং-কাম-কিচেনে গুঁতোগুঁতি জীবন। কাঠের দেওয়ালের ফাঁকফোকর গুলো অহরহ শীতের জানান দিয়ে যায়। তাতে সাঁটা কাগজগুলো জানান দেয় দারিদ্রের। তবু তো মাথার উপর ছাদ!

বছর দুয়েক আগেও অবস্থা এমন ছিল না। অভাব ছিল। কিন্তু খেয়ে-পরে বাঁচার দুশ্চিন্তা ছিল না। তার উপর ইভানের আগমন বার্তায় আনন্দে ভরপুর কাটছিল জীবন। হঠাৎ একদিন চুরির অপবাদে ডেরিকের স্টোরের চাকরিটা দুম করে চলে যায়। জেলও খাটতে হয় ন’মাস! দুর্বিপাক পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে মার্থাকে। জিসাসের ভরসায় দুই ছেলেমেয়েকে রেখে সন্তানসম্ভবা মার্থা হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়ায়। যুতসই কাজ না পেয়ে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তার ধারে, স্টোরের সামনে বসে থাকে কিছু ভিক্ষের আশায়!

একসময় ছাড়া পায় ডেরিক। জন্তুর মত মার খেয়েও অপরাধ স্বীকার করেনি সে। আসল চোর ততদিনে ধরা পড়েছে। বাড়ি ফিরে একদৃষ্টে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলে নিতেও ভুলে যায় যেন! ক্ষতচিহ্নে হাত বোলাতে বোলাতে একটা বদল টের পায় মার্থা। টের পায় চামড়ার দাগড়া দাগড়া দাগের শিকড় আরও অনেক, অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।

ডেরিক সকালে কাজের চেষ্টায় বেরোয়। কখনো সফল, কখনো নয়। ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত বা ভোর রাত। তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা। খ্রিস্টমাস ইভ। আজ ডিনারটা একসাথেই করার বায়না করেছিল ছেলেমেয়েগুলো। মার্থাও কি তাই চায় নি? নিশ্চয়ই চেয়েছে। কিন্তু বাবার কাছে স্পেশাল দিনে স্পেশাল খাবারের ফরমাইস করবে ইভান আর এইলি - এই তার ভয়! ডাফিল্ড তাদের জীর্ণদশার সাথে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে। না দিতে পারার যন্ত্রণায় ডেরিকের চোয়াল শক্ত হতে,  চোখ নিষ্ঠুর হতে দেখেছে মার্থা!

গত সপ্তাহে শুকনো ব্রেড ছাড়া কিচ্ছু জোটেনি। আজও অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত বাচ্চাগুলো ম্লান মুখে শুকনো পাঁউরুটির দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই ড্যাডা সান্তাক্লজের পোষাক পরে ঝোলা ভরা কেক, অ্যাপল পাই, পাপ্পা জন’স পিৎজা আরও রকমারি খাবার, উপহার নিয়ে হাজির হয়েছে। তারপর সে কি উল্লাস! জিসাসকে থ্যাঙ্কস জানিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে শুরু করে সবাই মিলে। ডাফিল্ডের চোখেমুখেও আজ অকাল-পরিণত ভাব সরে যেন জেল্লা দিচ্ছে শৈশব। বাচ্চাগুলোর আনন্দে একবার জিসাসকে একবার ডেরিককে সজল নীরব চোখে ধন্যবাদ জানায় মার্থা। ডেরিকের মুখের রেখা আজ নরম, পরিতৃপ্ত! চোখ নিস্পৃহ।

গোছগাছ সেরে ডেরিকের গা ঘেঁষে বসে মার্থে। গুডনাইট কিস দিয়ে এক স্বপ্নময় রাতের ইশারা করে যায়। পেটের খিদে মিটতেই আজ অনেকদিন পর শরীর তার খিদের কথা জানান দিয়েছে। ডেরিক ওষ্ঠপ্রান্তে সম্মতি সূচক হালকা হাসি ঝুলিয়ে সান্তাক্লজের ঝোলা নাড়াচাড়া শুরু করে। আর দাঁড়ায় না মার্থা।

অন্যমনস্ক ডেরিক ঝোলার ভিতর থেকে বার করে একটা বিয়ারের বোতল। সাথে একটা পেটমোটা পার্স। ক্রেডিট কার্ডসের আধিক্য থাকলেও তাতে ডলারের পরিমাণও নেহাত কম নয়। ত্বরিত গতিতে হাতড়ে চলে প্রতিটি পকেট। চোখের নিস্পৃহতা বদলে যেতে থাকে চকচকে লোভে। ড: হ্যারল্ড গার্বার -  ড্রাইভিং লাইসেন্সের উপরের নামটা বিশেষ দাগ কাটেনা ডেরিকের মনে। টেবিলে উল্টে রাখে। উল্টোপিঠে জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকানো ফটোটাতে চোখ আটকায় এবার। লাললাল গোলগাল তিনটি বাচ্চার খুশি খুশি ছবি। ডেরিক অপলকে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। ওরা এখনো ওদের ড্যাডার পথ চেয়ে বসে। হ্যারল্ডকে বরফ সাদা ফুটপাতের উপর লাল রক্তে ভাসিয়ে আজ ডেরিক নিজের পরিবারের জন্য খুশি এনেছে ঝোলা ভরে!

বাইরে ঝোড়ো হাওয়া। সাথে অনর্গল তুষারপাতে দরজার সিকি ভাগ সেই কখন ঢাকা পড়ে গেছে! কিচেনের জানলার নড়বড়ে সার্সি ঝড়ের দাপটে ঝনঝন করে ওঠে। ঘোর কাটে ডেরিকের। নোনতা অনুতাপ মুছে ফেলে চটপট বাকি থাকা কেক, খাবারদাবার, আধখোলা গিফটের প্যাকেট ঝোলায় ভরতে থাকে। গায়ে আরও একবার চাপিয়ে নেয় সান্তাক্লজের পোষাক। দেড়ফুট ঝুরো বরফে পা গেঁথে গেঁথে এগিয়ে চলে ডেরিক। পিছনে বল্গাহরিণের ক্ষুরের সাথে ছাপ ফেলে যায় একজোড়া সমান্তরাল রেখা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন