বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৯

অমিতাভ দাস


বই



যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে , আপনার প্রিয় বন্ধু কে ? নির্দ্বিধায় উত্তর দিই: বই এমন বন্ধু আর না পেয়েছি , না পাবো ফলত , বই নিয়ে লিখতে হলে কত স্মৃতির সলতে পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে ভিতরে ভিতরে ধাক্কা দিচ্ছে এলোমেলো কত যে স্মৃতি

ছোটবেলায় বই বলতে ছবিতে- গল্পে " ছোটদের রামায়ণ " আর " ছোটদের মহাভারত " দিয়েই শুরু কত যে ছবি দেখেছি আর বারবার পড়েছি এরপর যে বই দুটির কথা চোখ বুজলেই অমলিন মনে পড়ে সে দুটি হল : ছোটদের বিবেকানন্দ আর ছোটদের রামকৃষ্ণ উদ্বোধনের বই চমৎকার সব ছবি আজো চোখে লেগে আছে

আমাদের বাড়িতে বাবা-মা-জ্যাঠার বই পড়বার খুব নেশা ছিল দেখতাম তাঁরা রাত জেগে বই পড়তেন পরদিন বাবা বিকেলে সাইকেল নিয়ে ছুটতেন লাইব্রেরিতে বই পড়া ব্যাপারটা কিছুটা পরিবার থেকেই বোধহয় পাওয়া আমাদের বাড়িতে তখন সপ্তাহিক 'দেশ' রাখা হত জ্যাঠামশাই রাখতেন বাবা প্রতিবছর শারদ সংখ্যা ' বর্তমান' কিনতেন চমৎকার চমৎকার সব উপন্যাস বেরুত তখন শারদ বর্তমানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের "শাহাজাদা দারাশুকো" তো শারদ বর্তমানেই ছাপা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কত যে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়েছি তো আমিও বাবা পাড়ার এক দাদার সঙ্গে লাইব্রেরিতে যেতাম খুব ছোট তখন ক্লাস থ্রি কী ফোর হবে বাংলার ডাকাত বইটি আমার খুব ভালো লেগেছিল আর ভূতের গল্প খুব ভালো লাগত মায়ের দুই পাশে দুই ভাইবোন শীতের রাত টিনের চালে কুয়াশা পড়ছে মা শুয়ে শুয়ে ভূতের গল্প পড়ছেন গল্পগুলো এত ভয়ের যে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছি না এসব কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে

তখন এত টিভি, ফোন ঘরে ঘরে ছিল না সময় কাটাতে মা-দিদিমা বই পড়তেন ক্লাস এইট থেকে নিজে নিজে বই পড়তে বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে লাইব্রেরিতে যেতাম হেমেন্দ্রকুমার রায় খুব প্রিয় ছিলেন সব কটি খন্ড পড়ে ফেলেছিলাম জয়ন্ত-মানিক-সুন্দরবাবুর দুর্দান্ত সব অভিযান   এবং পান্ডব গোয়েন্দা সে কী আনন্দ ! শেষ হলেই আরেকটি বই আনতে যেতাম আজ খুব অবাক হই 'কথা সাহিত্যে' আড্ডায় বা অন্য অনেক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে ষষ্ঠীপদদার পাশে বসি সংকোচ হয় খুব আমি কী যোগ্য এত বড় মানুষের পাশে বসার আমার ছেলেবেলার প্রিয় পাঠ্য পান্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা তিনি সহজ আন্তরিকতায় দাদা হয়ে উঠেছেন আমাদের আর ছিল চাঁদমামা এবং শুকতারা আমার কিশোরবেলার সঙ্গী তখন বিকেলবেলা লাইব্রেরিতে যাওয়ার একটা সুঅভ্যাস ছিল যাঁরা যেতেন পাড়ায় তাঁদের বেশ সমীহ করতাম আমরা পথে দাঁড়িয়েই কিছু কথা বলে নিতাম কে কী বই তুলেছে লাইব্রেরি থেকে তা দেখতাম এমনকি অনেক ভালো ভালো বইয়ের খোঁজ পেয়ে যেতাম

আর স্মৃতি নয় অন্য কথা বলি বইয়ের সঙ্গেই আমার সহবাস বিছানায় যেদিন বই থাকে না সেদিন ঘুম হবে না মাথার কাছে নানা ধরনের বই থাকে বিছানা জুড়ে বই তোরঙ্গের মধ্যে বই তিনটে বড় আলমারি জুড়ে বই সোফার ওপর বই লোকজন এলে বসতে দিতে পারি না বই কোথায় নেই ? কত মানুষের কত যে উপহার তিনবার বাড়ি বদলজনিত কারণে কয়েকশো বই বিক্রি করে দিতে হয়েছে লাইব্রেরিতে দান করে চলে আসতে হয়েছে আজো অবিরাম ধারায় বই কিনেই চলেছি আমার নিজস্ব লাইব্রেরিতে অনেক দুর্লভ গ্রন্থ আছে আছে  বিরল পত্র-পত্রিকাও

কতজন বই নিয়ে আর ফেরৎ দেয়নি ইদানীং চাইলেই আর বই দিচ্ছি না প্রবাদটা সত্য মনে হয় , " বই আর বউ বাইরে গেলে আর ফেরে না " সে অভিজ্ঞতা কম হল না বই কেউ নিলে আর ফেরত আসে না অথবা অনেক কষ্টে ফেরৎ আনতে হয়

সকলে বই ঠিক করে পড়তে জানে না এত অযত্ন নিয়ে পড়ে যে অন্যের পড়ার আর উপায় থাকে না পৃষ্ঠা মুড়িয়ে রাখে ভিতরে নানাভাবে পাতায় পাতায় নিজের নাম লেখে বিচ্ছিরি ভাবে দাগায় বইটা যত্ন করে পড়া উচিৎ বই এর পৃষ্ঠা বা মলাট  ছিঁড়লে খুব কষ্ট হয় যেন আমাকেই ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ বই-এর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তাকে বুকের ওপর নিয়েই ঘুমোই সে যে আমার দোসর অন্তরের বন্ধু দুঃখরাতের বন্ধু বিজন আঁধারে বন্ধু সুখের ফল্গু নদী আনন্দের মাধুর্য কেবল


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন