শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

সিলভিয়া ঘোষ ,স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক

দ্বিচারিনী


©সিলভিয়া ঘোষ
©স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক


চৈত্রের ঠা ঠা রোদের পর বিকেলের লাল আকাশ, এলোপাথারি হাওয়ায় ধুলোঝড়, মাঝে মাঝে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে  বিদ্যুতের চমক ফাঁকা ক্ষেতের উপর যখন পড়ছে,  শুকনো আলের উপর চলাফেরা করা হাতেগোনা মানুষ গুলির হৃদক্ম্পন দু এক সেকেণ্ডের জন্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়  অনন্ত ঠাকুরের হাত ধরে রাণু বোষ্টমী প্রায় হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে এ গাঁয়ের  শেষপ্রান্তে থাকা সনাতন মহান্তর আখড়ার পাশে  নিজের ছোট চালা ঘরে।

রাণু বোষ্টমী এই গাঁয়ে এসেছে তা প্রায় পাঁচ বছর। বয়স তার এই এক কুড়ি পাঁচ কিম্বা সাত হবে। তবে মুখটা আজও ষোড়শী। গায়ের রঙ কালো, দাঁতগুলি ঝকঝকে,  নাকটি টিয়া পাখির মতোন, কণ্ঠস্বরে মধু ঢেলে দিয়েছে যেন শ্রীহরি। সনাতন মহান্ত তাই তাকে এক ফালি জায়গা দিয়েছে আখড়ার পাশে। সকাল সাঁজে তার আরতিতে আখড়া যেন মেতে ওঠে। সে সুর কোন চলতি সিনেমার গানের সুর নয়, সে সুর তার আকুল হয়ে ডাকা শ্রীহরির চরণে সমর্পিত সুরাধনা। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলেই আপনা থেকেই দু চোখে জল ভরে আসে। সেই সুরের সঙ্গে সঙ্গত করতেই তো অনন্ত  ঠাকুরের এখানে আগমন আর তারপর থেকেই রাণুর একান্ত বাউল সে। সে কথা বাঁধে একের পর এক তাতে সুর দেয় রাণু  বোষ্টমী, এভাবেই মাধুকরীতে দিন কাটে তাদের। 

তবে অনন্ত বেশ বুঝতে পারে  এ কালবোশাখী তাদের জীবনের মূল্য নিতেই এসেছে, নইলে এতবছর এগাঁয়ে বাস করেও আজকের মতো ঝড়ে তো কোনদিন তার বুক কাঁপেনি, তবে আজ কেন এমনটা হচ্ছে! সে কি তবে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনছে ? নিজের মনের ভিতর প্রশ্নগুলো  তাকে বারেবারে খোঁচাচ্ছে। রাণু বোষ্টমী  হাত ধরে টানতেই প্রায় হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল অনন্ত, তা দেখে রাণু বেশ করে হেসে বললে, 'কী গো ঠাকুর, খোয়াব বুনছো না কি দিনে? নাও নাও পা চালাও দেহি। ঝড় জলের আগে ঘরকে চলো,  দুটো চালে ডালে ফুটিয়ে নেবোখন।'
অনন্ত যেন মনে মনে হেসে সব হিসেবটা মিলিয়ে নেয়। 
একটু  আস্তে করে রাণুর প্রায় কানের কাছে মুখ এনে বলে, 'আজকাল তুই আর পানী বলিস না তেমন, নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিস বেশ। আমারো স্বপ্ন বুনতে বেশ লাগে। তোকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি রে পাগলী, বাঁধবি আমার সঙ্গে ঘর?' 
হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলো রাণু কি যেন ভাবলো  মিনিট দুয়েক ,তারপর হিড়হিড় করে টানতে টানতে  নিয়ে চলল অনন্ত ঠাকুরকে তার ঘরে। শুধু চোখগুলো তার অন্ধকারের মধ্যে বাঘিনীর  মতোন জাজ্বল্যমান হয়ে রইল ঐ শুকনো আলপথের মধ্যে। অনন্ত ঠাকুরের  ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলছে, 'অন্ধকানাই আজ তুই মৌচাকে সঠিক ঢিল মেরেছিস ইনামও আজই পাবি।'

দুজনে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে গাঁয়ের পথের শেষ সীমানায় পা রাখতেই অন্ধকার থেকে এক লম্বা চওড়া,লুঙ্গি ,ফতুয়া পরিহিত শ্যামবর্ণের এক মানুষ রাস্তা অাটকিয়ে দাঁড়িয়ে রাণু কে উদ্দেশ্য করে বলে, 'তারপর! কেমন চলছে সব কিছু জারিনা বিবি?'
আচমকা ভয় পেয়ে থমকে যায় রাণু। বিদ্যুতের আলোয় তার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ দেখতে পায় অনন্ত। মুহূর্তে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে রাণু, 'কে গা তুমি ভরা দুর্যোগের দিনে পথ আটকাচ্চ? কাকে দেকতে কাকে দেকেছো? সরো দেকি বাপু যেতে দাও আমাদের।' তারপর ব্যস্ত হয়ে অনন্তর দিকে ফিরে ডাকে, 'হ্যাঁ গা তুমি  দাঁইরে দেখছ কি, পা চালাও না। আকাশের অবস্তা দেকছ নি!' লোকটা কিছু না বলে পথ ছেড়ে দেয়। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। দুজনেই ভিজে যায়। অনন্তর হাত ধরে একরকম প্রায় উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দোর দেয় রাণু বোষ্টমী। তারপর দরজার খিল ধরে হাঁপাতে থাকে। অনন্ত একটু সময় দেয় ওকে। তারপর এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে। রাণুর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকে, 'এমন হুড়ো দিয়ে নিয়ে এলি কেনে রাণু?' রাণু যেন কোন অন্য জগতে ছিল এতক্ষণ, অবাক হয়ে ফিরে তাকায় সে অনন্তর দিকে। আবার এক লহমায় নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, 'রোসো বাপু, উঠোনে যেয়ে দেখি কি হাল হয়েছে। এমন ঝড়জল হবে কে জানত বলো দিকি। সকালে কেমন কাঠফাঁটা রোদ্দুর ছিল আর একন আকাশ ভেঙে বিষ্টি নামলো!' বলতে বলতে রাণু উঠোনে চলে যায়। মিনিটখানেক পরে ঘরে ঢুকে দেখল অনন্ত বাউল জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। গামছাটা এগিয়ে দেয় রাণু, 'নাও মাথাটা মুছে জামাখানা পাল্টে ফেলো দিকি ঠাকুর। খাটের ওপর একটা কাপড় আর চাদর রেখেচি। পুরুষ মানুষের পোশাক তো আর আমার ঘরে পাবে নে। আমিও কাপড়টা বদলে আসি গে।' কিছুক্ষণ পরে রাণু কাপড় বদলে ঘরে ঢোকে। অনন্ত তখনও একইভাবে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত হয়ে রাণু কিছু বলতে যাবে এমন সময় অনন্ত তার সামনে দাঁড়ায়, 'ওই লোকটা কে ছিল রাণু? তুই ওকে চিনিস তাই না?' চোখ সরিয়ে নেয় রাণু, 'কাকে আবার চিনি, কি যে বলো তুমি ঠাকুর। যাও কাপড়টা বদলে এসো। আমি একটু চালে ডালে চড়িয়ে দিই।' রাণুর হাত ধরে তাকে আটকায় অনন্ত, 'কথা ঘোরাস নি রাণু, কে ওই লোকটা? ও তোকে কোন নামে ডাকলো? আর তুই অমন ভয় পেলি কেন?' চোখ তোলে রাণু, সেই চোখে ভয় নেই, ছলনা নেই, বিরক্তি নেই, আছে শুধু আকুতি, 'আগে কিছু খেয়ে নাও ঠাকুর। কতা বলার জন্য তো অনেক সময় পড়ে রয়েচে। আমি ভাতটা বসিয়ে দিই। সব বলবো তোমায়। বলবো বলেই তো ডেকে এনিচি গো।' অনন্ত নারাজ, জোর দিয়ে বলে, 'এখনই বল। আমি বাড়ি ফিরে যাব। এখানে থাকতে আসিনি।' অনন্তর হাতের ওপর হাত রেখে আলতো চাপ দেয় রাণু, 'দোহাই তোমার ঠাকুর, সব বলবো আমি, কিন্তু এই ভিজে কাপড়টা তুমি ছেড়ে এসো। শান্ত হয়ে বসে সবকথা শুনো আমার।' অগত্যা রাণুর জেদের কাছে হার মানে অনন্ত। রাণুর দেওয়া কাপড়টা ধুতির মতো করে পরে গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘরের চৌকির ওপর বসে। 

খানিক চুপ করে বসে থাকে রাণু। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে শুরু করে।
-'আমাকে আজ তোমরা যেমন দেখতাসো আমি তেমনি ছিলাম না। আমার আসল নাম জারিনা। বাপের এক মেয়ে ছিলাম। বড় আদরে মানুষ করছিল আমারে বাপটা। আমার যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন একদিন শহর থেকে বাড়ি ফেরার সময় খালের ধরে বাস উল্টে বাপটা মরে গেল। আমি আর মা খুব কাঁদলাম কদিন। তারপর একদিন মা বললো সে আসলাম চাচারে নিকা করতে চায়। শুনে খুব রেগে গেছিলাম আমি। আসলাম চাচা আমাদের গ্রামেই থাকতো। আব্বা কোনদিন ওরে দেখতে পারতো না। খালি বড় বড় কথা বলতো। আমারও ভাল লাগতো না। মায়ের কি করে ভাল লাগলো জানিনা। আব্বা মারা যাবার এক বছর কাটতেই মা আবার নিকা করলো। আমি বুঝলাম আমার সুখের দিন শ্যাষ হয়েস ।

আসলাম চাচার নজর আমার ভাল লাগতো না। আমি চাচা কইরাই বলতাম। মা বলতো আব্বা বলতে। আমি শুনতাম না। একদিন মা বাড়ি ছিল না। চাচা জোর করে আমারে বিছানায় লয়ে গেল। আমি কত কাঁদলাম কেউ বাঁচাতে এলো না। মা ফিরলে সব বললাম। মা বললো পুরুষমানুষের খিদে একটু বেশি হয়, অত উতলা হবার কিছু নেই।' বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠে রাণু। তাকিয়ে দেখে বিস্ফারিত চোখে অনন্ত তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মুছে সে আবার বলতে শুরু করে।

-'এরপরে একদিন রাতে মায়ের সামনেই লোকটা আমারে ঘরে ডাকে। আমি তখন কুটনো কুটছিলাম, যাইনি। মা জোর করে যাবার জন্য। আমি জেদ করে বসে থাকি। লোকটা এল আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে। আমি কোনরকমে এক ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে আসি। নাম পাল্টিয়ে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে এই মাঝেরপাড়ায় আসি। মহান্ত ঠাকুর আমার গান শুনে আমারে আশ্রয় দেন। সেই থেকে এখানেই রয়ে গেচি। আজ যারে দেখলে সে আসলাম চাচার ভাই, করিম আলী। ওরও নজর খারাপ। কি করে জানিনা আমারে এখানে খুঁজে পেয়েছে। কদিন ধরে দেখতাসি লোকটারে। আমারে বোধহয় এখানকার পাট উঠাতে হবে এইবার।' একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে রাণু একটু হাঁপায়।

অনন্ত একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার সে মুখ খোলে, 'তুই বিধর্মী হয়ে এখানে এসে ঠাকুরের নামগান করছিস? পরকালের ভয় করিস নে? এখানে জানাজানি হলে তোর কি হবে জানিস? পুঁতে ফেলবে তোকে গ্রামের লোকজন। মহান্ত ঠাকুর তোকে বিশ্বাস করে থাকতে দিয়েছে আর তুই নিজের পরিচয় লুকিয়ে এতবড় নাটক করে যাচ্ছিস রোজ!' রাণু ওরফে জারিনা এবার সোজাসুজি তাকায় অনন্তর দিকে, 'ঠাকুরের আবার জাত কি গো? তুমি না বাউল! জাত কি কেউ সাথে নিয়ে জন্মায়? জাত যদি গায়ে লেগেই থাকতো তাহলে অন্য জাতের ছোঁয়ায় তা নষ্ট হয় কি করে? জাত যদি গায়ে আঠার মতো সেঁটে থাকে তাহলে কেউ নিজের ধর্ম পাল্টায় কি করে গা? মানুষ আগে না জাত আগে? আমি এখনে এসে নাম পাল্টে না থাকলে আমার মা আর ওই লোকটা মিলে আমারে তো মেরেই ফেলতো। আমি জানি ওরা করিম আলীর সঙ্গেও আমাকে শুতে বলতো। জানোয়ারটা কি এমনি এমনি আমারে খুঁজতাসে নাকি!' 
অনন্ত গম্ভীরভাবে বলে, 'আর মহান্ত ঠাকুর? ওই দেবতার মতো মানুষটাকে তো তুই ঠকাচ্ছিস?' 
অট্টহাস্য করে ওঠে রাণু, 'দেবতা! হ্যাঁ গা তাই বটে। আমারো মনে হতো এমনটাই। বড় অপরাধী লাগতো নিজেকে। কাল  সন্ধেয় করিম আলী এসে মহান্ত ঠাকুরকে আমার নামে কি বলেছে জানিনা, কাল রাতে আমার ঘরে এসে তোমার দেবতা বলে গেলেন উনি করিম আলীকে বলেছেন আমাকে উনি ছোট থেকে চেনেন। আমি ওনার নিজের গাঁয়ের মেয়ে। করিম আলী কোনদিন সত্যিটা জানবে না যদি আমি ... আমি...থাক সে কথা। 
  অনন্ত বলে 'না থাকবে না,  এখনি বল আমি শুনবো'!
   রাণু বলে 'যদি আমি  মহান্ত ঠাকুরকে মাঝে মাঝে রাতে ঘরে আসতে দিই। আর যদি না আসতে দিই তাহলে দুদিন বাদে সারা গাঁয়ের লোক জেনে যাবে রাণু বোষ্টমীর আসল পরিচয়।'
হতভম্ব হয়ে যায় অনন্ত, 'মহান্ত ঠাকুর! মানুষ এমনও হয়? এর চেয়ে উনি তোকে বার করে দিতেন তাও বুঝতাম ধর্মভীরু। ছিঃ! ছিঃ! কিন্তু তুই আমাকে এসব বলতে গেলি কেন? আমিও তো গাঁয়ের লোককে বলে দিতে পারি।' 
চুপ করে থাকে রাণু। তারপর চোখ না তুলেই বলে, 'কারণ তুমি এমন এক মানুষ যাকে আমি আমার নিজের মতো করে বুঝতে পারি। যে আমারে ভালবেসে শাদি করতে চেয়েছে। প্রথম কেউ যে আমারে শুতে বলেনি, শাদি  করে ঘরে তুলতে চেয়েছে। তোমারে বলব না তো কারে বলবো আর।'

স্তব্ধ হয়ে যায় অনন্ত। কি বলবে ভেবে পায়না। রাণুই বলে, 'আমি জানি গো ঠাকুর কি ধর্ম সংকটে তোমারে আমি ফেলেছি। কাল অবধি যে রাণু বোষ্টমীরে তুমি চিনতে আজ সেই এমন অচেনা হয়ে গেলে তারে কি আর শাদি করন যায়? তুমি ভেবো না, আমি তোমারে জোর করুম না। তোমার যা ইচ্ছা যায় তাই করো। তবে আমিও বলে রাখি তোমায় ঠাকুর, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ আদায় করা আসলাম  চাচারে দেকসি, আবার পৈতে পরা হাতে জপের মালা নেওয়া মহান্ত ঠাকুরকেও দেকসি। ও আল্লাই বলো আর কৃষ্ণই বলো কেউই অবলা নারীরে বাঁচায় না। বাঁচতে হলে নিজেকেই বাঁচতে হয়। আর আমি যে করে হোক নিজেকে বাঁচিয়ে নেব। বাঁচতে আমার বড় ভাল লাগে। জারিনা হয়ে না পারি রাণু হয়ে বাঁচব, তাতেও না পারলে অন্য কোথাও অন্য কোন নামে বাঁচব। বাঁচতে আমারে হবেই।' 
অনন্ত উঠে পড়ে ধীরে ধীরে। বলে, 'আজ আমি আসি। বৃষ্টিটা ধরেছে। কাল আসবো 'খন। তুই সাবধানে থাকিস। আমরা তো বাউল মানুষ। এখানে নয় অন্য কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধব নাহয়। এখানে এমনিও বেশিদিন থাকা তোর ঠিক হবে না। নিজেকে বাঁচিয়ে চলিস কয়েকটা দিন। আমি দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়।' 
অনন্তর জন্য দরজা খুলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে রাণু। অনন্ত তাকে কাছে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধানে থাকতে বলে নিজের ঝোলাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। 

পরেরদিন ঝলমলে আকাশ দেখে মনটা ভাল হয়ে যায় অনন্তর। মহান্তর বাড়ির দিকে যাবে মনে করে ঝোলাটা কাঁধে তুলতে যাবে এমন সময় গাঁয়ের ছেলে গোপাল দৌড়ে এসে বলে, 'শিগগির চলো অনন্ত দাদা, মহান্ত ঠাকুর খুন হয়েছে।' 
-'কি বললি? খুন? কোথায়?' চমকে যায় অনন্ত।
-'রাণু বোষ্টমীর ঘরে। কেউ কাটারী দিয়ে গলার নলি কেটে দিয়ে গেছে গো।'
-'সেকি! বোষ্টমী কোথায়?'
-'তারে পাওয়া যাচ্ছে না। পালিয়েছে মনে হয়।'

অনন্ত ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়। মহান্তর বাড়ির কাছে আসতেই জটলাগুলো চোখে পড়ে। সেখান থেকে জারিনা নামটা দু-একবার কানে আসে। গাঁয়ের বয়স্ক মানুষ নারায়ণ গাঙ্গুলিকে এদিকে আসতে দেখে তার দিকেই এগিয়ে যায় অনন্ত। 
-'কি হয়েছে গো দাঠাকুর?'
-'আর বলো কেন, এসব নোংরা মেয়েছেলেদের কারবার। মেয়েটা আসলে নাকি মুসলমান। নাম জারিনা। ওর মা দ্বিতীয়বার বে করলে সেই বাপকে এই একইভাবে খুন করে পালিয়ে আসে এই মেয়ে। এখানে এসে বছর পাঁচেক হলো বোষ্টমীর ভেক ধরে ছিল। কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারে নি। মহান্ত ঠাকুর বোধহয় বুঝে গেছিল, তাই তাকেও সরিয়ে দিল। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে। দেখা যাক কি হয়।'
রাগে জ্বলে যায় অনন্তর মাথাটা। ধীরে ধীরে বলে, 'বোষ্টমীকে তুমিও তো খুব স্নেহ করতে দাঠাকুর। আর আজ সে নোংরা মেয়েমানুষ হয়ে গেল? কেন একটা মেয়ে দুটো পুরুষকে খুন করলো সেটা বুঝতে পারছো না? একটু ভেবে দেখো কখনো।'
রেগে যায় নারায়ণ গাঙ্গুলী, 'তুমি থামো তো বাউল। তোমাদের জাতধর্ম না থাকতে পারে, আমাদের আছে। মুসলমান মেয়েটা আমাদের সবার ধর্ম নষ্ট করে দিয়ে গেল। রোজ ওর হাতে প্রসাদ খেয়েছি আমরা। এখন গ্রামসুদ্ধু লোককে প্রায়শ্চিত্তির করতে হবে। তুমি মেলা জ্ঞান দিও না। এত তো গান গাইতে একসঙ্গে, তুমি নিজে যদি জানতে যে মেয়েটা বিধর্মী তাহলে গাইতে পারতে?'
মাথা নিচু করে অনন্ত নিজের ঘরের দিকে হেঁটে চলে। মহান্তর মৃতদেহ দেখতে চায় না সে। কাল রাতে কি ঘটেছে সব সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। না, বাউল হয়েও সে জাতধর্মের ওপরে উঠতে পারেনি। গতকাল হলেও নারায়ণ গাঙ্গুলীর কথার সঙ্গে সে একমত হতো বোধহয়। কিন্তু একটা মুখ্যু মেয়েমানুষ কাল তাকে মনুষ্যত্বের পাঠ দিয়ে গেছে। আজ আর কিছুতেই সে তার রাণুকে দোষী ভাবতে পারে না। যতই রাণু আসলামকে খুনের ঘটনা তার কাছে লুকিয়ে যাক। যা করেছে সে নিজেকে বাঁচাতেই করেছে। এতে কোন অপরাধ থাকতে পারে না। সত্যিই তো ঠাকুরের আবার জাত কিসের? আর সেই ঠাকুর, সেই আল্লাকে নিয়ে বড়াই করা মানুষগুলোর তো একটাই জাত, খাদক। একটা অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দিতে গিয়ে যারা বারবার মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই ফিসফিস করে অনন্ত, 'এ গাঁয়ে আমিও আর থাকবো না। বেরিয়ে পড়ব আবার, দেখি যদি আমার সুরের জুড়িদার, আমার বোষ্টমীকে খুঁজে পাই।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন