শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

পিনাকী মুখোপাধ্যায়


                                                                  প্রথম বৃষ্টি 
                                                         

                     “ জানো শ্রীতমার সঙ্গে ভীষণ মিল তোমার । “, হোয়াটসঅ্যাপে কী যেন টাইপ করতে করতে বলল রিয়া ।
         অফিসফেরত চা খেতে খেতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে নতুন কেনা থ্রিলারের পাতা ওলটাচ্ছিলাম । ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলাম , “ কে শ্রীতমা ? “
                     স্মার্টফোন থেকে চোখ তুলে বিরক্ত মুখে রিয়া বলল , “ এত ভুলে যাও কেন তুমি ? অর্কর মায়ের কথা কতবার বলেছি তোমায় … “
         আমি ঢোক গিলে বললাম , “ ইয়ে … মানে … কোন অর্ক যেন … “
         মোবাইল বন্ধ করে রিয়া সটান চাইল আমার দিকে । রাগের আঁকিবুকিতে গনগনে হয়ে উঠল ওর মুখটা । উষ্ণ গলায় বলে উঠল , “ তুমি আমার কোন কথাই শোন না মন দিয়ে । আর কিচ্ছু বলব না তোমাকে … “ , বলতে বলতে ঝটিতে খাট থেকে নেমে পড়ল ।
        আমি প্রমাদ গুনলাম । আসলে রিয়া এত কথা বলে আর এত বিষয় বৈচিত্রে সেসব ভরপুর থাকে , আমি সবটুকু ঠিকঠাক ধরে রাখতে পারিনা মাথায় । পরে কথায় কথায় সেটা প্রকাশ হয়ে পড়লে ও খুব হার্ট হয় । 
       আঁতি পাঁতি করে খুঁজছিলাম অর্ক আর তার মাকে । মনে পড়ল । আমার ছেলের সঙ্গে পড়ে।একই স্কুলে নয় , এক কোচিং ক্লাসে । ছেলের সঙ্গে অর্কর যত না বন্ধুত্ব ,  রিয়ার সঙ্গে অর্কর মায়ের বন্ধুত্ব তার চেয়ে বেশি । সদ্য সদ্য গড়ে ওঠা বন্ধুতার  গাঢ়ত্ব যে ক্রমশই বাড়ছে ইদানীং মাঝে মধ্যেই সেটা মালুম হচ্ছিল । 
.       মা , বাবা ওপরের ঘরে , ছেলে কোচিংএ । চোখে দুষ্টুমি নিয়ে রিয়ার একটা হাত ধরে টান দিলাম । আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল । দুহাতের বেষ্টনীতে জড়িয়ে নিলাম ওকে । ঘটনার আকস্মিকতায় লালচে হয়ে উঠল ওর মুখ । ছদ্মরাগে বলে উঠল , “ ছাড়ো ! আমার কথার কোন গুরুত্বই নেই তোমার কাছে … “ 
     ওর গাল টিপে বললাম , “ তোমাকে রাগাচ্ছিলাম । অর্ক ছেলের বন্ধু । আমি জানি । “ 
        পলকেই উজ্জ্বল ওর মুখ । আমার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল । উৎসাহিত গলায় বলল , “ শ্রীতমা , মানে অর্কর মা একদম তোমার মত । “
                                                                           
     
                 মজার গলায় বললাম , “ তুমি কি অর্কর মাকে পুরুষালি বলছ না কি আমাকে মেয়েলি বলছ ?“ 
      “ ধ্যাত ! “ , হেসে ফেলল রিয়া , “ শ্রীতমা খুব সুন্দর দেখতে । আমি বলতে চাইছি ও তোমার মতই রোম্যান্টিক  । “ 
      “ কী রকম ? “ , গলায় বাড়তি উচ্ছাস ফুটিয়ে জিগ্যেস করি ।
      “ এই তো , কাল ছেলেদের কোচিংএ পৌঁছে ফেরার মুখে ঝড় উঠল রাস্তায় । দেখতে না দেখতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল । আমি তো ব্যাগ হাতড়ে ছাতা খুঁজছি , শ্রীতমা বলে উঠল – ‘ ছাতা খুঁজছ কেন ? বছরের প্রথম বৃষ্টি । ভিজতে ভালো লাগে না তোমার ? ‘ 
     “ আমি তো থ ! বলে ফেললাম , ‘ একদম পোষায় না গো । ভিজলেই ঠাণ্ডা লেগে যায় ।‘ বেচারি আর কী করে ? বাধ্য হয়ে বের করল ওর  ছাতাটা  … “ 
      শুনতে থাকার ভঙ্গি করে আমি সন্তর্পণে উল্টে যাই থ্রিলারের আর একটা পাতা । রিয়া সোৎসাহে বলতে থাকে , “ … তোমার সঙ্গে আরও মিল আছে । ও তোমার মতই সফট হার্টেড , কাউকে কটু কথা বলতে পারে না । অত বড় চাকরি করে , অথচ টাকা পয়সার সব ঝামেলা ওর বর সামলায় ; তোমারটা যেমন সামলাতে হয় আমাকে । আর তোমার মতই বই পড়ার নেশা । কত যে বই কেনে …” 
       বলতে বলতেই হোয়াটস অ্যাপ থেকে ভদ্রমহিলার ডি পি টা বের করে আমার সামনে ধরে বলে ওঠে , “ দেখ , কী সুন্দর দেখতে ! তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে একেবারে রাজযোটক হত । “ , হাসতে  হাসতে একেবারে গড়িয়ে পরে রিয়া ।
       চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে এমন বিষম খেলাম মুখের থেকে চা ছিটকে বই , বিছনা সব ভিজে গেল । অপ্রতিভ মুখে আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে “ সরি “ “ সরি “ বলতে থাকে রিয়া ।
      অনেক রাতে আবার বৃষ্টি নামল । ঘুম আসছিল না । একটা সিগারেট ধরিয়ে পিছনের রেলিং ঘেরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আছে চারদিক । সেই আবছায়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একটা ছবি … মফস্বল শহরের তুমুল বৃষ্টি নামা রাস্তা দিয়ে সামনে একটা মেয়েকে বসিয়ে উদ্দাম গতিতে সাইকেল চালাচ্ছে ছেলেটা  … এলোমেলো হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ওদের এলোমেলো কথা … হাসি … ওরা ভিজে যাচ্ছে প্রথম ভালবাসার বৃষ্টিতে … আচ্ছা ,  অর্কর মাকেও কি  রিয়া তার বরের গল্প করেছে  ? …
     চমকে উঠলাম সহসাই । গাল বেয়ে লোনা জলের স্বাদ ঠোঁটে … নাগরিক রাত্রি  ভিজছে ভালবাসার বৃষ্টিতে । 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন