শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

অন্বেষা রায়

পাপোশ
-------------

------------------

(১)

এতো রাতে পার্থদা কে দেখে আমি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।যদিও রাত দশটা টা আমার বা পার্থদা কারো কাছেই তেমন রাত নয় তবু দিদির পাল্লায় পরার পর পার্থদা এখন সাহেবি রুটিন মেনে চলে।বলা ভালো মেনে চলতে বাধ্য হয়।দিদি বরাবরই একটু অন্যরকম।আমার মতন অগোছালো, আপাটে নয়। পড়াশুনো বা ক্যারিয়ারের ব্যাপারেও আমার মতন আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলেমেয়ের দেখাদেখি গড্ডলে গা ভাষায়নি। একটা নামকরা কোম্পানিতে  চাকরি করে। ইন্টিরিয়র ডেকোরেশন। তবে বছরখানেকের মধ্যেই যে নিজের ব্যবসা শুরু করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।দিদি তার ভাইয়ের ঠিক উল্টোটি, উদ্যোগী মহিলা।
পার্থদার হাতে একটা পেল্লাই প্যাকেট। মুখ চিন্তিত।
গত ছ মাস ধরে আমি আর দিদি এক শহরে।দিদিই আগে এসেছে তারপর গুঁতিয়ে নিয়ে এসেছে আমাকে।প্রবাসে আত্মীয়স্বজন ঘরের কাছে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।তবে এক্ষেত্রে সৌভাগ্যের সুবিধেটুকু যে পার্থদার দিকেই বেশি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।পার্থটা সাদামাটা, অলস,ভালোমানুষ। দুজনের মধ্যে আলস্যগত মিল দেখে,আর জন্মে আমি পার্থদারই ভাই ছিলাম কিনা এই বিষয়ে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।
পার্থদা আমার হাতে প্যাকেটা ধরিয়ে বলল,
"একগ্লাস জল দে তো।"
বুঝলাম কেস সিরিয়াস।জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে প্যাকেট ফাঁক করে দেখলাম ভেতরে একটা পাপোষ। টুকটুকে লাল, পুরু, নরম বেশ জমকালো একখানা পাপোশ।গায়ে আটকানো প্রাইস ট্যাগের আট পাঁচ শূন্য সংখ্যাটা আমাকে চমকে দিলো।
"সাড়ে আট শ টাকার পাপোশ! "
"ওটা বাতিল"
জলটা গিলে, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কোনোক্রমে বলল পার্থদা।মার্চ মাসে রাত্রিবেলা পুনে শহরে এতো গরম পড়ে না যে রুমাল দিয়ে ঘাম সাফ করতে হবে।তারমধ্যে পার্থদা এসেছে বাইকে।আমার আর দিদির বাড়ি বাইকে দু মিনিটের পথ। পার্থদা ভয়ে ঘামছে।
"বাতিল কেন?"
আমি কৌতুহল চাপতে পারছিলাম না।

"বলেছিলো কালচে লাল।দেওয়াল আর পর্দার সাথে নাকি সেটাই মানানসই হতো।আগামীকাল  বস আসছেন দিল্লি থেকে।লাঞ্চে তার নেমতন্ন আমাদের বাড়িতে।সেই উপলক্ষ্যে গত সাতদিন ধরে ঘর সাজানো চলছে।ওয়ালপেপার, আলো, ল্যাম্পপশেড, শো পিস, কার্পেট এবং পাপোশ।ঘরের বাইরে একরকম,ভেতরে অন্যপ্রকার, বাথরুমের সামনে একজিনিস তো বাথটাবের পাশে আরেক।সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ বুঝলি। তা সবই যাহোক করে তোর দিদি দিব্যি ম্যানেজ করে ফেলল কিন্তু ঝামেলা হলো ডাইনিং লাগোয়া বারান্দায় যাওয়ার মুখে।মানে সেইখানকার পাপোশের রঙ কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না।আমি বলেছিলাম উল্টোদিকের সাই স্টোর্সে একবার দেখো।তা সে কথা শুনে এমনভাবে তাকাল যে.....
পার্থদা মাঝপথে থেমে যায়।জানে আমি বুঝবো।মাঝেমধ্যে আমার ঘর গোছাতে আসে দিদি। চেয়ারে স্তূপীকৃত জামাকাপড়, তিনদিনের না তোলা বাসি বিছানা বা বিছানায় পড়ে থাকা ভেজা তোয়ালে দেখলে দিদি অমন চোখে তাকায়।শিরদাঁড়ায় ছ্যাঁকা লাগানো দৃষ্টি।
জলের গ্লাসটা পুরো শেষ করে পার্থদা যা বললো তার সং ক্ষেপে কিছুটা এইরকম।

দিদির আদেশানুসারে পার্থদা একখানা ডাকসাইটে শপিং মলে গিয়ে এই পাপোশ কিনে আনে।দিদি দেখামাত্র নাকচ করে এবং পালটে মেরুন রঙের পাপোশ কিনে আনতে বলে।দিদির দেওয়া রঙের স্যম্পেল মিলিয়ে( এই স্যাম্পেল আগে কেন দেয়নি জাতীয় প্রশ্ন করার দুঃসাহস বলাই বাহুল্য পার্থদার হয়নি।)  পার্থদা সাই স্টোর্স থেকে সাড়ে তিনশ টাকায় চমৎকার একটি পাপোশ পেয়ে যায়।পার্থদার প্ল্যান ছিল শপিং মলে গিয়ে আগের জিনিসটা ফেরত দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে নেবে কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে আরেক ঝামেলা।পাপোশ টা কেনা হয়েছে যেখান থেকে সেখানে সেল চলছিল।বড় বড় করে লেখা আছে কেনা জিনিস ফেরত হবে না।পার্থদা আগেরবার লেখাটা খেয়ালই করেনি।কিন্তু সাড়ে আটশো টাকার জিনিস নিজের বোকামির জন্য ফেরত হয়নি একথা পার্থদা মরে গেলেও দিদির সামনে বলতে পারবে না।অতএব......
পার্থদা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে পাপোশ এবং আমার দিকে তাকায়। 
"অসম্ভব! আমি এতো টাকা দিয়ে পাপোশ কিনতে পারবো না।তোমার বউ, তোমার পাপোশ তুমি সামলাও।"
আমি ঝামেলা নামাবার চেষ্টা করি।
"আহ!  টাকা কে চাইছে তোর কাছে।তুই শুধু জিনিসটা রাখ তোর জিম্মায়।জানিসই তো তোর দিদিকে।এই পাপোশ নিয়ে ঘরে ঢুকতে পারবো আমি?  "
"আর দিদি আমার ঘর গোছাতে এসে যখন দেখতে পাবে?  তখন? আমি কি মনে করে রেখে দেবো কোথায় গুজেছি তোমার পাপোশ? "
আমি কিছুতেই রাখবো না ওটা।
"আরে ধূর! এটা একটা প্রব্লেম হলো? তুই ওটা আত্রেয়ী কে গিফট করে দে।"
পার্থদা সমাধানের সুরে বলল।আত্রেয়ী আমার বান্ধবী। একই অফিসে চাকরি করি।আগামী দুবছরের মধ্যে বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে।আমি আঁতকে উঠি।
"আত্রেয়ী কে গিফট করবো মানে!!!!"
"আহ! বলছিলি না কাল আত্রেয়ী দের বাড়ি তোর নেমতন্ন।তা খালি হাতে তো যাবি না, এটা দিয়ে দে।"
পার্থদা সহজ সুরে বলে।আমি থমকাই।আত্রেয়ীর ঘর সাজানোর শখ আছে তবে ওর থেকেও এব্যাপারে ওস্তাদ ওর ছোটমাসি।সে মহিলার বাড়ি নাকি ছবির মতন সুন্দর।ছোটোমাসির সাথে দেখা হলেই কিছু না কিছু ঘর সাজানোর জিনিস উপহার দেয় আত্রেয়ী। আগামীকাল এই ছোটোমাসির অনারেই আমার নেমতন্ন।পাপোশটার গায়ে হাত বোলালাম।খাসা জিনিস।আত্রেয়ীর মাসিকে দিলে কি খুব বোকা বোকা হবে?

(২)

"পাপোশ! তুমি কি পাগল হয়ে গেছো অম্লান?  পাপোশ একটা গিফট হতে পারে?"
রাগত স্বরে ফিসফিস করে বলল আত্রেয়ী। ছোটমাসি পাশের ঘরে।বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই আত্রেয়ী প্যাকেটটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে ওটা কি।পাপোশ শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
"তুমি জিনিসটা একবার দেখো।"
আমি বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করি।ব্রাউন পেপারের প্যাকেট থেকে পাপোশটা বার  করতেই কেন জানিনা বুকে বড় মায়া হলো।আহারে বেচারি পাপোশ।এতো সুন্দর,এতো মূল্যবান, কুলীন দোকানে থেকেও দেখো কেমন গড়াগড়ি খাচ্ছে।কেউ ভালোবেসে আপন করার নেই।সবই কপাল।পাপোশ হোক আর মানুষ।ভাগ্যের আগে কারো জো চলবে না।
"ওয়াও!!!"
হঠাৎ অচেনা স্বরে আমার আগডুম বাগডুম চিন্তায় ছেদ পড়ে।চমকে দেখি দরজায় ছোটমাসি।দৃষ্টি আত্রেয়ীয়ের হাতে ধরা পাপোশে।
"বিউটিফুল ডোরম্যাট! কোথা থেকে নিলি?"
আমি গর্বিত চোখে আত্রেয়ীয়ের দিকে তাকাই।

--------------------
পার্থদাকে ফোনে ঘটনাটা বলাতে, পার্থদা তো হেসে খুন।সামান্য একটা পাপোশ নিয়ে কি কান্ড অ্যা! খুশি খুশি গলায় বলল, 
"একদিন চলে আয় দুজনে আমাদের বাড়ি।অনেকদিন জমিয়ে আড্ডা দিই না।"
দিদির বাড়িতে আড্ডা মানেই জমাটি খাওয়া দাওয়া।পার্থদার প্রস্তাবে আমি উৎসাহী হয়ে উঠি।আর এই পাপোশ বিদায়টাও সেলিব্রেট করা দরকার।যতই হোক এটা আমার আর পার্থদার অন্যতম গোপন মিশন।

 পরের রবিবার সন্ধ্যেবেলা যখন দিদির বাড়ি পৌঁছলাম ততক্ষণে আত্রেয়ী এসে গিয়েছে।গোলাপি আর তুঁতে একটা লং স্কার্ট আর টপে দুর্দান্ত দেখাচ্ছে ওকে।আমাকে দেখে মুচকি হাসলো।দিদি দেখলাম খুশিতে ঝলমল করছে।আমাকে দেখে প্রায় উড়ে এলো।

" আত্রেয়ী তোর মতন আর্টিস্টিক্যালি চ্যালেঞ্জড ছেলেকে  কি করে পছন্দ করলো রে! "
"মানে?"
"লাল ডোরম্যাট টা দেখেছিস?তোর পছন্দ যে নয় সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না।"
আমি আঁতকে উঠে আত্রেয়ীয়ের দিকে তাকাই।
দিদি কাগজের ব্যাগ থেকে টুকটুকে লাল,পুরু, নরম পাপোশটা বার করে মুগ্ধ চোখে দেখছে।

"আরে এটা এতো বড়ো কিছুতেই মাসির ব্যাগে ধরলো না।তো মাসি বলল আতু তুই রেখে দে জিনিসটা।নেক্সট টাইম এলে দেখা যাবে নিতে পারি কিনা। আর নেক্সট টাইম।মাসি তো আট মাসের জন্য  ছেলের কাছে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছে তারপর মেয়ের কাছে প্যারিস যাবে।ফিরতে ফিরতে ভুলেই যাবে পাপোশের কথা।তাই ভাবলাম দিদি ঘর সাজাতে ভালোবাসে..."

আত্রেয়ী চুপ করে যায়।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।কার কপালে যে কী লেখা আছে কে বলতে পারে।সবই ভাগ্য।পাপোশ হোক মানুষ।


------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন