শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

মানসী গাঙ্গুলী

 মৃত্যুর বিনিময়ে


        জমিদার বংশে জন্ম মায়ার,যদিও রক্তেই কেবল জমিদারী এখন, তালপুকুরে ঘটি ডোবে না।বিশাল বাড়ীটাও আজ জরাজীর্ণ, পাঁচশরিকে ভাগ হয়েছে,যে যার নিজের অংশটুকু প্রয়োজনমত ব্যবস্থা করে নিয়েছে, কেবল মায়ার বাবা গোপাল নন্দী পারেননি নিজের অংশটুকু সারিয়ে নিতে,তাই সেটা পোড়ো হয়ে আজ বসবাসের অনুপযুক্ত। এখন তারা ভাড়া বাড়ীতে থাকে, অল্পজায়গায় খুবই কষ্ট করে।পুঁজিও বিশেষ নেই,যেটুকু বা ছিল,মায়ার বাবা মদ আর জুয়ায় তাও শেষ করে ভিটেমাটি চাঁটি করে এক সাইকেল সারানোর দোকান করে এখন সংসার প্রতিপালন করেন।সংসার বলতে তিনজন,তিনি নিজে,স্ত্রী ও মেয়ে মায়া।
         দোকান তো হল,জমিদারী রক্ত,নিজে তো এসব কাজ জানেন না,তাই কাজজানা একটি ছেলেকে রাখতে হয় দোকান চালাতে।দোকানঘরের ভাড়া,বাড়ী ভাড়া,কর্মচারীর মাইনে,সব দিয়ে যা থাকে তারও কিছু যায় মদের দোকানে।নেশা তো আর ছাড়া যায় না,না?এরপর সংসারটা চলবে কিসে?তাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মায়াকে টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে হয়।টিউশন বেশ কিছু মায়া জোটাতে পেরেছিল পাঁচজনের দয়ায়।টিউশনের সাথে সাথে আরো কিছু পয়সা রোজগারের ধান্দা সে শিখে গিয়েছিল সেই ছোট্ট বয়স থেকেই।দেখতে মায়া বেশ চটকদার,আর যত বড় হতে লাগল,ওর চাহনি ঘায়েল করত অনেক পুরুষকেই।এসবের ফায়দাও মায়া লুটে নিতে শিখে গিয়েছিল বেশ তাড়াতাড়িই।এভাবে সংসারটা কোনোরকমে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল।
           গোপাল নন্দী ইদানীং মদ খেতেন না,মদই তাঁকে খেত।তাই লিভারের বারোটা,সঙ্গী অপুষ্টি তাকে হাওয়ার ভেলায় চাপিয়ে পাড়ি করিয়ে দিল চিরতরে,সেই নাম না জানা দেশে।মা-মেয়ের সংসার,চলে যায় কোনোরকমে।এরই মধ্যে মায়া ঘায়েল করতে পেরেছিল ওর বড়লোক বন্ধুর দাদা নির্মাল্যকে,ইলেকট্রনিকস গুডসের দোকান,সুপুরুষ চেহারা,মায়ার চোখের মায়ায় ধরা দিল সে।এরপর বাড়ীতে আসা-যাওয়া,মায়ার মা ও নির্মাল্য এলে তাকে চা-খাবার দিয়ে কোনো অছিলায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান ওদের ঘনিষ্টভাবে মেলার সুযোগ করে দিয়ে।এমন ছেলে তো হাতছাড়া করা যায় না,যেমন করেই হোক গেঁথে তুলতে হবে।সম্পর্ক অনেকদূর এগোয়,জন্মদিনে,পূজোয় সোনার গয়না আসে মায়ার জন্য,আর এত ভদ্র ছেলে যেসে অন্য কোনো মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকায় না।শীঘ্রই বিয়ে করতে চায় সে।
            মায়ার এদিকে পুরুষ ঘায়েল করা অভ্যাসটা গেল না,এর সাথে তাও চলতে লাগল।যাতায়াতে কিছু কথা নির্মাল্যের কানে আসে,সে গায়ে মাখে না কিন্তু এরপর একদিন মাঝে মায়ার জন্য মন খুব চঞ্চল হওয়ায় সে হঠাৎ করে কিছু না জানিয়েই মায়ার বাড়ী আসে আর দেখে অন্য এক পুরুষের সাথে মায়া হেসে হেসে গল্প করছে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আর যথারীতি ওর মা বাড়ী নেই।নির্মাল্যর খারাপ লাগলেও তা বুঝতে দেয়নি ও, কিন্তু মনে তার অশান্তি দানা বাঁধতে শুরু করেছে।এর বেশ কিছুদিন পর যখন নির্মাল্য নিজেই নিজেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করতে পেরেছে, বাইক নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মায়াকে দেখতে পায় সেই ছেলেটির সাথে।সন্দিগ্ধ হয়ে দূর থেকে ওদের ফলো করে।ওরা একটা পার্কে ঢুকলে নির্মাল্য ওদের পিছু নেয়,কিছুদূর থেকে দেখে,একটা গাছের ঝোপের আড়ালে ওরা গিয়ে বসল।মায়া ছেলেটির হাত জড়িয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে তার কাঁধে মাথা রাখল আর ছেলেটি পিছন দিয়ে একহাতে তাকে বেস্টন করে।নির্মাল্য আর নিজেকে সংযত করতে পারে না কিন্তু তার শালীনতা বোধ সেইসময় তাকে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেয় না,নীরবে চলে আসে দূর থেকে সব দেখে।বাড়ী ফিরে চুপচাপ থাকে সে, এমনিতেও সে একটু চুপচাপ প্রকৃতিরই ছেলে,কিন্তু তার মনের ভেতর যে তান্ডবলীলা চলছিল সেদিন তা তার মুখ দেখে বা আচরণ দেখে কারো বোঝার উপায় ছিল না।সারারাত ঘুম নেই,তোলপাড় বুকের মাঝে।নিজের একান্ত আপনার জনকে অন্যের কন্ঠলগ্না দেখলে কারই বা ভাল লাগে।
           পরদিন মায়ার কাছে এসে সে কথা তুললে,মায়া অস্বীকার করে যদিও সেই একই শাড়ী সেদিন তার পরনে,আর তাই নির্মাল্য আরো বেশি নিশ্চিত।কিছু তর্কবিতর্ক হয় দুজনের মাঝে।মায়ার মা বোধহয় দুজনকেই হাতে রাখতে চেয়েছিলেন,যদি একজন ফসকায় তো আরেকজন থাকবে।বস্তুত,দুজনের সাহায্যে সংসারে বেশ স্বচ্ছলতা এসেছে।
            শান্ত স্বভাবের নির্মাল্যের বুকের ঝড় বেড়েই চলেছে।যাকে বিয়ে করে সুখের সংসার পাতবে বলে সুখস্বপ্ন দেখেছিল সে,যে মায়ার মায়ায় সে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিল, তার কাছ থেকে এই প্রতারণা,এই আঘাত সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি।অহরহ রক্তাক্ত হতে থাকে তার হৃদয়,নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে অবশেষে সে পরাজিত।মায়াকে সে কিছু বুঝতে দেয় না।একদিন সে মায়াকে নিয়ে ঘুরতে যাবে বললে মায়া খুব সাজগোজ করে বেরয় নির্মাল্যর সাথে।ওরা রেলস্টেশনে পৌঁছায়।প্ল্যাটফর্মের একদম শেষের দিকে দাঁড়ালে মায়া সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে নির্মাল্য বলে পিছনে  ভিড় কম থাকবে।
          এরপর ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে নির্মাল্য ট্রেনের সামনে দিয়ে লাইনে ঝাঁপ দেয়।ঢোকার মুখে তখনও ট্রেনের স্পিড যথেষ্ঠ বেশি থাকায় নিমেষে নির্মাল্যর দেহটা দলাপাকানো মাংসপিন্ডে পরিণত হয়।স্টেশনে উপস্থিত সকলের চোখের সামনে এমন ঘটনায় সবাই হতচকিত আর মায়া অচৈতন্য হয়ে আছডে পড়ল প্ল্যাটফর্মে।
            নির্মাল্য কিন্তু তার ভালবাসাকে ঠকায় নি।মনে মনে প্ল্যান করেছিল যখন নিজেকে শেষ  করে দেবে তখনই সে মায়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা ব্যাঙ্কে মান্থলি ইনকাম স্কীমে রেখে দেয় যাতে আজীবন তার অর্থকষ্ট না হয়।
            সুস্থ হতে মায়ার সময় লেগেছিল বেশ।এরপর সে সাদা থান পরে তপস্বিনীর বেশ ধরে,কোনো সাজগোজ, গয়নাগাটি কিচ্ছু না।তার প্রকৃতিরও আমূল পরিবর্তন হয়।নিজেকে সে গৃহবন্দী করে ফেলে।এতদিনে বোধহয় নির্মাল্যকে সে প্রকৃত ভালবাসতে পারল।
            মৃত্যুর বিনিময়ে ভালবাসাকে জয় করল নির্মাল্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন