রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

শৌনক দত্ত



কেবলি ছবি...

বাতাসে পুজো পুজোএকটা গন্ধ ।পাড়ায় পাড়ায় মন্ডপ তৈরীর কাজ চলছে ।পাল তার নিপুন হাতে খড়ের উপর মাটির প্রলেপ লাগাচ্ছে ।তৈরী হচ্ছে মূর্তি ।এমন দিনগুলোয় সাম্য অদ্ভুত একটা গন্ধ পায় বাতাসে ।ঢাক কাঁসরের আওয়াজ শুনতে পায় ।এটা কেন হয় সাম্য ঠিক বুঝে না ।
ছোটবেলা চুপিচুপি চলে গেছে ।ছোটবেলায় মনে হতো ইস কবে যে বড় হবো ।আর বড় হবার পর মনে হয় ধ্যুর ছোটবেলাটাই ভাল ছিলো ।সাম্যের ও আজকাল তাই মনে হয় প্রায়ই ।


সাম্য পেশায় সাংবাদিক ।যার কাজ খবর তৈরী করা ।মাঝে মাঝে সাম্যের খুব ইচ্ছা করে খবর হতে কিন্তু ছাপোষা জীবনে সে সুযোগ আর কোথায় ?আজ বিখ্যাত অভিনেত্রী ও ওমেন্স ওয়ার্ল্ডের দলনেত্রী পর্নশ্রী পর্নার নির্বাচনী প্রচারনা ।স্পেশাল কভারেজ করতে সাম্যকে সিলেক্ট করা হয়েছে ।তাই ভাবনাটাকে সিঁকেয় তুলে সাম্য ছুটলো পর্নার প্রেস কনফারেন্সে ।গাড়িতে উঠে বসেই সাম্যের মনে হলো পল্লবীর কথা ।পল্লবী সাম্যের স্কুলজীবনের বন্ধু ।অভিনেত্রী পর্নাকে দেখলেই সাম্যের পল্লবীর কথা মনে পড়ে ।অনার্স ফাস্ট ইয়ার পর্যন্ত চিঠিতে যোগাযোগ ছিলো দুজনের ।তারপর সময়ের দুরন্তপনায় সপ্তাহ থেকে মাস ।মাস থেকে বছর ।বছর থেকে যুগ ।যোগাযোগহীন আজ কেবল সম্পর্কটা খোঁজখবরহীন স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে ।কোথায় আছো পল্লবী সাম্যের --- একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে । প্রেস কনফারেন্সে পর্না বেশ সপ্রতিভ ছিলো ।বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আর কুশলী কথাবার্তায় প্রমান করতে পেরেছে সে যেমন দক্ষ অভিনেত্রী তেমনি ভাল জননেতাও হতে পারেন ।সাম্যের কয়েকটি প্রশ্নের চমত্‍কার উত্তর দিয়েছে পর্না ।প্রেস কনফারেন্স শেষ করে বের হবার পথে একটা মেয়ে সাম্যকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলো যাতে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা 'যাবেন না কথা আছে ।পর্না', সাম্য অবাক হয় ।দেখতে দেখতে সব সাংবাদিক বেরিয়ে যায় ।সাম্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ।
আমি যদি ভুল করে না থাকি আপনি নিশ্চয় সাম্য?
-হ্যাঁ। কিন্তু.. 
আপনি অলক স্যারের কাছে পড়তেন? 
-হ্যাঁ। 
আপনি সিসির স্টুডেন্ট? 
-হ্যাঁ। 
ডাক নাম তুলতুল? 
-হ্যাঁ।
 
তুলতুল কেমন আছিস ? ভাল কিন্তু আরে গবেট আমি পল্লবী ।তোর পল ।চিনতে পারলি না তো ? আমি ভাবতাম জানিস ।ইনফেক্ট আসার সময় ও তোর কথা ভাবছিলাম । ন্যাকা !এতবছর খোঁজ নেই খবর নেই আমায় তুই ভাবিস ।ইয়ার্কি না রে সত্যিই । বিয়ে করেছিস ? এখনো না । কেন ? তুই ও তো করিসনি । তোর মামনি,বাবু কেমন আছে? মা !গতবছর চলে গেলেন আর বাবু আছেন আমার সাথে এখানেই । ইস !তোর মার হাতের আচার আর সর্ষে ইলিশ আজও খুব মিস করি ।কি হয়েছিলো রে ? হঠাত্‍ই !কিছু করতেই পারিনি রে ।আর তোর বাবা মা ? এইতো আছে । 

পরেদিন..  সাম্যের ঘুম ভাঙে একটা মোবাইল কলে ।পর্নার আর সাম্যের ছবি সহ আজকের ব্রেকিং নিউজ 'পর্না চায় মুকুটে নতুন পালক 'খবরটা শুনেই সাম্যের মেজাজটা বিগড়ে যায় ।এসবের কোন মানে হয় ।ভাবতে ভাবতে সে উঠে জানালার কাছে দাঁড়ায় ।মোবাইলটা আবার বেজে উঠে সশব্দে ।এক এক করে যত চেনাজানা মানুষ আছে সবার কল আসে ।বিষয় একটাই পর্নার সাথে তার ছবি ।সাম্যের বিরক্তি বাড়ে।অসহ্য লাগে এইসব ।দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতেই পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা যে এই চারবছরে একটি কথাও বলেননি তিনিও আজ হাসিমুখে সাম্যকে দেখে বিগলিত গলায় কুশল জানতে চাইলেন ।সাম্য অবাক হলেও বুঝলো ভদ্রমহিলার চোখে মুখে কটাক্ষের ইঙ্গিত ছিল ।সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সাম্যের মনে হলো সবাই তাকেই দেখছে ।সবাই মুচকি মুচকি হাসচ্ছে ।বাসে উঠতেই সাম্যের মনে হলো সব যাত্রীই তার দিকেই তাকিয়ে ।কেউ কেউ নিচু স্বরে কথা বলছে তারা কি তার আর পর্নার রিপোর্টটার কথা বলছে ?ভাবতেই সাম্যের কেমন অস্বস্তি বেড়ে যায় পলকেই।সাম্য মনে মনে ঠিক করে অফিস গিয়েই হতচ্ছাড়া এডিটরকে সে একহাত নেবে ।এইসব ছেলেমানুষীর কি অর্থ ।গতকাল ফিরে এসে না হয় একটু আবেগেই সে বলেছে হট সেনসেশন পর্নশ্রী পর্না তার স্কুলজীবনের বন্ধু ।তারা পাশাপাশি বাসায় থাকতো অনেক বছর ।ওর বাবা বদলি হয়ে চলে যাবার পর ও তাদের যোগাযোগ ছিল চিঠিতে ।পর্না আর সে ছিলো হরিহর আত্মা তার মানে কি ওগুলো খবর হতে পারে।যখন পর্না জাতীয় নিবার্চনের প্রার্থী তখন এইধরনের খবর জনগনের মনে কি প্রভাব ফেলবে!!তাছাড়া পর্না ই বা কি ভাবছে ।

সাম্যের অস্থিরতা আরো দ্বিগুন বেড়ে যায় ।পর্নাকে সব জানিয়ে বোঝানো উচিত কিনা ভাবতে ভাবতে সাম্য মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে ।কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবার পকেটে চালান করে আবার বের করে ।সাম্যের ভেতর ভেতর রাগ হয় ।ডিজিট ডায়াল করে কেটে দেয় ।একভদ্র লোক ভরাবাসে অনেক সমীহ করে সাম্যকে তার সিটে বসতে দিয়ে নেমে যান ।সাম্য অবাক হয় এতলোক থাকতে তাকেই কেন বসতে বললেন ভদ্রলোক ।তবে কি তিনিও খবরটা পড়েছেন ?সাম্যের ভেতরের সাম্য বলে আরে সাম্য সবাই কি আর এত ভেতরে পাতা পড়ে ।আবার মনে হয় এই খবরটা তো ভেতরে আসার কথা না তাছাড়া এইরকম নির্বাচনী সময় মানুষ খবর একটু বেশিই পড়ে ও দেখে ।এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সাম্যের ইচ্ছে করে এখানেই নেমে যায় ।একটা পেপার কেনে কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার আর নামা হয়না ।অন্যদিন এমন হয়না আজ সাম্য বার বার ঘড়ি দেখছে ।আশেপাশে সবাইকে দেখছে ।আজ জ্যাম অন্যদিনের তুলনায় নেই বললেই চলে অথচ সাম্যের মনে হয় আজ জ্যাম সর্বকালের সেরা জ্যাম । 

বাস থেকে নেমে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে সাম্য অফিস ঢুকে । 'কিরে মামা আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে ।কি ব্যাপার।'রাহাতের এই কথাটা অন্যদিন হলে সাম্য সহজভাবেই নিতো কিন্তু আজ মনে হলো রাহাতের কথায় খোঁচা আছে ।এডিটরে রুমে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখে সেখানে একটা প্ল্যানিং মিটিং চলছে ।


তাই গজগজ করতে করতে সাম্য নিজের টেবিলে এসে বসেই আজকের পেপারটা মেলে ধরে চোখের সামনে ।প্রথম পাতাতেই তিনকলাম জুড়ে রিপোর্টটা খুব মনোযোগ সহকারে পড়ে সাম্য ।শেষ থেকে শুরু পর্যন্ত কোথাও তার কথা নেই ।অবাক হয়ে ছবিটায় চোখ বোলায় সাম্য ।দেখে হাস্যোজ্জ্বল পর্না।প্রেস কনফারেন্সের শেষে হল থেকে বেরোচ্ছে ।পর্নার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাম্যের মুখটা পর্নার ডান ঘাঁড়ের উপরে এমনভাবে এসেছে যেন সাম্যের থুতনিটা পর্নার ঘাড়ে রাখা ।সাম্য নিজের ছবি দেখে নিজেই হাসে আর খবর না হওয়া খবর নিয়ে তার নিজের বাড়াবাড়ি রকম টেনশনের জন্য একাই লজ্জা পায় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন