রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

অমিভাভ সরকার

                                                                                          


বেজন্মা


শারীরিক সক্ষমতা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা পর রিক্রুটিং অফিসারের সামনে দাঁড়ায় ছয় ফুটের মতো লম্বা, কুড়ি-বাইশ বছরের শীর্ণকায় যুবকটি। 

“আপনার নাম?”

“কৃষাণ”।  

“পদবী কী?”

“জানি না স্যার”। 

“মানে?’  যুবকটির মুখের দিকে একবার তাকায় অফিসারটি।

“মা, বাবার খবর জানি না স্যার, তাই…”

“ঠিকানা একটা আছে তো? নাকি সেটাও নাই?” 

“ঠিকানা নেই স্যার...মানে, আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি স্যার। এখন সেখানে থাকতে দেয় না স্যার”।

“বুঝলাম, তা এখন কোথায় থাকা হয়?”  

“আন্দুল স্টেশনে একটা চায়ের দোকানে কাজ করি আর রাতে স্টেশনে কিম্বা কাছেই একটা ধাবায় থাকি স্যার”। 

যুবকের কথা শুনে পেছনে সারিতে দাঁড়ানো চাকরি প্রার্থীরা কেমন যেন অবজ্ঞার চোখে দেখছিল তাকে। সকলকে অবাক করে শেষ পর্যন্ত কয়েকজনের সঙ্গে কৃষাণকে সিলেক্ট করা হলো। পরেরদিন রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে সকালে হাওড়ায় পৌছাতেই সকলের সঙ্গে ট্রেনে চাপিয়ে দেওয়া হলো তাকে।                 

পাহাড়ের ওপরে এক সমতল ক্ষেত্র, উঁচু পাঁচিলের অবরুদ্ধ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো কৃষাণকে। শুরু হলো তার ট্রেনিং…। প্রথম প্রথম দুর্বল শরীরে এই কঠিন ট্রেনিং নিতে খুবই কষ্ট হতো তার। মাঝে মাঝে মনে হতো, এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। সারাদিনের শেষে রাতে টলতে টলতে বিছানায় এলিয়ে পড়তো, আর সাড় থাকতো না তার। মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতেও ইচ্ছে করতো তার। কিন্তু এই কষ্টের মধ্যেও মাথার ওপর ছাদ, চারবেলা খাওয়া, নিজের বিছানা... পালিয়ে গেলে তো সেই তো স্টেশন অথবা ধাবায় রাত্রিবাস...। এই সব সাতপাঁচ ভেবে পালানো হয় না তার। কথায় বলে, ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়’। ধীরে ধীরে সব সহ্য হয়ে গেল, সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুও জোটে…। ট্রেনিং শেষ করার পর তাকে পাঠানো হল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্তে। হিলি, বালুরঘাট মহকুমায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের স্থলবন্দর এবং সীমান্ত চৌকি। ভারত-বাংলাদেশের বহু মানুষের যাতায়াতের পথ।           

এখানে রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান যৌথভাবে আয়োজন করে ‘ইন্ডিয়ান বর্ডার সিকুরিটি ফোর্স’ আর ‘বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড’। অনুষ্ঠান এলাকায় দুই বাংলার মিলন উৎসবে রূপ নিল। দুই দেশের সাধারণ নাগরিকও সামিল হল এই উৎসবে। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের এক সৈনিক, শামসুদ্দিন কৃষাণের মণিবন্ধে রাখি পরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আজ থেকে আমরা দোস্ত’। সেই শুরু, তারপর থেকে শামসুদ্দিনের ব্যবহারে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেল কৃষাণ। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে শামসুদ্দিনের পরিবারের একসময়ে ভারতেরই বাসিন্দা ছিল। শামসুদ্দিনের আব্বু কলকাতায় কাজ করতেন। দেশভাগের সময় দাঙ্গায় পালিয়ে চলে যান বাংলাদেশে। আজও তাদের অনেক আত্মীয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ভারতে।   

গত দু’বছর একবার তিন-চারদিন ছাড়া কোনও ছুটি নেয় নি কৃষাণ। ঐ তিন-চারদিন আন্দুল স্টেশনের বন্ধুবান্ধব, সিংজী আর ভাবীর সঙ্গে দেখা করেই ফিরে এসেছে। এবারে অফিসার প্রায় জোর করেই একমাসের ছুটি দিলেন।

“যাও একটু দীঘা, দার্জিলিং বেড়িয়ে এসো, তোমার সবসময়ের মনমরা ভাবটা কাটবে। এই মনমরা ভাব নিয়ে ফোর্সে কাজ করে নাকি কেউ ?”

সাধারণত ফোর্সে কেউ ছুটি পেলে যাওয়ার আগে কিছুদিন আনন্দে মশগুল হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষাণ কোথায় যাবে? একবার আশ্রমে যাওয়া যেতে পারে, জানে না সেখানে পরিচিত কেউ আছে কিনা! স্টেশনে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা যায়। তারপর...? একা একা দীঘা… দার্জিলিং? দার্জিলিং গেলে তো বালুরঘাট থেকেই যাওয়া যায়। ভেবে কূলকিনারা পায় না কৃষাণ। একদিন শামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হতেই খুলে বলল তাকে।

ছুটিতে যাওয়ার আগে শামসুদ্দিন ঠিকানা কাগজ দিয়ে বলে, এটা তার 'ফুফু' মানে পিসির ঠিকানা। ফুফুআম্মার অনেকদিন কোনও খবর নেই, যদি সম্ভব হয়, তাহলে যেন একবার ঘুরে আসে। সেই সঙ্গে একটা শাড়িও দেয় ফুফু আম্মার জন্য। কাগজটি পেয়ে খুশী হল কৃষাণ, আপাতত এই কাজ নিয়ে কয়েকদিন সময় কাটানো যাবে।




ছুটি পেতেই মালদায় এসে গৌড় এক্সপ্রেস ধরলো কৃষাণ। পরদিন সকালে শিয়ালদহ নেমে বাসে হাওড়া। সেখান থেকে মেচেদা লোকাল ধরলো কৃষাণ। লোকালেই দেখা হয়ে গেল হকার বন্ধুদের সঙ্গে। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে নামে আন্দুলে। দোকানের মালিক তাঁকে বসিয়ে প্লেটে দুটো বিস্কুট দিয়ে চা দেয়। তাঁর ব্যবহার দেখে একটু অবাক হয়ে যায় কৃষাণ। একসময়ে…, তবু তার দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছেন, তাই বা কম কি! বন্ধুরা কাজে চলে যেতেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নেয়। মিষ্টির দোকানের মালিক তার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কৃষাণ বুঝতে পারে দোকানদার আগের চেহারার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছে। চেনা চেনা লাগলেও তার বর্তমানের স্বাস্থ্য আর সামরিক পোষাক দেখে হয়তো ইতস্তত করছে প্রশ্ন করতে। মনে মনে হাসে কৃষাণ। কিছু না বলে স্টেশনে ফিরে আসে। দুপুর নাগাদ বন্ধুরা ফিরে আসার পর সকলকে নিয়ে একটু দূরে হাইরোডের ওপর সিংজীর ধাবায় যায় কৃষাণ, যেখানে তার রাতের খাবার জুটেছে এতকাল। কৃষাণকে দেখে প্রবীণ সিংজী জড়িয়ে ধরেন। অনেকদিন পর সকলে মিলে হৈ হৈ করে রুটি আর কষা মাংস নিয়ে জমিয়ে বসে। কৃষাণের অনুরোধে সিংজীও বসে পড়েন তাদের সঙ্গে। সবাই চলে গেলে, সিংজীর স্ত্রী, বিদ্যাভাবির সঙ্গে দেখা করতে যায় কৃষাণ। এখানে এসে যদি দেখা না করে খুব কষ্ট পাবে মাতৃসমা তার বিদ্যাভাবী।   


(চলবে )         



  

২টি মন্তব্য:

  1. লেখক কবি হিসাবেই পরিচিত৷ ওনার বাস্তব অভিজ্ঞতা ও গভীর জীবন দর্শণের ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে৷ ওনার গল্পও আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম৷

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনি পড়েছেন জেনে ভালো লাগছে। অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে। সাথে থাকবেন

      মুছুন