বেজন্মা (তৃতীয় পর্ব)
ব্যাকপ্যাক পিঠে চাপিয়ে বেরবার আগে একবার স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে দেখা করে। ভদ্রলোকের জারিজুরিতে আরও একবার চা খেতে হয়। ভদ্রলোক কৃষাণের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। মনে করিয়ে দেন, বাসস্ট্যান্ডে না গিয়ে যেন সিনেমাতলা থেকে বাস ধরে…।
সিনেমাতলায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই লাভপুর যাওয়ার বাস পেয়ে যায়। সকালে ভীড় নেই একদমই। কয়েকটি পরিবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও পুজো দিতে চলেছেন মনে হলো। মেয়েদের হাতে পুজোর থালাও দেখতে পেল কৃষাণ। বাস কিছুদূর এগিয়ে একটা মোড়ে থামতেই হুড়মুড় করে তারা নেমে যেতেই জানলার পাশের সিটের সরে বসে কৃষাণ। সামনের সিটে বসা একজন প্রবীণ সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তারা পুজো দিতে যাচ্ছেন কংকালীতলা'য়।
“সতীর একান্ন পীঠের একপীঠ। এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশটি পড়েছিল। এই শক্তিপীঠের দেবী ‘গর্ভাদেবী’ নামে পূজিত হন সেখানে। মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ড রয়েছে। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ মনে করেন। এই প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, পুজোর পর সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে বলেন, কঙ্কালীতলার কুন্ডের সঙ্গে কাশীর মনিকর্ণিকা ঘাটের সরাসরি সংযোগ আছে”।
সামনের দিকে ঝুঁকে মনযোগ দিয়ে শুনছিল কৃষাণ। মনযোগী শ্রোতা পেয়ে প্রবীণ ভদ্রলোক কৃষাণের পাশে এসে বসেন…।
“বীরভূমের ভূমি, ‘পূণ্যভূমি’। জানেন, একমাত্র এই বীরভূমেই আছে সতীর পাঁচটি শক্তিপীঠ, তা ছাড়া আছে বামাক্ষেপার সাধনপীঠ, তারাপীঠ…, জয়দেব…। এই মাটির টানেইছুটে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ”।
গল্প শুনতে শুনতে বাইরের দিকে তাকায় কৃষাণ। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে মাঝেকাশফুল যেন বিদায়ী শরতের ছোট ছোট সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে মাটিতে। সকালের সোনার ছটায় ছবির মতো দোচালা বাড়ির ছোট ছোট গ্রাম..., সব কিছুই যেন নতুন করে আবিষ্কার করে কৃষাণ। হিমেল বাতাস ঝাপটায় চোখ বুজে আসে তার। হঠাৎ হকারদের চিৎকারে সম্বিত ফেরে কৃষাণের। একটা গঞ্জের মতো জায়গায় থেমে আছে বাস। ভদ্রলোক বিদায় নেওয়ার সময় বলে গেলেন, “এসেছেন যখন, দর্শন করে যান। বলা যায় না আর সুযোগ পাবেন কিনা!” বাইরের দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বোঝা গেল, জায়গার নাম ‘কীর্ণাহার’।
স্টেশনমাস্টার বলেছিলেন, এই কীর্ণাহারের পরেই পরবে 'লাঘাটা ব্রিজ', যাওয়ার সময় বাঁ পাশে কোপাই নদীর তারাশঙ্করের বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসের খ্যাত 'হাঁসুলীবাঁক'। কোপাই আর বক্রেশ্বরের মিলনক্ষেত্রে এই জমিন। পরস্পরের কাছে আসতে বাঁক নিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এক কিলোমিটার যাত্রাপথে শেষে কোপাইকে কন্ঠহার হাঁসুলীর মত বাঁক নিতে হয়েছে। ঠিক যেন উপন্যাসের কাহার করালীর আর পাখি। তাদের মিলনেও বাঁক নিতে হয়েছে অনেকবার।
লাঘাটা ব্রীজ আসতেই জানলা দিয়ে মাথাটা বার করে তাকায় সেদিকে। দূর থেকে দেখে হরিত ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাজহাঁস গ্রীবার মতো এঁকেবেঁকে চলেছে কোপাই। নেমে পরবে কিনা ভাবতে ভাবতে বাস এসে থামে ‘লাভপুর’।
সকাল থেকে চা আর দুটো বিস্কুট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয় নি কৃষাণের। বাসস্ট্যান্ডে নেমে কিছু খাওয়ার জন্য এদিক ওদিক তাকাতেই একটা মিষ্টির দোকানে কচুরি ভাজতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় কৃষাণ। কচুরি খেতে খেতে দোকানীর সঙ্গে আলাপ করে জেনে নেয় 'মনাচিতোর' গ্রামে যাওয়ার পথ, সেই সঙ্গে হোটেল বা লজের খোঁজখবর।
লজে চেক-ইন করে সামরিক পোষাক ছেড়ে স্নান করে নেয় কৃষাণ। ব্যাকপ্যাক খুলে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট বের করে পরে ফেলে। শামসুদ্দিনের দেওয়া শাড়িটা নিয়ে রুমের চাবিটা রিসেপশনে জমা রেখে বাইরে আসে।
বাকুল মোড় থেকে তিন কিলোমিটার সারি সারি তালগাছ আর খেজুর ঝোপের মাঝে লাল সুরকির পথ, এঁকেবেঁকে চলে গেছে মনাচিতোরের দিকে। একটু এগোতেই কাঁকুরে ডাঙ্গা জমির ওপর বেমানান কয়েকটি পাকা বাড়ি দেখে পথ চলতি মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে সেটা অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টার, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালায়। একদল মেয়েদের দেখতে পায় সেখানে। আর একটু এগোতেই মনাচিতোর গ্রাম। গ্রামে ঢোকার মুখে একটা পুরনো বটগাছ। তার নীচে ছোট্ট একটা শিবমন্দির। দু’একটি বাদ দিলে সবই মাটির বাড়ী। মাটির একতলা আর দোতলা বাড়ির গঠন প্রমাণ দেয় পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ। গ্রামে ঢুকে একটু এগিয়ে যেতেই চারমাথা মোড়, সেখানে টিনের চাল দেওয়া একটা গোল চালাঘর। বাঁধানো মেঝের ওপর কয়েকজন প্রবীণবসে তাস খেলছেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন ডাক দেন কৃষাণকে।
“মশাইকে নতুন দেখছি! তা কী মনে করে…?” ভদ্রলোকের সাদা ধপধপে ধুতি, পাঞ্জাবি আর কথা বলার ঢঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, গ্রামের কেউকেটা হবেন তিনি। একটু ভেবে নেয় কৃষাণ…। সত্যি কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। অন্য রকম মনে হতে পারে…।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন