রবিবার, ২৩ মে, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                              


 


খোঁজ (৫)


শর্মিলা যে গার্লস  স্কুলে পড়ত তার প্রাইমারি সেকশনটা ছিল মর্নিং শিফট l ঠিক সকাল ছটা কুড়িতে  প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ত l স্কুলের দোতলার করিডোরে প্রত্যেক ক্লাসের মেয়েদের  ক্লাস টিচাররা লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিতেন l নার্সারি থেকে ক্লাস ফোর, পাঁচটা ক্লাসের দশটা সেকশন l করিডোরের দুদিকে পাঁচটা করে লাইন, প্রতি লাইনের শেষে দাঁড়াতেন সেই ক্লাসের ক্লাসটিচার l মাঝখানে দাঁড়াতেন প্রাইমারি সেকশনের টিচার-ইন-চার্জ এবং গানের দিদিভাই l তার সামনে একটা টেবিলে হারমোনিয়াম l প্রেয়ার শুরু হত "অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় " উপনিষদের এই শ্লোকটি দিয়ে l তারপর এক একদিন একেকটা প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়া হত l এটা শর্মিলার কাছে স্কুলে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিল l তাছাড়া প্রেয়ারের লাইনে কেউ উপস্থিত না থাকলে ফার্স্ট পিরিয়ডে তাকে কান ধরে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত l শাস্তি পাওয়ার ভয়ও ছিল  অবশ্য l তাই শীত বা বর্ষাতেও ভোর পাঁচটায়  ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজলে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে শর্মিলাও উঠে পড়ত l মা কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে টিফিন বানিয়ে দিতেন l কোনোদিন আগেরদিনের মাখা আটা দিয়ে পরোটা আর আলুভাজা বা জ্যাম - পাঁউরুটি l মুখ ধুয়ে দুধ - বিস্কুট খেয়ে ইউনিফর্ম পরতে না পরতেই গলির মুখে রিকশা ঠুন ঠুন করে কাদের চাচা হাজির... ব্যাগ গুছিয়ে জুতোমোজা পরেই শর্মিলা তখন দে ছুট l 

ক্লাসে সাগরিকা ছাড়াও শম্পা, সোমালি আর মেঘনার সঙ্গেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল শর্মিলার l ওদের পাড়ার মোড়ের বাড়িটাই ছিল শম্পাদের, তাই স্কুলে যাওয়া -আসার সময় একই রিকশায়  যাতায়াত করত ওরা l শম্পার দিদি শর্বরী ওদের এক বছরের সিনিয়র l তিনজনেই যেত একই রিকশায়, ঠেসেঠুসে l শম্পার মায়ের সঙ্গেও শর্মিলার মায়ের বেশ ভাব হয়ে গেল l সাড়ে দশটায় স্কুল ছুটির সময় অবশ্য ওরা রিকশায় ফিরত না, হেঁটেই ফিরত l কেয়ামাসি আর মা একসঙ্গেই ওদের আনতে যেতেন l ক্লাসটিচারের সঙ্গে কথা বলে লেখাপড়ার খোঁজখবরও নিতেন l  মাঝে মাঝে রান্না শেষ না হলে অপর্ণা যেতে পারতেন না l সেদিন কেয়ামাসিই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতেন l অপর্ণা ততক্ষণে নিরামিষ রান্না শেষ করে আলাদা করে মিটসেফে  তুলে রেখে উনুনে হয়ত মাছের ঝোল বসিয়েছেন l স্টোভ জ্বালিয়ে  চা করে নিয়ে কেয়ামাসি আর আর মা গল্প করতে বসতেন l কেয়ামাসি বয়েসে খানিকটা বড় ছিলেন,  তাই অপর্ণা কেয়াদি বলে ডাকতেন l কেয়ামাসিও বই পড়তে ভালোবাসতেন, নিজেদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়াও চলত l কেউ কোনো ভালো বই পড়লে অন্যজনকে সেটা পড়তে দিতেন l তাছাড়া সাংসারিক গল্প তো হতই l ঠাম্মাও মাঝে মাঝে গল্প জুড়তেন ওদের সঙ্গে l সেই ফাঁকে শর্মিলারা উঠোনে কুমীরডাঙা বা চোর-চোর খেলা শুরু করে দিত l পাশের বাড়ির পিকলু, শেলীরা পড়ত নামীদামী ইংলিশ মিডিয়াম মিশনারি স্কুলে l স্কুলবাসে করে স্কুলে যেত l ওরা খ্রিষ্টান ছিল বলে মিশনারি স্কুলে মাইনে দিতে হত না l অবশ্য সরকারি স্কুল বলে শর্মিলাদের স্কুলেও মাইনে লাগত না l বছরে সামান্য অঙ্কের টাকা দিতে হত স্কুলের ফাণ্ডে l ছুটি থাকলে পিকলুরাও খেলতে  চলে আসত l তারপর হই হই করে খেলা হত বেলা বারোটা -সাড়ে বারোটা পর্যন্ত l কেয়ামাসির খুব একটা বাড়ি ফেরার তাড়া থাকত না l আসলে শম্পার বাবা মিলিটারিতে চাকরি করতেন l থাকতেন ভারত-বাংলাদেশ হিলি সীমান্তে মিলিটারি ক্যাম্পে l ন মাসে -ছ মাসে বাড়িতে আসতেন l দুই মেয়েকে নিয়ে কেয়ামাসি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন l প্রায় একারই সংসার l রান্নাবান্না, কাজকর্মের চাপ ছিল না তেমন l কেয়ামাসির সিনেমা দেখার নেশা ছিল খুব l অপর্ণা আগে খুব একটা বেরোতেন না l সিনেমা দেখার আগ্রহ থাকলেও উপায় ছিল না l মফঃস্বলের মেয়ে, আর সঙ্গীসাথীও ছিল না তেমন l শর্মিলার বাবা অরুণবাবুর সময়ও ছিল না আর শুধুমাত্র  স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চক্ষুলজ্জায় বাধত তাঁর l দু একবার  খুব ভালো কোনো ছবি এলে ভাইবোনের সঙ্গে স্ত্রীকেও নিয়ে গিয়েছেন অবশ্য l বন্ধুত্ব হওয়ার পর মাঝেমধ্যে তাঁর কেয়াদির সঙ্গী হতেন অপর্ণা l ভালো লাগলেও নিজের শখে রাশ টানতে বাধ্য হতেন l শাশুড়ির মুখভার আর নিজের বিনোদনের জন্য টাকাপয়সা খরচ করার সাধ্য ছিল না বলে l প্রাচী, ছবিঘর বা পূরবী হলে উত্তম - সুচিত্রা, অথবা সৌমিত্র বা সুপ্রিয়ার সিনেমা এলে কেয়ামাসি ওঁদের বাড়িওয়ালার ছেলেকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রাখতেন l মা সঙ্গে বেরোলে শর্বরী আর শম্পাকে শর্মিলাদের বাড়িতে ওর ঠাম্মার হেফাজতে রেখে ম্যাটিনি শো দেখতে যেতেন কেয়ামাসি l তবে বেরোবার আগে মা বারবার করে বলে যেতেন ওরা যেন ঠাম্মাকে বিরক্ত না করে l তাই সেদিন ঘরে বসে লক্ষ্মীমেয়ের মত  লুডো খেলত ওরা l ছোটদের ছবি এলে ওরাও যেত মায়েদের সঙ্গে l দুপুরবেলা সেজেগুজে দোতলাবাসে চেপে পৌঁছত শিয়ালদায় l প্রথম প্রথম বদ্ধঘরে অন্ধকারে কান্না পেত শর্মিলার l সিনেমার গল্পও বুঝতে পারত না l পরে শম্পার কাছ থেকে বুঝে নিত l কিন্তু বাসের দোতলায় চড়ার আকর্ষণটা ছিল অদম্য l শর্বরীদি আর শম্পা কেয়ামাসির সঙ্গে বড়দের সিনেমাও দেখতে যেত মাঝে মাঝে l আসলে ওদের রাখার ব্যবস্থা করতে না পারলে সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন কেয়ামাসি l ওরা পরে শর্মিলাকে সিনেমার গল্প বলত l নায়ক - নায়িকার প্রেমের গল্প শুনতে শুনতেই এভাবেই প্রেম সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা ধারণা তৈরী হল শর্মিলার l 

সোমালি ছিল ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল l শর্মিলা আর শম্পাও ভালো রেজাল্টই করত, সাধারণত ক্লাসে  প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই থাকত l একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসত সোমালি আর শর্মিলা l সোমালির খুড়তুতো বোন মেঘনা লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না l সাগরিকার পাশে বসত ও l দুজনেই ছটফটে আর দুষ্টুবুদ্ধিতে ভরপুর l মেঘনা প্রত্যেকবারই টেনেটুনে পাশ করত l এমনিতে যথেষ্ট বুদ্ধি, কথাবার্তায়ও চৌখস l কিন্তু অসম্ভব ফাঁকিবাজ ছিল মেঘনা l হোমওয়ার্ক করত না বলে প্রায়ই শাস্তি পেত l শর্মিলা, শম্পা ওকে বোঝাতে চেষ্টা করত, সাগরিকাও l যদিও মেঘনার  সমস্ত দুষ্টুমির দোসর ছিল সাগরিকা l তবু পড়াশোনাটা করত l সোমালি একেবারে পছন্দ করত না মেঘনাকে l নিজের কাকার মেয়ে হলেও সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলত l ফার্স্ট গার্ল বলে ক্লাসে অন্য মেয়েরা সোমালিকে সমীহ করেই চলত l মেঘনা ওকে পাত্তাই দিত না l আসলে ঐটুকু বয়েসেই একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স গ্রো করে গিয়েছিল সোমালির মধ্যে l বাড়িতে, স্কুলে সবসময় তুলনামূলক আলোচনার ফলে অজান্তেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল l

(চলবে)

1 টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লাগছে পড়তে। সেই সময়ের বাস্তব জীবনকাহিনী ছবির মতো উঠে আসছে প্রতিটি বাক্যে। মনে পড়ছে আমাদের ছোটবেলা। প্রতিটি চরিত্র পরিস্ফুট হছে ধীরে ধীরে..... অসাধারন দক্ষতায়।

    উত্তরমুছুন