রবিবার, ৯ মে, ২০২১

কাজল সেন

                                                                  



চিত্রকলা 


নাম রাখা হয়েছিল চিত্রকলা। মা-বাবা কী ভেবে মেয়ের এই নাম রেখেছিলেন, তা কারও জানা নেই, চিত্রকলারও জানার তো কথাই নেই। কেননা সেই নিতান্ত ছোটবেলায় চিত্রকলার তখনও কোনো বোধের উদয় হয়নি, আর কিছুটা বড় হয়ে  মা-বাবাকে হারিয়েছে। চিত্রকলা তারপর থেকে দাদু-দিদার কাছেই থেকেছে, ক্রমশ আরও বড় হয়েছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে যেসব ব্যাপার খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে, চিত্রকলারও তাই তাই ঘটেছে। যেমন স্কুলে ভর্তি হয়ে একটার পর একটা ক্লাসে উঠেছে। স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি নজরুল সদনে গান শিখেছে, নাচ শিখেছে, ক্যারাটে শিখেছে, আবৃত্তি শিখেছে, কিন্তু না, চিত্রকলা শেখেনি। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, আঁকাআঁকি একদম নয়। আঁকাআঁকির সঙ্গে আমার জন্মের শত্রুতা। কিছুতেই শিখব না।
চিত্রকলা অঙ্কনশিল্প শেখেনি, সুতরাং তার এই শিল্পকর্মে দক্ষতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গান, নাচ, ক্যারাটে, আবৃত্তি শিখলেও তাতে যে সে রীতিমতো বা মোটামুটি দক্ষ, তাও বলা যাবে না। এবং সে যে এসব যথাযথ মন দিয়ে শেখেনি, তারও অনেক প্রমাণ আছে। যেমন স্কুল বা কলেজের পরীক্ষাগুলোতে  কোনোরকমে পাস করে গেলেও পড়াশোনায় রুটিন করে ফাঁকি দিয়েছে, ঠিক তেমনি গান, নাচ, ক্যারাটে, আবৃত্তির ক্লাসে সুযোগ পেলেই কারও সঙ্গে বকবক, কারও সঙ্গে খুনসুটি, কারও সঙ্গে ঝগড়া, আবার কারও সঙ্গে হেঁয়ালি করে সময় কাটিয়েছে। 
এমন এক মেয়ে চিত্রকলা, যে সর্বঘটে লবডঙ্কা, যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দাদু-দিদা বিব্রত, সেই মেয়ে হঠাৎ একদিন সবাইকে ভড়কি দিয়ে একটা ট্যালেন্ট হান্ট কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করে অ্যাক্টিং সেশনের ফার্স্ট রাউন্ডে সিলেক্ট হয়ে গেল। চিত্রকলার যেসব বন্ধু-বান্ধবীরা সেখানে জড়ো হয়েছিল, তারা চিত্রকলার ক্যালি দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। আসলে মুশকিল হচ্ছে, চিত্রকলা দেখতেও তো আদৌ সুন্দরী নয়! রঙটাও ফর্সা নয়, মূলত কালোই, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে সান্ত্বনা দেওয়া যেতে পারে। বিচারকরা যে কী দেখে চিত্রকলাকে সিলেক্ট করল, কে জানে!
কম্পিটিশনের ফার্স্ট রাউন্ড হয়েছিল রাঁচিতে। সেকেন্ড রাউন্ড ছিল পাটনায়। চিত্রকলা পাটনায় পৌঁছে গেল। এবং কী আশ্চর্য, দ্বিতীয় রাউন্ডেও চিত্রকলা বাজি মারল। এবার ফাইন্যাল রাউন্ড কলকাতায়। চিত্রকলা রাঁচি ও পাটনায় একাই গেছিল। কিন্তু কলকাতায় যাবার জন্য দাদু-দিদাকে চেপে ধরল, তোমরাও চলো। দাদু-দিদার ততদিনে সিনা মানে বুকের পাটা একটু একটু করে ফুলতে শুরু করেছে নাতনীর কীর্তিকান্ড দেখে। চিত্রকলাকে নিয়ে তাঁরা পৌঁছে গেলেন কলকাতায়। ফাইন্যাল রাউন্ড, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইতিপূর্বে সিলেক্টেড প্রতিযোগীরা এসেছে। যেদিন কম্পিটিশন সেদিন চিত্রকলা ভোর হতেই দাদু-দিদার সঙ্গে হাজির হলো স্টুডিওতে। সকাল দশটা থেকে ফাইন্যাল রাউন্ড শুরু হবে। 
চিত্রকলার যখন ডাক পড়ল তখন প্রায় রাত দশটা বাজে। সারাদিন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় শ্রান্তিতে ক্লান্তিতে কাহিল হয়ে পড়েছিল চিত্রকলা। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে গ্যালারির দর্শক আর বিচারকদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আর তারপর শুরু হলো চিত্রকলার এতদিনে অর্জিত পড়াশোনা, গান, নাচ, ক্যারাটে, আবৃত্তির  এক অবিশ্বাস্য কম্পোজিট এক্সপোজার। চিত্রকলা তখন নিজেই এক আশ্চর্য চিত্রকলা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন