নির্জন সৈকত
এর আগে পুরীতে কখনও বেড়াতে আসা হয়নি। জীবনের প্রায় চোদ্দআনা বয়স পার করে এই সত্তর বছর বয়সে স্ত্রী-মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য পুরী দর্শনে এসেছেন বিমলাকর। শরীরে তেমন যুত নেই, বৃদ্ধ বয়সের যা কিছু শারীরিক উৎপাত, সবই আছে। ব্লাডপ্রেসার, ব্লাডসুগার, অস্টিও আর্থেরাইটিস, হাইপার থায়োরেড ইত্যাদি সবকিছুই। মনটাও তেমন উৎফুল্ল থাকে না অধিকাংশ সময়। মেয়ে-জামাই জোর করেছিল, চলো বাবা, সমুদ্রের হাওয়া খেলে তোমার শরীর ও মন দুইই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
সমুদ্রের হাওয়া গত দুদিন অনেক সহ্য করেছেন, কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন তাঁর শরীর ও মনে অনুভূত হয়নি। তবে তৃতীয় দিনের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ছিল। বিমলাকরের বহুদিনের অভ্যেস ভোরবেলা হাঁটতে বেরোনো। পুরীতে এসেও দুদিনই বেরিয়েছেন। স্ত্রী অনুভা অবশ্য ভোরের উপভোগ্য ঘুম ছেড়ে কোনোদিনই উঠতে রাজী হননি, আর তাই স্বামীর সঙ্গে কখনও প্রাতঃভ্রমণে সঙ্গীনিও হননি। তা সেদিনও বিমলাকর ভোররাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন সমুদ্রের বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গেছিলেন। সেখানে মানুষজন কম, ফাঁকা ফাঁকা, এক কথায় নির্জন সৈকত। আর কী আশ্চর্য! সেখানেই আচমকা দেখা হয়ে গেল রত্ননীলার সঙ্গে। কতদিন পর দেখা? ঠিক মনে পড়ে না। গতজন্মের বলে মনে হয়। এখন রত্ননীলার সেই রূপ নেই, সৌন্দর্য নেই, যৌবন নেই, শরীর নেই, কাঠামো নেই। বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে সব যেন উবে গেছে। তবু রত্ননীলাকে চিনতে পারলেন বিমলাকর। একদিন যে রূপ, সৌন্দর্য, যৌবন ও শরীরকে তিনি সারা শরীর ও মন দিয়ে কাছে পেয়েছেন, উপভোগ করেছেন, আত্মহারা হয়েছেন, তা সময় গড়িয়ে গেলেই কি বিস্মৃত হওয়া যায়? রত্ননীলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমলাকরের সব কিছুই মনে পড়ে যায়। বিমলাকর একটা হাত বাড়িয়ে বলেন, কেমন আছ নীলা?
রত্ননীলা কিছুটা অবাক হয়ে এক পলক তাকিয়েছিলেন বিমলাকরের চোখে। তারপরই তাঁর চোখ হেসে উঠেছিল তিরতির করে। ঠোঁট দুটোও কেঁপে উঠেছিল। অস্ফূটে উচ্চারণ করেছিলেন, বিমল! তুমি! এখানে?
নির্জন বালুকাবেলায় হাতে হাত জড়িয়ে গায়ে গা ঘেঁষে তাঁরা বসেছিলেন অক্লান্ত অস্থির সমুদ্রের চোখে চোখ রেখে। সমুদ্রের ঢেউ উজিয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল তাঁদের পায়ে, বলে যাচ্ছিল অনেক অনেক চুপকথা। কিন্তু তাঁদের মুখে কোনো কথা নেই। কে কাকে কী বলবেন, কিছু ভেবেই পাচ্ছিলেন না। প্রথম যৌবনে তাঁরা দুজনে দুজনকে অনেক কথা বলেছেন। কিছু কথা বলা হয়তো বাকিও থেকে গেছে। কিন্তু আজ এই জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে সেসব কথা বলার আর তো কোনো মানে নেই! প্রয়োজনও নেই। একজীবনে কি আর সব কথা বলে শেষ করা যায়?
-নীলা, তুমি কি একা এসেছ?
-না, একা কোথায়! স্বামী-ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি সবাই এসেছে। তুমি তো জানো ভোরবেলায় হাঁটা আমার অভ্যেস। তাই একাই বেরিয়ে পড়েছি। তোমারও তো তাই!
-আমরা আর দিন চারেক পুরীতে থাকব। সম্ভব হলে এখানে এসো। দেখা হবে।
-হ্যাঁ, আসব তো! আর আমরা প্রতি বছর এই সময়ে পুরীতে বেড়াতে আসি। তুমিও এসো। যতদিন বাঁচি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন