আজকের আলোচনা করব মানবমন নিয়ে। এখন 2021 সাল। চলছে মহামারির তাণ্ডব। কি হবে তার মধ্যে এই মনের কচকচি কেন?
প্রয়োজন বইকি! মন ঠিক না থাকলে শরীর নিয়ে লড়াই করা মুশকিল। মরণাপন্ন রুগী উঠে দাঁড়াতে পারে মনের জোর থাকলে। আর শুধু রোগের কথা ই বা কেন? প্রতিদিনের জীবন চর্যায় মনের ভুমিকা স্বীকার করতেই হবে। বিবাহিত জীবনে মন বড় ভুমিকা পালন করে। দাম্পত্য পুরনো হয়ে গেলেই পরকীয়া এসে হানা দেয়। কেন? মন কেন চায় অখণ্ড স্বাধীনতা? এটা কোনো দোষ নয়। ধর্ষণ বিদেশে এত বেশি হয় না। কারণ, মনের কোন জায়গা থেকে এইরকম ভযঙ্কর ইচ্ছের উত্পত্তি সে সম্বন্ধে ছোট থেকে বাচ্চাদের সচেতন করে দেওয়া হয়। এই দেশে বাচ্চারা যত মায়ের বেবি হয়ে থাকবে ততই ভারতীয় মা খুশি। শিশু কোনো অবোধ প্রাণী নয়। মাত্র তিন মাস থেকে যৌন আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার শরীরে। অথচ, মায়েরা ভাবে, শিশু অবোধ। আধো আলো আধো অন্ধকারে থাকতে থাকতে একমাত্র sex নিয়ে সারাজীবন কৌতূহলী থেকে যায়।
মন খারাপে ভোগে। লেখাপড়া, সম্পর্ক সবকিছুতে ছাপ পড়ে।
****
জন্ম নিয়েই কেঁদে ওঠে শিশু।
আগামী দিনের লড়াইয়ের কথা ভেবে হয়ত মন খারাপ হয়। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে না জানি কত লড়াই করতে হবে? শুধু বাইরের জগতের সঙ্গে তো নয়, কঠিন লড়াই হল নিজের সঙ্গে। ভিতরের আমি আর বাইরের আমি র নিরন্তর সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। তাই কেঁদে ওঠে শিশু। পারবে তো টিঁকে থাকতে? না কি , পরাজিত হতে হবে নিজের কাছে? নিজের অ- দেখা প্রবৃত্তির কাছে?
*
প্রবৃত্তি( Instinct) জন্মলগ্ন থেকে বহন করে আনতে বাধ্য হয় মানুষ। এই ব্যপারে তার কোনো পছন্দ- অপছন্দ কাজ করেনা। বিষয়টিতে প্রথম আলোক পাত করেন বিখ্যাত মনো বিজ্ঞানী সিগম্যানট ফ্রয়েড। এ একেবারে ধামকাধার আবিষ্কার। উপর দেখে নয় বিচার করতে হবে ভিতর দেখে! ভিতর মন। সেখান থেকে আরো আরো খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত। সেই শেষের ঘরে লুকিয়ে আছে যে মন,সে নাকি পশুর মত। কিম্বা তার চাইতেও আগ্রাসী। হিংস্র। লালসা পূর্ণ।
ফ্রয়েড স্যারের এমন চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা ভালো করে জেনে চোখ কপালে উঠে গেল। মানুষ জন্ম হতেই হিংস্র? তবে সমাজ চলছে কি করে?
একটু গুছিয়ে বলা যাক।
ফ্রয়েড স্যার বললেন যে, যাবতীয় মানসিক চিন্তা ভাবনা তিনটি পথ ধরে এগিয়ে চলে। ইড, ইগো , সুপার - ইগো।
***
ইড , মানুষের অচেতন মন। শিশুর মত, পশুর মত...উচিত অনুচিত বোধ থাকে না। খিদে পেলে খাবার, রমণ ইচ্ছে জাগল তো রমণ...আনন্দ চাই। যেভাবে হোক। চাই। চাই আর চাই। ইড হল মানব মনের মৌলিক স্তর। যেখানে মানব মনের সকল শক্তি নিহিত থাকে। ইড মূলত মানুষের জৈবিক দিক। মানব মনের স্বভাবজ চাহিদা পূরণ করে ইড। মন যা চায় তাই করো। এর কোনো মানবিক দিক নেই। পুরোটাই লোভ লালসা কাম চিন্তায় ভরপুর। ইড এমন তীব্র ভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে যে, সে প্ররোচনায় মানুষ যে কোনো অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে খুন ধর্ষণ অবধি করতে দ্বিধা বোধ করে না। এক কথায় ইড হচ্ছে আমাদের ভিতরের সুপ্ত পশু। ফ্রয়েড স্যার বলেছেন যে, এই প্রবৃত্তি দখল করে আছে মানব চরিত্রের বেশির ভাগ জায়গা।
পাশবিক প্রবৃত্তির ভূমিকা মানুষের জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা গেল।
সুপার ইগোর কথায় আসি একটু। এ হল আধা অচেতন বা অবচেতন মন। সুপার ইগো হল মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা পূরণ করতে উদ্দীপ্ত হয়, সুপার ইগো একে বাধা দেয়। সুপার ইগো মানুষ কে সব সময় মানবিক দুর্বলতার উর্ধে উঠে ভালো কাজ করার জন্য মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। অর্থাৎ, পশু প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে এর অবস্থান। একজন অতি খারাপ তো অপরজন অতি ভালো। এই দুই অতি অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে ইগো বা চেতন মন। কি রকম?
যেমন, ইড বলবে পর্নোমুভি দেখো। দারুণ লাগবে।
সুপার ইগো ওমনি লাঠি উঁচিয়ে বলবে, খবর্দার। এটা নৈতিকতা বিরোধী। অতএব দেখা যাবে না।
ইগো বলবে, পর্ণমুভি দেখো। তবে লুকিয়ে। কেউ যেন জানতে না পারে।
ইগোর কাজের আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, ফাঁকা রাস্তা আর বাইক সহ কিশোর। এক্ষেত্রে, ইড প্রবৃত্তি উস্কানি দিয়ে বলবে তীব্র বেগে চালিয়ে যাও। যা হয় দেখা যাবে। হেসে নাও দুদিন বই তো নয়। ফুর্তি করো। মজা লোটো। বাতাসের বেগে বাইক চলাও। সঙ্গে সঙ্গে তার অবচেতন মন বা সুপার ইগো বাধা দেবে। বহু অনিষ্ট হতে পারে সেটা বলবে। এই দোলাচলের মাঝে এসে পড়বে ইগো অর্থাৎ সচেতন সামাজিক মন। মাঝামাঝি স্পিডে চালাতে নির্দেশ দেবে।
***
আমাদের যখন তিনবছর বয়স তখন থেকে উচিত- অনুচিত বোধ তৈরি হয়। শিখে যাই অনুভূতি চেপে রাখার কৌশল। মন আর মুখ আলাদা করে ফেলতে পারি অনায়াসে। রেসের মাঠে গেলে লোকের নিন্দে, তবে লুকিয়ে যাওয়া যায়। পরকীয়া করা উচিৎ নয়। গোপনে করলে কে জানবে? ইগো সর্বক্ষণ এই ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মানুষের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে সামাজিক প্রবৃত্তির এমন একটা সহাবস্থান কাজ করছে। চেতন মন লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কাজটাই করছে, যেটা গোপন মন করতে চায়। প্রকাশ্যে না হলে, চিন্তায় করছে। স্বপ্নের মধ্যে আসছে। অচেতন মন ঘুমের মধ্যেও জাগ্রত থাকে। তাই, সারাদিন যেমন যেমন চিন্তা করি ,অচেতন মনের মধ্যে জমা হতে থাকে সব। স্বপ্নে বহুসময় প্রতিফলিত হয় সেগুলো।
***
কথায় বলে, প্রবৃত্তির হাতে অসহায় মানুষ। নির্মম সত্য। আজকের সভ্য মানুষ সৃষ্ট হয়েছে সমাজের প্রয়োজনে। প্রকৃতপক্ষে সে তো অরণ্যচারী স্বাধীন। জবাবদিহির কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। শরীরের ক্ষুধা উদরের ক্ষুধা মেটানো ছিল জন্মগত অধিকার। নারী -পুরুষ জীবনে একজন হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি ছিল না। অথবা আইনগত সম্পর্কের বাঁধনে মোটেই বাঁধা ছিল না সে। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হল পৃথিবীর। পরিবর্তন হল না মানুষের গোপন মনের। সেখানে সে রয়ে গেল স্বেচ্ছাচারী আদিম। স্বপ্নদোষ দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষের। নিরীহ ভালমানুষ ব্যক্তি বহন করে চলে অবদমিত কাম। পতিব্রতা বৌটি মনে মনে পরকীয়া করে। নিষ্ঠাবতী বিধবা কান পেতে শোনে রসের গল্প। ধর্ষণের ভিডিও বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ভিডিও তারিয়ে তারিয়ে দেখে অনেকেই। আহা উহু করার মধ্যে দিয়ে সুখানুভূতি চলকে পড়ে। খুন জখম দাঙ্গার খবর অনেক বেশি আগ্রহ জাগায় সাধারণ খবরের চাইতে। সরাসরি অপরাধ করছে না কিন্তু অপরাধ ঈর্ষা হিংসার ঘটনা শুনে তীব্র আনন্দ পাওয়া নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু নয়।
**
ফ্রয়েড স্যার অনেক উপকার করে দিয়েছেন আমাদের। তার কাছে কৃতজ্ঞ থেকেও বলতে পারি এই পাশবিক মনের আক্রমণ সম্বন্ধে প্রাচীন শাস্ত্র ভালরকম চর্চা করে নানান উপদেশ দিয়ে গেছে। মন চাইছে অথচ পাচ্ছে না...চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যের ব্যবধান থেকে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় হতাশার। দিনের পর দিন নিজেকে দোষ দিতে দিতে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। পীড়িত মন দুর্বল মন বহনকারী মানুষকে আত্মহনন থেকে সরে এসে আত্মোপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছেনভারতীয় ঋষি -মুনিগণ।
মানব চরিত্র সম্পর্কে প্রাচীন যুগের ঋষিকুল মানব চরিত্রের নাড়ি গলি খুঁজে ভালো রকম পর্যালোচনা করেছিলেন। প্রবৃত্তির হাতে বন্দী মানব মুক্তি কি করে পাবে? সুপার ইগো ( সুপার ego) অর্থাৎ মনের যে অংশে নীতিবোধ, মানবিকবোধ, নৈতিক চেতনা সুপ্ত থাকে--তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
ভিতর হতে ইচ্ছে জেগে না উঠলে পশুপ্রবৃত্তি রোধ করা যাবে না। নৈতিক বোধ জাগরণের জন্য নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই জরুরি। প্রকৃষ্টতম উদাহরণ মহর্ষি বাল্মিকী। দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী। রাম নাম করে একমনে তপস্যা বস্তুত এক্ধরণের কাউনসিলিং। রত্নাকর অবস্থায় কিন্তু মানুষ হত্যা করতে হাত কাঁপেনি। অনুশোচনা হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলেন দস্যুজীবন। তপস্যা শেষে ভিতর ঘরে জ্বলে উঠল আলো। স্পষ্ট অনুভব করলেন প্রাণ কত মহিমাময়। সামান্য পাখি হত্যা দেখে ঝরে পড়ল অশ্রু। উচ্চারিত হল কবিতা। এখানে সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত ইড প্রবৃত্তি। নিজের মনের সঙ্গে বসে ধ্যান করে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা যায় মানব জীবনের উদ্দেশ্য রিপু বা প্রবৃত্তির হাতে হারিয়ে যাওয়া নয়। বরং, রিপুকে মহৎ কাজে নিয়োজিত করে জীবন সুন্দর করে তোলা।
***
মানব মনের, অন্ধকার পাশবিক দিক অনেক বেশি শক্তিশালী। তার অভিঘাত প্রবল প্রচন্ড। সুনামির মত। ভাবনার কথা এই যে, কতখানি পশু আমরা হয়ে উঠতে পারি, সে সম্বন্ধে নিজেরাই জানি না। এমন শক্তিশালী পিশাচের সঙ্গে লড়াই সহজ নয়। নৈতিক বোধ দ্বারা পিশাচ কে হত্যা করতে হলে, কঠিন জীবনচর্যা প্রয়োজন। নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে ধুলো ময়লা সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
পিশাচ মনের কাজ হল তাৎক্ষণিক খুশির দিকে মনকে চালিত করা। সাধারণ মানুষের ভালো লাগে সেটাই। মদ্যপান, অকারণ হুল্লোড়,ঈর্ষা , আড্ডা , পরনিন্দা, ধর্ষণ, ইভ টিজিং উলঙ্গ শরীর দেখা ...আরো নানা কাজে পিশাচমন উৎসাহ দিতে থাকে। তাৎক্ষণিক খুশির জাল রঙিন সুন্দর।
ইড ধীরে ধীরে অধিকার করে নেয় মানবমন। প্রবৃত্তির দাস বানিয়ে হরণ করে শান্তি। ভুরি ভুরি ঘটনা আছে উদাহরণ হিসেবে।
এই পিশাচ মনের ভিতর নিহিত আছে প্রচন্ড শক্তি। ভেঙে যেমন ফেলতে পারে, গড়েও তুলতে পারে। রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হতে গেলে অলৌকিক উপায় নয়, চাই নিরলস সাধনা। তবে, সেই প্রবৃত্তি ঘুরে যাবে সুন্দর দিকে, সৃষ্টি করবে অতুলনীয় জীবন। আমাদের ভিতর ঘরের মন যেন উত্তাল নদী। বাঁধ দিয়ে উৎপদিত হবে বিদ্যুত। দূর করবে অন্ধকার। না হলে? ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। মৃত্যু অর্থ শারীরিক কেবল নয়। মানসিক সুস্থতা না থাকাও মৃত্যুর সমান।
**
গভীর অজানা মন লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মত। তাকে লাগাম পরিয়ে সঠিক পথে চালিত করে ফেলতে হবে। তাৎক্ষণিক সুখের জন্য বহু ক্ষতি করে দিতে পারে বেয়াড়া মন। বহু সমস্যা, দুশ্চিন্তা দুঃ স্বপ্ন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শরীর খারাপ হতে থাকে। অচেতন মন সাংঘাতিক শক্তিশালী একথা জেনেছি। এই শক্তি বা এনার্জি কিন্তু নেতিবাচক। ক্রমাগত নেতিবাচক ইঙ্গিত করে পথ চ্যুতি ঘটতে থাকে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কালে অর্জুনের অচেতন মনে এইরকম নেতিবাচক চিন্তার ঝড় উঠেছিল। ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ইতিবাচক মনোভাব অর্জন করতে হলে শ্রীমদ্ভগবত গীতা পড়া জরুরি। নিরন্তর চর্চার দ্বারা এই নেতিবাচক মন যদি ইতিবাচক দিকে পরিণত হয়, তবে মানুষ হয়ে উঠবে ঈশ্বর। বহুগুণ বেড়ে যাবে জীবনী শক্তি।
***
মানুষ ভালো - মন্দের ফারাক করতে পারবে।
অচেতন মন( Id) সচেতন মন( ego) অবচেতন মন( super ego) --তিনটি এক সুতোয় গেঁথে ফেলে মানুষ হয়ে উঠুক নিজভূমে রাজা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন