বেজন্মা (দ্বিতীয় পর্ব)
বিকেলে
সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাওড়া থেকে বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জারে চেপে বসে। রাত
আটটা নাগাদ বোলপুরে পৌঁছে স্টেশন মাস্টারের কাছে তাঁর গন্তব্যের পথ জেনে নেয়। স্টেশনমাস্টার
ভদ্রলোক সম্ভবত তার সামরিক পোষাকের জন্য বেশ আদর করে চেয়ারে বসালেন। চা খাওয়ানোর সাথে
সাথে অনেকক্ষণ তার সামরিক জীবন নিয়ে গল্প করলেন কৃষাণের সাথে। স্টেশনমাস্টার তার রাতে
থাকার জন্যওয়েটিং রুমটা ব্যবস্থা করে দিলেন।
স্টেশনমাস্টারের
পরামর্শে রাতের খাওয়া রেলওয়ে ক্যান্টীনে সেরে ওয়েটিং রুমে এসে শুয়ে পড়ল কৃষাণ। সত্যি,
বড্ড ভালো মানুষ মাস্টারমশাই। কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল, যেন কৃষাণ তাঁর কতদিনের চেনা।
সরকারি হোমে ওয়ার্ডেনের রক্তচক্ষু, নানান বাধা নিষেধের মধ্যে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ
করেছিল। স্কুলবেলায় সেই দিনের কথা ভুলতে পারে না। আজও মনের গভীরে দগদগে ক্ষতস্থান থেকে
পুঁজ, রক্ত গড়িয়ে পড়ে। কত বয়েস হবে তখন…? ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলে ফুটবল খেলার মাঠে
এক সহপাঠীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতির রূপ নেয়। তাই দেখে খেলার স্যার ছুটে
এসে সজোরে চড় মেরেছিলেন তাকে, “বেজন্মা কোথাকার, কার সঙ্গে ঝগড়া করছিস, জানিস?” অবাক
হয়ে তাকিয়েছিল, মাস্টারমশাইয়ের দিকে। একজন তারই সহপাঠী, এত গুরুত্ব তার? সে তো কোনও
অপরাধ করে নি! ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়েছিল দুজনে, সেই থেকেই হাতাহাতি। স্যারের দেওয়া
‘বেজন্মা’ শব্দের মানেটা বুঝতে পারেনি সেদিন। জেনেছিল অনেক পরে…। জানার পর থেকেই নতুন
পরিচয়ে সে বড় হয়ে ওঠে, ‘বেজন্মা’। সেঅনাথ নয়, ‘বেজন্মা’। সকলের মতো স্বাভাবিক মেলামেশা
করার তার অধিকার নেই। অনাথআশ্রমে খোঁজ করে তার মত কাউকে পায় নি। তারা সব অনাথ, তার
মত বেজন্মা নয় কেউ।
আঠারো
বছর বয়সের বেশী ছেলেদের নাকি আশ্রমে থাকার অনুমতি নেই, তাই বিতাড়িত হলো অনাথআশ্রম থেকে।
তারপর যেখানেই গেছে অবহেলা আর অবজ্ঞা তার নিত্য সঙ্গী হয়েছে। অবশ্য ভালো মানুষেরা অনাথ
জেনে দয়াপরবশ হয়ে খাবারের জন্য কিছু টাকা হাতে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ ভাবেন নি কোনোদিন।
তারপর নানান জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় মেলে আন্দুল স্টেশনে চায়ের
দোকানে। সেখানেই আলাপ কয়েকজন হকারভাই আর ধাবার সিংজীর সঙ্গে। না, কোনও দয়া বা করুনা
নয়, তাদেরই একজন হিসাবে আপন করে নেয় তারা, আর পুত্র স্নেহে কাছে টেনে নেন, সিংজী আর
তাঁর স্ত্রী বিদ্যাভাবী। সিংজী কতবার বলেছেন ধাবায় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে, কিন্তু নতুন
করে করুণা নিতে চায় নি সে। আর তাছাড়া অসময়ে যিনি আশ্রয় দিয়েছেন, তাকে ছেড়ে আসতেও মন
চায় নি। একদিন চায়ের দোকানে চায়ের জন্যে আসা নিত্যযাত্রীবোসবাবুর পরামর্শে ফোর্সের
চাকরীটা হয়ে যায়। ফিরে গিয়ে বোসবাবুর খোঁজ করতে হবে… ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে আসে কৃষাণের।
ট্রেনের
আওয়াজ আর যাত্রীর শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দরজা খুলে বাইরে আসে কৃষাণ। অন্ধকার তখনও মুছে যায় নি।
প্ল্যাটফর্মের হকারের কাছ থেকে এককাপ চা নিয়েওয়েটিংরুমের সিঁড়িতেই বসে পড়ে।
সকালে হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস জুড়িয়ে দেয় তার শরীর। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অন্ধকার মুছে
যাওয়া প্রত্যক্ষ করে। সকালের নরম আলোয় নজর পড়ে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে একটা গাছের দিকে।
মনে হয় সাদা তুষারের ছোট ছোট কণা যেন লেগে আছে ঘন সবুজ গাছের পাতায় পাতায়। কৃষাণ এগিয়ে
যায় সেই দিক লক্ষ্য করে...। কামিনীর শুভ্র ফুলে ভর্তি হয়ে আছে গাছ। মুগ্ধতায় তাকিয়ে
থাকে কিছুক্ষণ। অথচ কামিনী গাছ তার কাছে নতুন নয়। কিন্তু এই ভাবে দেখেনি কোনোদিন। নিজের
এই আচরণে নিজেই অবাক হয়ে যায় কৃষাণ।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন