রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                                




 খোঁজ ৪


স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শর্মিলার প্রথম বন্ধু হল সাগরিকা l রোগা, লম্বাটে গড়নের হাসিখুশি মেয়েটা কয়েকদিনের মধ্যেই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেল l ওদের বাড়িতে একজন গানের মাস্টারমশাই প্রতি শনিবার বিকেলে ক্লাসিক্যাল গান শেখাতে আসতেন l সাগরিকার সঙ্গে আরো পাঁচজন জেঠতুতো -খুড়তুতো দিদিও তাঁর কাছে গান শিখত l কিছুদিন পরে ওদের পাড়ার আরো দু একজন মেয়েও সেই ক্লাসে ভর্তি হল l শর্মিলাও বায়না ধরল সেও গান শিখবে l শর্মিলার মা গান খুব  ভালোবাসতেন l কোনোদিন না শিখেও রবিঠাকুরের গান, আধুনিক গান ভারি সুন্দর গাইতেন l অবশ্য বাড়িতে নয়,শর্মিলারা যখন এক - দুদিনের জন্য চন্দননগরে ওদের কাকাদাদু অর্থাৎ মায়ের কাকার বাড়ি বেড়াতে যেত, তখন ওবাড়ির ছাদে সান্ধ্য আসরে মায়ের গান শুনেছে l ও বাড়িতে  অনেক লোক, বাড়িটাও বেশ বড়,  খোলামেলা l পাশেই গঙ্গা l ওখানে বেড়াতে যেতে খুব ভালোবাসত শর্মিলা l ওবাড়ির পরিবেশটা ওদের বাড়ির মত দমচাপা নয় l  দূরসম্পর্কের অনেক আত্মীয়ের ছেলেমেয়েরাও কাকাদাদুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত l তাই অনেক অনেক মামা - মাসিদের নিয়ে ওবাড়ি সবসময় জমজমাট l মামা-মাসিরা সকলেই বলত মা খুব ভালো গায় l দাদু- দিদাকেও মাকে গান না শেখানোর জন্য আফসোস করতে শুনেছে l নিজের মেয়ে না হলেও অপর্ণাকে ওঁরা নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসতেন l কিন্তু এতবড় একান্নবর্তী পরিবারে তার  জন্য আলাদা করে গান শেখানোর ব্যবস্থা তাঁরা করে উঠতে পারেননি l অল্পবয়েসে বিয়ে দিতেও বাধ্য হয়েছিলেন l তাই নিজের অপ্রাপ্তিটুকু ভরানোর জন্যই বোধহয় ওকে গান শেখানোর ব্যাপারে মা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন l 

সাগরিকারা খাস কলকাতার মানুষ, বনেদী যৌথ পরিবার l ওদের বাড়িটা পুরোনো হলেও  বিশাল l বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালঘেরা অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়ি l কলকাতা শহরে তখনও এত বড় বাড়ি কমই ছিল l একতলা -দোতলা মিলিয়ে সারি সারি প্রায় গোটা কুড়ি ঘর, তার দুধারে বিরাট বিরাট লম্বাচওড়া টানা বারান্দা l প্রতিটি ঘরই আকার আয়তনে শর্মিলাদের প্রায় পুরো বাড়িটার সমান l কড়িবর্গা দেওয়া সিলিং, লম্বা লম্বা দরজা আর বিরাট বিরাট খড়খড়ি দেওয়া জানালাগুলো খুব আকর্ষণ করত শর্মিলাকে l আরো ভালো লাগত ওদের ঘরের সাবেকী আসবাবগুলো l বিশাল বিশাল নিরামিষ, আমিষ রান্নাঘর, খাবারঘর আর বাড়ির সামনে-পিছনে বড় বড় ফলফুলের গাছঘেরা একটা বাগান ছিল l বাগানের একধারে ছিল  একটা ছোট্ট পুকুর l সেখানে বড়রা সাঁতার কাটতেন l ছোট্ট বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি ধরে ছোটরাও হাত-পা ছোঁড়া প্র্যাক্টিস করত l জেঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন, কিছু সমবয়সী ভাইপো, ভাইঝি মিলিয়ে ওদের বাড়ি সবসময় সরগরম l ওবাড়ির বাগানে বা বিশাল ছাদে বাচ্চাদের খেলাটা বেশ জমত l শর্মিলাও জুটে গিয়েছিল ওদের সঙ্গে l বিকেল হলেই ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছটফট করত l সেই  ছাদের এক কোণে মাদুর পেতে  বাড়ির মহিলারাও  বিকেলবেলা গা ধুয়ে, পাটভাঙা তাঁতের শাড়ি পরে, সেজেগুজে চুল বেঁধে, চায়ের ট্রেতে ফ্লাস্কভর্তি চা আর নানারকম 'টা' সহযোগে গল্প করতে বসতেন  l  ঠাকুর -ঝি -চাকরেরও অভাব ছিল না তাই তাঁদের ওপর সংসারের চাপ ছিল না তেমন l  কাকিমাদের ওই বৈকালিক আড্ডাটা দু চোখ ভরে দেখত শর্মিলা l মায়ের জন্য কষ্ট হত খুব l রোজ বিকেলে ওই সময়টায় ওর মা কয়লার উনুন ধরিয়ে বিকেলের রান্না করতেন l পিসি রাজশ্রীও  টিউশনি করে ফিরে মাঝেমাঝে সাহায্য করতেন  অবশ্য l  সকালে মাঝেমধ্যে একটু আনাজ কেটে দেওয়া ছাড়া ঠাম্মাকে সংসারের আর কোনো  কাজ করতে দেখেনি শর্মিলা l সংসারের সম্পূর্ণ ভার মায়ের ওপরেই ছিল l তবে সেটা নিয়ে মায়ের মুখে কোনোদিন কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ শোনা যেত না l মায়ের যেন শরীর খারাপও হতে নেই, বারোমাস-তিরিশদিন যন্ত্রের মত সংসারের জোয়াল টেনে যাওয়াই তাঁর কাজ l রোজ বিকেল হলেই শিবমন্দিরে আরতি দেখতে  যেত ঠাম্মা l সারা পাড়ার হাঁড়ির খবর জোগাড় করে সন্ধ্যাবেলা রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে তেলমশলা সহযোগে সেসব পরিবেশিত হত l একটা টিমটিমে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলত রান্নাঘরে l শ্রোতাদের মধ্যে পাড়ার আরো দু - চারজন মহিলা থাকতেন l তখনও বাঙালীর ঘরে দূরদর্শন এসে পৌঁছয়নি l এই পরচর্চাটুকুই ছিল মহিলাকূলের বিনোদন l ওরা এলেই পিসি ঠাম্মার ঘরের খাটে বসে এম এ ক্লাসের  পড়াশোনা শুরু করে দিত l মায়ের ঘরে খাটের ওপর তখন হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ করতে বসতে হত  শর্মিলাকে  l আর ছোটকার ওই আধখানা ঘরে তো বসার জায়গাই নেই l অগত্যা পরচর্চার আসরটা রান্নাঘরেই বসত l মায়ের কানে অবশ্য সেসব ঢুকছে কি না বোঝাই  যেত না, নির্লিপ্তমুখে রুটি সেঁকতেন l মায়ের বানানো চা খেতে খেতে নিচুস্বরে ঠাম্মা বলতেন 
--অন্যের কথা আর কি আর কমু ! আমার কপালেই যে বিদ্যাধরী জুটসে ! সংসারে মন নাই ! শুধু নাটক - নভেলের মইদ্যেই ডুইব্যা আসে l আর মাইয়াটাও হইসে তার দোসর l
 
আগুনের আঁচে মায়ের চোখমুখ লাল হয়ে থাকত l রুটি করা শেষ করে শর্মিলাকে পড়াতে বসাতেন মা l এমনিতে নরমসরম কিন্তু নিজের মেয়ের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন অপর্ণা l দেশভাগের পর বাংলাদেশ থেকে চলে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মা- বাবা দুজনকেই হারিয়েছিলেন l তারা পাঁচ ভাইবোন কাকার সংসারেই মানুষ l অপর্ণাই  বড় l লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো ছিলেন কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অপর্ণার l বিয়ের পরেই সংসারের জোয়াল এসে পড়েছিল কাঁধে l কিন্তু লেখাপড়া ভালোবাসতেন বলেই মেয়েকে নিজের মনের মত করে  তৈরী করতে চেয়েছিলেন l ননদের লেখাপড়াতেও কোনো বাধাবিঘ্ন আসতে দেননি কখনো l সেইজন্যই বোধহয় প্রায় সমবয়সী ননদের সঙ্গে কোনোদিন কোনো মনোমালিন্য হয়নি l পড়তে ইচ্ছে না করলে  শর্মিলা মাঝেমধ্যে ঠাম্মার আঁচলের তলায় গিয়ে সেঁধোত l কিন্তু মায়ের কাছে কিছুতেই পরিত্রাণ পেত না l রাত দশটা অবধি মায়ের সামনে বসে লেখাপড়া করে তবেই ছুটি মিলত l সকলের খাওয়াদাওয়া হলে, রান্নাঘরের পাট মিটলে  রাত জেগে চলত মায়ের  বই পড়া l শর্মিলা আর ওর বাবার ঘুমোতে অসুবিধে হবে বলে ঘরের লাইট নিভিয়ে জানলার একটা পাল্লা খুলে স্ট্রিটলাইটের আলোয় বই পড়তেন  মা l মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে আবছায়া অন্ধকারে জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আসা একচিলতে আলোয় আলোকিত মুখটা দেখে  মাকে ধ্যানমগ্ন তাপসী মনে হত l মায়ের মুখেই পুরাণের গল্প শুনেছিল শর্মিলা l মায়ের অপর্ণা নামটা সার্থক মনে হত তখন l

(চলবে )



             

                                                                  




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন