শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                       


                                


খোঁজ 

(১৪)

--মুন্নি কোথায় ছিলিস তুই এতক্ষণ? দেখ, তোর মায়ের কি অবস্থা ! 

শর্মিলাকে দেখেই রাজশ্রী চিৎকার করে উঠলেন l শর্মিলা দৌড়ে ঢুকল এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে l বেডে শুয়ে অপর্ণা  ছটফট করছিলেন, শর্মিলাকে দেখে স্থির হলেন l  চোখদুটো টকটকে লাল l ইনজেকশন পুশ করলেন একজন সিস্টার l কল্লোলদা বসে রয়েছে মায়ের পাশে l শর্মিলা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল l 

--মুন্নি... মুন্নি বলতে বলতে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল মা l কিছুক্ষণ পরে কল্লোলদার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল শর্মিলা l 

--কাকিমার বিপিটা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল l আজ অ্যাডমিট করে নিচ্ছি l হসপিটালেই অবজার্ভ করতে হবে l ভালো থাকলে কাল ছেড়ে দেব l তোকে খুঁজে না পেয়ে অসম্ভব টেনশন করছিল l তোকে কিন্তু এখন কাকিমার কথা ভাবতে হবে শর্মিলা l কাকিমা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন এমনকিছু করিস না l 

মুখটা নামিয়ে নিল শর্মিলা l বাইরে শম্পা আর মৈত্রেয়ী দাঁড়িয়ে l ওরা কখন এল ! মেঘনাই বা গেল কোথায়? 

--মেঘনা কোথায় গেল জানিস? ও একটা গাড়িতে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে...

--ও চলে গেছে l ব্যাপারটা পরে বলব তোকে l 

ছোটকা এসে পৌঁছয়নি এখনও l বাবার ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে বডি রিলিজ করার থেকে শুরু করে শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা পিসেমশাই আর সমীরণকাকুই  মিলেই করে ফেললেন l সকালে ছোটকা এসে পৌঁছলেই যাত্রা শুরু হবে l ততক্ষণে ডেডবডি  হাসপাতালের মর্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে l এই নিয়ে মৈনাকদা আর কল্লোলদার  সঙ্গে কথা বলছিলেন পিসেমশাই l রাত বাড়ছে l কাবেরীকাকিমা মৈত্রেয়ীর সঙ্গে শর্মিলাকে ওদের বাড়িতে চলে যেতে বললেন l শর্মিলা যেতে চাইল না l 

--আমি মায়ের কাছেই থাকব কাকিমা l সকালে তোমরা হসপিটালে থেকো, আমাকে তো আবার শ্মশানে যেতে হবে l 

শান্ত গলায় বলল শর্মিলা l 

--তোকে যেতে হবে না মুন্নি l অলোক যদি না করে দাদার মুখাগ্নি আমি করব l তুই কোত্থাও যাবি না l 
রাজশ্রী বলে উঠলেন l 

--না পিসি, ছোটকা নয় l বাবার সন্তান হিসেবে এটুকু আমাকেই করতে দাও l বাবার জন্য তো আর কোনোদিন কিছুই করতে পারব না l 

সকাল দশটা নাগাদ অলোক এসে পৌঁছনোর পর ওরা কেওড়াতলায় গেল l অপর্ণা তখনও ঘুমোচ্ছেন l নিষেধ করা সত্ত্বেও শর্মিলার জেদের কাছে হার মানল সবাই l খটখটে শুকনো চোখে যন্ত্রের মত বাবার মুখাগ্নি থেকে শুরু করে অস্থি বিসর্জন পর্যন্ত সবটুকুই করল ও l ইলেকট্রিক চুল্লির গনগনে আগুনে বাবার শরীরটা যখন ঢুকে যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে অন্তর্দহনে পুড়ে যাচ্ছিল শর্মিলা l সারাক্ষণ মৈত্রেয়ী আগলে রাখল ওকে l মৈনাকদা আর কল্লোলদাও ছিল ওদের সঙ্গে l 

বিকেলে ওকে নিয়ে পিসির বাড়িতে ফিরল সবাই l অপর্ণা খানিকটা সুস্থ, তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন রাজশ্রী l ওই বাড়িতে আর ওদের ফিরতে দেবেন না l কাবেরীবৌদি আর কেয়াবৌদির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দরকার হলে এবার বৌদির ওপর জোর খাটাবেন l অলোক আর শবনম বলেছিল ওদের না হয় নারকেলডাঙায় নিয়ে যাবে l কষ্ট করেই থাকবে সবাই l রাজশ্রী বলে দিয়েছেন, 

 --দরকার নেই, আমি যতদিন বেঁচে আছি আমার ভাইঝি আর বৌদিকে আর চোখের আড়াল করব না l 

অপঘাতে মৃত্যু l তিনদিনেই শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে গেল l ছোটকারা আসেনি l পিসি আর পিসেমশাইই ব্যবস্থা করলেন, একটা মঠে কাজ করল শর্মিলা l পিসির যত্নে মা খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে l চন্দননগর থেকে অসীমমামা আর মাইমা এসেছিলেন l দাদু বলে পাঠিয়েছেন শর্মিলা যেন মাকে নিয়ে এখন থেকে চন্দননগরে গিয়ে থাকে l ওখানে অনেক ঘর, থাকার কোনো অসুবিধা নেই, তাছাড়া ওখানকার কলেজে ভর্তি হতেও শর্মিলার কোনো অসুবিধে হবে না l ইতিমধ্যে অপর্ণা নিজেকে সামলে নিয়েছেন l মেয়ের জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হবে তাঁকে l 

আশ্চর্য লাগে শর্মিলার l এখন সবাই ওদের মা- মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছে l অথচ বাবাকে নিয়ে ওরা যখন বিপর্যস্ত তখন পিসি ছাড়া কেউ একবারও ওদের আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবে নি l 

অপর্ণা বললেন, 

--কাকাকে বলিস আমরা দু- চারদিনের জন্য চন্দননগর থেকে ঘুরে আসব l কিন্তু এই মুহূর্তে এই চাকরিটা আমি ছাড়তে পারব না l তাই কলকাতাও ছাড়তে পারব না l চাকরিটা এখন আমার খুব দরকার l 

স্বরূপবাবু অপর্ণাকে বললেন, 

--বৌদি আমাদের বাড়িতে এতগুলো ঘর খালি পড়ে রয়েছে, তুমি কেন অন্য বাড়িতে থাকবে বল তো ! তিনতলার ছাদের সঙ্গে যে ঘরটা আছে সেখানে  তোমরা থাকবে l তুমি তো চাকরি করছই বরং বাড়িভাড়া হিসেবে আমাকে কিছু টাকা দিও, তাহলে তো তোমার খারাপ লাগবে না ! 

এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললেন অপর্ণা l 

--বৌদি আমার নিজের বোন থাকলে কি আমি তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইতাম না ! তুমি কি আমাদের এখনও নিজের লোক বলে ভাবতে পারো না?
  
সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন স্বরূপবাবু l 

-- রাজু আমার নিজের বোনের থেকেও বেশি স্বরূপদা l ও আমার জন্য যা করেছে আমার নিজের বোনরাও করতে পারেনি l সুখে নয়, সংকটে বন্ধু চেনা যায় l কিন্তু  সমাজে তো আরো পাঁচজন রয়েছে l আপনার আত্মীয়স্বজনই বা কি ভাববে? 

--তুমিও সারাজীবন আমাদের জন্য কম কিছু করনি বৌদি l যারা দাম দিতে পারে না, তাদের  দূরে থাকাই ভালো l আর এখন না হলে আর কবে তোমার পাশে দাঁড়াব বল তো ! আমি নিজে স্বাবলম্বী l তাই কারুরই কিছু বলার নেই l  আমাকেও তো একটু ঋণশোধের সুযোগ দাও ! আর মুন্নি আমার ভাইঝি হলেও আমার সবটুকু জুড়ে রয়েছে সেটা বোঝো না ! ওর নিরাপত্তার জন্যই তোমাদের আমি অন্য কোথাও থাকতে দিতে পারব না l

--হ্যাঁ রাজু, এই পরিস্থিতিতে তুমিই আমাদের সবথেকে নিরাপদ আশ্রয় l এখন তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই আমার l 

জীবন থেমে থাকে না l পথচলার সঙ্গী হাত ছেড়ে চলে গেলেও মানুষ আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখে যায় l আরো কিছু বন্ধুর হাত এসে তাকে ঘিরে ধরে l ওই বাড়ি থেকে যৎসামান্য যা জিনিসপত্র ছিল, সেসব নিয়ে আসা হয়েছে পিসির বাড়ির তিনতলার ঘরে l ওখানে মাত্র কয়েকদিনের বসবাসেই জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়েছে শর্মিলার l সামান্য আঘাতেই  নুইয়ে পড়ত যে ভীতু গাছটা, প্লাবন দেখে নিয়েছে সে l ঝড়জলের সামনে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে সে ভয় পায় না আর l অপর্ণা আবার নার্সিংহোমের চাকরিতে যেতে শুরু করেছেন l রাজশ্রীও স্কুলে চলে যান l পিসেমশাই চেম্বারে l দুপুরবেলাটা যেন হাঁ করে গিলে খেতে চায় শর্মিলাকে l পরীক্ষার আগে পিসির বাড়ি থাকতে চায়নি শর্মিলা l কিন্তু এখানে এখন মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যাই হল না l এ বাড়িতে অনেক বই l সারা দুপুর নানারকম বিষয় নিয়ে পড়তে পড়তেই সময় কেটে যায় l  মাঝে মাঝে চলে যায় মৈত্রেয়ীদের বাড়ি l মৈত্রেয়ী জয়েন্ট ছাড়াও আরো কিছু পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত l কাকিমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করে l শম্পাদের বাড়িতেও গেল একদিন l শম্পার কাছেই শুনল মেঘনা এখন একজন ফিল্ম প্রোডিউসারের সঙ্গে মেলামেশা করছে l সেদিন সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গেই গাড়ি করে ফিরছিল পার্কস্ট্রীটের কোনো হোটেল থেকে l সেখানে নাকি শ্যুটিং চলছে l একটা সিনেমায় সহনায়িকার পার্টে অভিনয় করছে l 

--আর ওর বর? 

--তুই জানিস না? ওর বর তো এখন ওকে ছেড়ে অন্য একটা ঘাটে নৌকো বেঁধেছে l মেঘনা তো এখন বাবা- মায়ের কাছেই থাকে l কি জানি কি করে বেড়াচ্ছে ! দেখে তো মনে হয় হাতে প্রচুর পয়সা l সৌমিলি তো সেদিন যাচ্ছেতাই বলল ওর নামে l ওই আধবুড়ো প্রোডিউসারটার সঙ্গে নাকি ওর রিলেশন l এমনি এমনি কি আর সিনেমায় চান্স পেয়েছে ! ওর জন্য নাকি কারুর কাছে মুখ দেখানো যায় না l সৌমিলিটার জন্যই আরো খারাপ হয়ে গেল মেঘনা l 

--কাকু - কাকিমা কিছু বলে না ওকে?  

-- বললেই শুনছে আর কি ! দেখছিস তো ওকে ছোট থেকে l প্রচণ্ড ডেসপারেট l তবে ওর মনটা কিন্তু সত্যি ভালো l সেদিন ও না থাকলে তোর যে কি হত ! 


উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর সময় হয়ে এল l অথচ তেমন উত্তেজনা নেই শর্মিলার l রেজাল্ট যেমনই হোক, যে কোনো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিক জোর অর্জন করে ফেলেছে ও l এরইমধ্যে একদিন টুবলুদা কয়েকদিনের জন্য দেশে ফিরল l সঙ্গে তার বিদেশিনী বান্ধবী l কয়েকদিন কলকাতায় থেকে ওরা যাবে বিষ্ণুপুর l আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করছে ইভলিন l প্রাচীন বাংলার মন্দির ওর গবেষণার বিষয় l ইভলিন ভাঙা ভাঙা বাংলাও বলতে পারে l শর্মিলার সঙ্গে একটু একটু বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওর l 

(চলবে )








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন