শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                      






সাইকেল ( নবম পর্বের পর)


১০)

দিন যায় না জল যায়। দেখতে দেখতে দুমাস কেটে গেল সামুয়েলের এই গ্রামে। যেদিন থেকে বুলবুলকে গিটারে হাত দিতে দিয়েছে সামুয়েল, সেদিন থেকে সেই ছোট্ট রুবাইকেও দিয়েছে তার সাইকেলের চাবি। রুবাইও সাইকেল নিয়ে দিব্যি তরতর করে ঘুরে বেড়ায়। যতক্ষণ সাইকেলটাকে ও কাছে পায়, ততক্ষণ যেন ওকে ভূতে ভর করে। কোনোদিকে হুঁশ থাকে না ছেলেটার। অত বড় সাইকেল লেংচে লেংচে টেনে নিয়ে যায়। সাইকেলটাকে ধুয়ে, মুছে তকতকে করে রাখে। আর কাউকে হাত দিতে দেয় না। এদিকে লকডাউন খুলে যাওয়ার সময় হয়ে এলো প্রায়। আনন্দের সঙ্গে দিন গোণা ছাড়া আর সামুয়েলের কিছু করার ছিল না এই সময়ে। এতদিনে এই গ্রামের ছেলেমেয়েগুলোর কাছে তো বটেই, বড়দের কাছেও সে ঘরের লোক হয়ে উঠেছে। সে এখন প্রায় শুদ্ধ অসমীয়া বলে। আর ছেলেমেয়েগুলোও স্প্যানিশ শিখে নিয়েছে কিছুটা। একটু বড় হয়েছে যারা, তারা কাজ চালানোর মতো স্প্যানিশ বলতে ও লিখতে শিখে নিয়েছে। আর বুলবুল এখন গোটা একটা গানই বাজাতে পারে গিটারে। স্প্যানিশ সুর পারে, নিজের ভাষার গানও পারে এই অল্প সময়ে। বুলবুলের দেখাদেখি আরও দুএকজন উৎসাহ দেখিয়েছিল গিটার শেখার জন্য। কিন্তু বুলবুল কাউকে গিটার ছুঁতে দেয়নি। ও এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ফলে গিটারের মোনোপলি ওর একারই থেকে গেছে। তবুও এই প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর ভেতরে যে এত সুপ্ত প্রতিভা ছিল, সামুয়েল ভাবতে পারেনি আগে। অবশ্য ওদের উসকিয়ে না দিলে এতকিছু হত না ঠিকই। এই লকডাউনের দীর্ঘ দুমাস ওরা খেয়েঘুমিয়ে বাড়িতে কাটিয়ে দিত। লকডাউন উঠে যাবে, সেই আনন্দ যেমন রয়েছে, সামুয়েল চলে যাবে বলে এক্ষণ থেকেই চোরা বিষাদ ছেয়ে যাচ্ছে বাচ্চাগুলোর মনে। সেদিন আচমকাই সামুয়েলের ক্ষুদে রাজকুমারী কেঁদে উঠল। ‘সামুয়েলদাদা তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?’ স্কুলে শেষের হুটোপাটি স্তব্ধ হয়ে গেল আচমকা। সামুয়েল কোনো উত্তর দিতে পারল না। কীই বা বলত ও? যেতে তো হবেই ওকে। টিকিট কনফার্ম হয়ে গেলেই চলে যাবে। এই বিদেশে তো আর সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারে না ও! নিজের দেশ, নিজের পরিবার ওকে টানছে ভীষণ ভাবে। কতদিন যে নিজের ঘরে ঘুমোয় না! মায়ের গলা জড়িয়ে গান করে না! বোনের সঙ্গে খুনসুটি করে না! অন্য দেশে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকা যায়? যতই এরা আপন করে নিক না কেন…এবার যাওয়ার সময় হয়েছে তার।

      দেখতে দেখতে সেই প্রতীক্ষিত দিন এসে গেল। দীর্ঘ আড়াই মাস পরে সামুয়েল আজ বাড়ি ফিরবে। চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারছে না ও কিছুতেই। একদিকে বিদায় বেদনা, অন্যদিকে আনন্দ অশ্রু—কে কাকে সামলাবে আজ? বুলবুল কোথায় যেন লুকিয়ে আছে। সামুয়েলের কাছে আসছে না আজ কিছুতেই। রুবাই, সেই ক্ষুদে রাজকন্যে সবাই কাঁদছে। অভিজিৎ আর তার মা তো ঘরের ছেলে বিদায় জানানোর দুঃখে কাতর। পুরো গ্রাম সামুয়েলকে বিদায় জানাতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েছে সামুয়েল অভিজিৎকে সঙ্গে নিয়ে। অনেকটা পথ যেতে হবে তাকে। গুয়াহাটি এই গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরের পথ। কিন্তু বুলবুলের কাছ থেকে বিদায় না নিলে সামুয়েল যায় কী করে? অগত্যা অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তাকে সেই স্কুলের আটচালায় আবিষ্কার করা গেল। দরজা বন্ধ করে ফুলে ফুলে কাঁদছে সেই কিশোরী। সামুয়েল ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল নিঃশব্দে। তারও বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের জল কষ্ট করে আটকে রেখেছে। সংযত না থাকলে বুলবুলকে সামলানো দায় হয়ে যাবে এখন। গিটারটা বুলবুলের কোলে নামিয়ে রাখল সামুয়েল। ফোলা ফোলা চোখ মুখ নিয়ে বুলবুল মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে। সামুয়েল ওর মাথায় হাত রেখে বলতে শুরু করল, ‘আজ থেকে এই গিটার তোমার কাছে থাকবে। এই গিটার আর আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, তুমি ভালো করেই জান। ধরে নাও, আমিই গচ্ছিত রইলাম তোমার কাছে। এবার মন শক্ত করে হাসিমুখে আমাকে বিদায় জানাও। তোমার সামনে এক সুন্দর পৃথিবী রয়েছে। তোমাকে তার উপযুক্ত হতে হবে। এসো, চল এখন আমার সঙ্গে’। চোখ মুছে গিটার কাঁধে নিয়ে বুলবুল সামুয়েলকে বিদায় জানাতে উঠে এলো এবার। রাস্তায় রুবাইকে কাছে ডেকে সামুয়েল সাইকেলের চাবি ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘আর এই সাইকেল দিয়ে গেলাম তোমাকে। আমি তোমাদের সঙ্গে রইলাম সারা জীবন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। এখন তো পৃথিবীটা ছোট হয়ে এসেছে। আমি সময় পেলেই তোমাদের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলব। আর পারলে সামনের বছর এখানে আবারও চলে আসতে পারি! তোমরা আমাকে যেভাবে ঘরের ছেলের মতো ভালোবেসেছ, তার তুলনা নেই। এবার আমাকে তোমরা হাসিমুখে বিদায় জানাও। চল একসঙ্গে গান গাই আজ’…

Voy a reír, voy a bailar
Vivir mi vida lalalalá
Voy a reír, voy a gozar
Vivir mi vida lalalalá

(আমি হাসতে চাই, আমি নাচতে চাই

জীবন উপভোগ করছি লালালালা

আমি হাসতে চাই, আমি আনন্দে থাকতে চাই

জীবন উপভোগ করছি লালালালা।)

 

                (শেষ পর্ব )

          

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন