শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১

শ্যামলী সেনগুপ্ত

                             


                    চোখ
                            মূল গল্প : ওড়িআ
                              লেখক  : গায়ত্রী সরাফ
                             অনুবাদ  : শ্যামলী সেনগুপ্ত

           সবকিছু দেখতে পাচ্ছি কিন্তু অস্পষ্ট।
            খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলেও বুঝতে পারছি না জিনিসটা কী?এমনকি আমার চারদিকে ঘিরে আছেন যারা,আমার দেখাশোনা করছেন,তাদের মুখগুলিও ঝাপসা লাগছে।ভুল,ওই মুখগুলিও নয়,ভুল,আমার চোখের।সময়ের বয়স্ক আদর আমার শরীরে বার্ধক্য এনে দিয়েছে। সারা শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে।শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বাতাস ঝড়ের মতো ঢোকে আর বেরোয়।বেরনোর সময়  সমগ্র সত্তাকে জোর ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। শরীর বলতে এখন শুধুই যন্ত্রণা উপলব্ধি করি।যন্ত্রণা আর মৃত্যু  আমার কাছে এখন একটা রুপোর কয়েনের এ পিঠ আর ও পিঠ।ধুকপুক করতে থাকা প্রাণীটি এখনও স্বপ্ন দেখে।
        নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম অসহ্য যন্ত্রণায়।হঠাৎ অস্পষ্ট দেখতে পেলাম সাদা পোশাক পরিহিত কেউ একজন আমাকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। নিশ্চয়ই একজন নার্স।ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরে তিনি জানতে চাইলেন,
      স্যার,এখন কেমন লাগছে?
      খুব কষ্ট হচ্ছে।
       ইঞ্জেকশন দিয়েছি তো,ভালো লাগবে।
       আমার সবকিছু ঝাপসা লাগছে।চশমাটা একটু এনে দেবে?
        দিচ্ছি স্যার,বলে সে চশমাটা  এনে আমার চোখে পরিয়ে দিল,হেসে জানতে চাইল,এখন দেখতে পাচ্ছেন ত?
        আচ্ছা, আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?
         মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বললাম। কিন্তু ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম। বড়ো আপন ওই মুখ।স্মিত হাসি মাখানো মুখে উজ্জ্বল চোখ দুটি আমাকে টান মেরে ফেলে দিল কৈশোর বেলায়।কী দেখছি আমি?নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।সত্যিই কি এই সেই চোখ!যে চোখ দুটি নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর আমি বেঁচে আছি।আজ সেই চোখ চিনতে ভুল হবেই  না। বলেই তো যে আত্মার  সঙ্গে চোখের সংযোগ আছে। চোখ আত্মার প্রতিবিম্ব।
           ওই চোখ দুটি থেকে আমি দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না।হারিয়ে যাচ্ছিলাম ওই দুই চোখে।আমাকে ওই চোখ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল জীবনের ওই অবিস্মরণীয় উপত্যকায়
        ⚫
              স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেদিন।আমাদের সুবর্ণমুণ্ডিয়ার দিকে দৌড়লাম।ততক্ষণে অখি,পপু,সানুরা পৌঁছে ঘুড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওদের দেখে আরও জোরে ছুটলাম।ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হল।সকলেই জানে আমি ঘুড়ি ওড়ানোর মাস্টার। লাটাই ছেড়ে ঘুড়ি উড়তে লাগল উঁচুতে, অনেক উঁচুতে। অন্য অন্য ঘুড়ির থেকে তিন গুণ উঁচুতে উড়ছিল আমার ঘুড়ি।বাদল-মেঘ আর অস্তগামী সূর্যের তেরছা কিরণের স্বপ্নময় এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।
              একটু পরে আমার চারদিকে ঘিরে থাকা হৈচৈ চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল।লাল ঘুড়ির সঙ্গে কখন যে হারিয়ে ফেলেছিলাম মনটাকেও, বুঝতে পারিনি।পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেরাও আমার চঞ্চল মনটাকে স্বপ্নে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।নীচে থেকে যাওয়া জনবসতির ভিড়ে আমার মন খুঁজে চলেছিল ফ্রক পরিহিত এক অনামিকাকে।মনে হচ্ছিল কোনো এক অনন্ত দ্বীপের মাঝে হারিয়ে ফেলা মুক্তোটি খুঁজে চলেছি।সবই অস্পষ্ট অথচ অনন্ত যাত্রা।সমস্ত বাস্তব ও অবাস্তবের প্রহেলিকা অতিক্রম করে সাতপরত মনের নীচে সেই দুটি সরল,অকপট চোখ।মুক্তোর মতো উজ্জ্বল সেই চোখ দুটি বাদে আমার কাছে বাকি দুনিয়া হয়ে গেছিল অদৃশ্য।
            হঠাৎ মনে হল সুতোতে ঢিল পড়েছে। দেখলাম  পপু  আমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছে।অন্যরা আনন্দে চিৎকার করছে।আমার স্বপ্নেও ঢিল পড়লো।আকাশ থেকে ধপাস করে পড়ে গেলাম নিজেরই উপরে,হুঁশ ফিরল কিন্তু তখনও স্বপ্ন চোখকে রঙিন করে রেখেছে।
            মন্দিরে সান্ধ্য ঘন্টা বেজে উঠতেই  মায়ের কথা মনে পড়লো,"ঘন্টা বাজার আগেই বাড়ি ঢুকবে।নয়তো বাবা খুব রেগে যাবে।" বাড়ি ফিরলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বইপত্র নিয়ে বসলাম কিন্তু মন তখন ছেঁড়া ঘুড়ির জট পাকানো সুতোর মতো। অথচ আমার চোখদুটিকে অধিকার করে আছে ওই নরম মুখ।মন থেকে মুছে ফেলতে কাগজের ওপরে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটতে শুরু করলাম,যেন সেই মুখ ও চোখ এঁকে ফেলতে ছাইছি।আঁকা হল বটে কিন্তু তারা আমাকে তাচ্ছিল্য করতে লাগলো যেন।বিরক্তিতে আঁকিবুকি কাটা কাগজগুলো দলেমুচড়ে মায়ের রান্নাঘরের উনুনের মধ্যে ফেলে দিলাম। পুড়ে যেতে যেতে ওই অর্ধ সমাপ্ত চোখ দুটি যেন বলছিল,"তুমি যে চোখ খুঁজে চলেছ,তা সারা দুনিয়ায় ঈশ্বরের একটিমাত্র সৃষ্টি। পারলে খুঁজে নাও।তোমার ভিতরের অশান্ত প্রগলভতা নির্বাপিত হবে।"
             পরের দিন সকাল। স্কুল বসার অনেক আগেই বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘাটের দিকে দৌড়লাম।ছোট ঘাট থেকেই নৌকা চেপে ছোট নদী পেরিয়ে ওপারের স্কুলে যাই রোজই।আমাকে সম্মোহনে ঘিরে রাখা ওই চোখদুটিও একই নৌকায় যায়। তাই আমি বেশ খানিকটা আগেই ঘাটে পৌঁছাই যাতে ও আগেই পেরিয়ে না যায়। যতক্ষণ ও না পৌঁছয়,আমি নানা বাহানায় এড়িয়ে যাই পরিচিত মাঝিকে।তবে সেদিন পৌঁছে দেখি ও বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।নৌকো এসে ঘাটে লাগল।বাবার সঙ্গে বসল ও।আমিও সুযোগ করে ওর সামনে বসলাম। নৌকো ছেড়ে দিল।আমি ব্যাগটা ঠিক করে রাখতে রাখতে টের পেলাম ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমি চাইতেই কেমন যেন দু'জোড়া চোখ হারিয়ে গেল পরস্পরের ভিতরে।অপলক সেই দৃষ্টি। নৌকো দুলছে,সঙ্গে ঘাটও যেন দুলছে।দুলছে আকাশ কিন্তু দু'জোড়া চোখ স্থির।অপলক দৃষ্টির মাঝে দুটি স্বপ্নিল আত্মা আত্মস্থ।এর মধ্যেই শোনা গেল মাঝির হাঁকডাক,"ভাই ঘাটে লাগল, নামো,নেমে যাও সকলে।"
         নৌকো গিয়ে ঘাটে লাগলো আর তখনই ওই চোখ যেন বিদ্যুতের মতো ঝলমল করে উঠল।সকলে নেমে যাচ্ছে, আমার চোখ সরছে না।ওর বাবা ওর হাত ধরে নামিয়ে দিলেন,ও বারবার পেছন ফিরে দেখছিল।মাঝির হাতে পয়সা দিয়ে আমি দ্রুত ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। বাজার পেরিয়ে ওর প্রাইমারি স্কুল।ও স্কুলের গেট দিয়ে ভিতরে চলে গেল।ব্যাকুল হয়ে সামান্য সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করলাম। মনের মধ্যে ওই চোখের প্রতিফলন।আর আমার অবাধ্য ঠোঁট দুটি প্রসারিত হয়ে স্মিত হাসিতে ভরে উঠছিল।ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান গেট বন্ধ করে দিল।মনে হচ্ছিল, আমার মন ওই গেটের ও পারে আর ভারি পা নিয়ে নিজের স্কুলের দিকে এগিয়ে চলেছে আমার শরীর।গুম হয়ে বসেছিলাম ক্লাসে।অন্যমনস্ক, ভয়ংকর অন্যমনস্ক অথচ সারা ক্লাস জুড়ে হৈচৈ,হাসাহাসি, স্যারদের উঁচু গলায় পড়ানো।আমার কাছে তখন সবকিছুই বরফের মতো!সমস্ত দুনিয়া যেন নীরব!একসময় স্কুল ছুটি হল।ছুটির ঘন্টার প্রথম ঠং শুনতে শুনতেই গেট পেরিয়ে গেলাম।এক নিঃশ্বাসে পৌঁছে গেলাম ওর স্কুলের সামনে।দারোয়ান খুলে দিয়েছে ওদের গেট।
           ওহ্!যেন আমার মন ও শরীরের মাঝের তালাটা খুলে গেল।ঝিলমিল তারাদের মতো এখন অনেক চোখের ভিড়ে আমার স্বপ্নের চাঁদের উদয় হবে!কিন্তু এ কি!সব তারা চলে গেল,আমার চন্দ্রমালা কোথায়?আমার মনের আকাশ জুড়ে কালো মেঘ।স্কুল তো ফাঁকা হয়ে গেল!দৌড়লাম ঘাটের দিকে।সকলে বসে আছে নৌকোয়,ওকে পেলাম না।এদিক ওদিক তাকালাম,দেখতে পেলাম না।হঠাৎ দেখি নৌকোর এক কোণায় চাদর মুড়ি দিয়ে  বসে আছে বাবার পাশে।বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।ঠেলেঠুলে কায়দা করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর কাছে।ওর চোখ বন্ধ, সারা শরীর কাঁপছে।আমার খুব কষ্ট হলো অথচ জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না কিছুই। ওদের পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের শরীর খারাপ?
         হ্যাঁ।
          আমার বুক মুচড়ে উঠতে লাগল।অনুভব করলাম যেন ওর বন্ধ দুই চোখের পাতার ভেতরে আমার সব স্বপ্ন  ভালোবাসা ভাবনারা বন্দি হয়ে আছে।সূর্য পাটে নামছিল।ঘাটে এসে লাগল নৌকো।ওর বাবা  প্রথমে নেমে গেলেন।তারপর ওকে কাঁধে বসিয়ে  লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন। আমি পাগলের মতো ওদের পেছনে পেছনে প্রায় দৌড়তে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি ও চোখ মেলে আমাকে দেখছে।চোখদুটি ছলছলে,লাল।মনে হল,অস্তগামী আকাশ থেকে লাল রং এনে আমাকে প্রেমের রঙ উপহার দিল।ওরা নদীর বাঁধ পেরিয়ে ক্ষেতের আলপথ দিয়ে দূরে চলে গেল।আমি স্থাণুর মতো সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
         এর মধ্যে দশ দিন পেরিয়ে গেছে।
          সেদিন শরতের প্রাক্ সন্ধে।মলিন হয়ে আসা লোহিত সূর্যের আলোয় সারা আকাশ লাল,নদীর জলেও তার ছবি।নদীর তীরের ঢেউ খেলে যাওয়া কাশের ডাঁটায় লাল রঙ।যেন আমার অভিমানের সঙ্গী সমস্ত প্রকৃতি।কত যে বিকেল কেটে গেছে নদীর ঘাটে পারাপারের দিকে তাকিয়ে। যদি সে ফিরে আসে।ওকে দেখতে না পেয়ে মলিন সূর্যের মতো অবসন্ন মন নিয়ে আমিও বাড়ি ফিরতাম।
           নাঃ,আর পারছিলাম না।
           আমার এই অবস্থার জন্য সকলে দায়ী।
           এই নদী।এই নৌকো।এই কাশফুল।আর দায়ী ওই গভীর ক্ষেত।রোজ নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আমি ওই আলপথের দিকে তাকিয়ে  দিগবলয় প্রকম্পিত করে  দিনের পর দিন চিৎকার করেছি,উত্তর পাইনি।আজ সকলের কাছ থেকে উত্তর চাই।বসে ছিলাম ঘাটের পাশে একটি পাথরের উপরে।ক্লান্ত শরীর,সারা শরীর কেমন অবশ।নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে চোখ বুঁজে আসছিল।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। জ্ঞানশূন্য  হয়ে গেছিলাম ।মনে হলো সোনালি কাশের বনে একটা লাল ফ্রক পরে ও দৌড়চ্ছে।ফিরে ফিরে আমাকে দেখছে,ডাকছে,আবার দৌড়চ্ছে। আমিও ওর দিকে পাগলের মতো হাত বাড়িয়ে দৌড়চ্ছি।ও হারিয়ে যাচ্ছে কাশের বনে।
            দাঁড়াও...
           চিৎকারের সঙ্গে পড়ে গেলাম পাশের কাদাজলে। ঘুম ছুটে গেল। সারা শরীরে কাদা। নদীর জলে নামলাম। আর ঠিক তখনি ঝাঁকে ঝাঁকে চিল শকুন  ক্যাঁ ক্যাঁ  করতে করতে উড়ে গেল আমার মাথার উপর দিয়ে। কিছু দূরে গিয়ে  নদীর পৈঠায় নেমে কি সব ঠুকরে ঠুকরে ছিঁড়তে লাগল ।শিরশির করে উঠলো সমস্ত শরীর।বুক ফাটানো কান্না ছড়িয়ে পড়লো আমার সারা শরীরে।চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। বুকজলে দাঁড়িয়ে ডুব দিলাম।জলের ভিতরে সেই মোহিনী চোখ দুটো আমার দিকে তাকিয়ে। শ্বাসকষ্ট হতেই মাথা তুললাম জলের ভিতর থেকে আর আমার শ্বাসশব্দ ছাপিয়ে  শুনতে পেলাম কাঁসর ঘন্টা ঢাকের আওয়াজ। জয়জয়কার করতে করতে মা দুর্গার মূর্তি  বিসর্জন দিতে শোভাযাত্রা করে  লোকেরা আসছে।আমি স্থাণুবৎ তাকিয়ে ছিলাম।
          শোভাযাত্রা এসে পৌঁছলো একটু দূরে একটা সামান্য উঁচু জায়গায়। উলুউলু শঙ্খের শব্দে প্রতিমা নামানো হল।বিসর্জনের আরতি হল।এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আমি সব দেখছিলাম। মাতৃমুখ যেন আমার দিকেই তাকিয়ে। এক নিমেষে পুরোহিত জল ছিটিয়ে বুঁজিয়ে দিলেন মাতৃদৃষ্টি।কাঁসর ঘন্টায় কেঁপে উঠলো চারদিক।জয় মা দুর্গা শব্দে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল মায়ের মূর্তি জলের মধ্যে। জনে জনে ফিরে গেল।ফাঁকা হয়ে গেল নদীর তীর।আমার মনে হল,ঠিক ওই জায়গায় বুদ্বুদ উঠছে।ভেসে উঠল মূর্তির কিছু অংশ।দেখলাম মায়ের মুখ।আমি যেন কখন পৌঁছে গেছি ওইখানে, যেখানে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল।দেখলাম, দেবী মায়ের মুখ যেন অবিকল তার মুখ।নির্বাপিত চোখ দুটি  দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ। বড়ো বড়ো চোখ দুটি আমার দিকে তাকিয়ে ...ওহ্...সেই চোখ!
              সেই চাহনি!
    ⚫
               স্যার...!
       নার্সের ডাকে ফিরে তাকাই।একটু নুইয়ে পড়ে সে আমার চশমা খুলে দিল।আমি তখনও ঘোরের ভিতরে।কোন কালের সেই নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে সেই চোখের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছিলাম। ধীরে ধীরে ফিরে পেলাম নিজেকে।অতি পরিণত বয়সের মুমূর্ষু ফাটকে বন্দি ,শয্যাশায়ী আমি।
            ঝাপসা দৃষ্টি।
             নিষ্প্রভ মন।
            অক্সিজেন মাস্ক থেকে  অম্লজান নিয়ে  সংকোচন-প্রসারণের হৃৎপিণ্ড।আর তার ভেতরে সারা জীবনের সঞ্চয় অসংখ্য ভাবনা আর অনুভূতি ।আজ 'আমি' মানে কুড়িয়েবাড়িয়ে এইটুকুই।এটুকুই আমাকে জীবন্ত বলে প্রমাণ করছে নয়তো দাগের ওপারে আমার সঙ্গে জন্মে দীর্ঘ বাহাত্তর বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা মৃত্যু। হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে উঠল।শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।সামান্য সক্রিয় হাত নেড়ে  সংকেত দিলাম।নার্স দৌড়ে এলেন।আমার অবস্থা দেখে ডাক্তারকে কল করলেন।
          ডাক্তার এলেন, সঙ্গে সেই নার্স,যার মুখটি আমার বড় আপন।ডাক্তারের নির্দেশ মতো তিনি আমাকে দুটো ইঞ্জেকশন দিলেন।আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।ডাক্তার চলে যাওয়ার পরেও তিনি পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।আমার প্রিয় চোখদুটির দিকে তাকিয়ে আমিও।
           অনুভব করছিলাম আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।নিষ্প্রভ হয়ে আসছে অনেকানেক সূক্ষ্মতম চেতনা।
            আমার চোখদুটি কিন্তু ওই দুটি চোখের  সঙ্গে এক হয়ে গেছে।
                                       *******

     লেখক পরিচিতি  : শ্রীমতি গায়ত্রী সরাফ,কথাশিল্পী,অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ২০০৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড.আবদুল কালাম আজাদ-এর কাছ থেকে বেস্ট টিচার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।'ইটা ভাটির শিল্পী ' উপন্যাসের জন্য ২০১৭সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত। মোট ১৪টি গল্প গ্রন্থ রয়েছে।বর্তমানে ভূবনেশ্বরে থাকেন।
       
                       
ছবি - আন্তর্জাল
           
  

    
            
        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন