শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                                    



সাইকেল ( অষ্টম পর্বের পর)

 #৯

Para bailar la bamba
Para bailar la bamba
Se necesita una poca de gracia
Una poca de gracia
Pra mi pra ti
Ay arriba, arriba
Ay arriba, arriba
Por ti sere, por ti sere, por ti sere

Yo no soy marinero
Yo no soy marinero
Soy capitan
Soy capitan
Soy capitan

Bamba, bamba
Bamba, bamba
Bamba, bamba
Bamba, bamba

(বাম্বা নাচতে গেলে

বাম্বা নাচতে গেলে

চাই একটুখানি কৃপার,

চাই একটু দয়া

আরও একটু বেশি

আরও আরও বেশি

তোমার জন্য জন্য আমি আছি, তোমারই জন্য আছি

 

আমি নাবিক নই,

আমি নাবিক নই

আমি ক্যাপ্টেন

আমি ক্যাপ্টেন

আমি ক্যাপ্টেন

 

বাম্বা বাম্বা

বাম্বা বাম্বা

বাম্বা বাম্বা

বাম্বা বাম্বা )

এইরকম একটা দুরন্ত ছন্দের গান গাইতে গাইতে সামুয়েল প্রায় নাচছিল। গান, নাচ শেষ হলে সমবেত কচি হাসির রোল উঠলে চমকে তাকালো সে। বিচ্ছুগুলো আসলে যায়নি। কাছেপিঠেই ছিল। ওর গিটারের আওয়াজ শুনে আড়াল থেকে সব শুনছিল এতক্ষণ। এরপর ওকে ঘিরে ধরে সবাই হইচই শুরু করল। ওদের বক্তব্যের মূল সুর একটাই—গান শেখাও আমাদের। আমরাও তোমার মতো গাইতে চাই। সামুয়েলও এক পায়ে রাজি। ঠিক হল, কাল স্কুলের শেষে গান শেখানোর ক্লাস শুরু হবে। গিটারও শেখানো হবে। গিটার শেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল বুলবুল। ওর জন্যই প্রধানত গিটার শেখার ক্লাস। বাকিরা গান শিখতে চাইলে শিখবে।

বুলবুল আনন্দে ফুটছে একরকম। ঘরে এসেই স্নান খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটলে সামুয়েলকে ধরল। ‘একবার গিটার ছুঁতে দাও! কিভাবে ধরে একটু দেখিয়ে দাও। আঙুলে আংটির মতো কী পরে ওদুটো?...’ এইসব হাজার বায়নাক্কায় অস্থির হয়ে পড়ল সামুয়েল। ওকে শান্ত হতে বলেও পার পেল না। শেষে একটু বিরক্ত হয়েই সামুয়েল বলল, ‘এই গিটার যদি আমার হৃদয়, তবে ওই সাইকেল আমার মস্তিষ্ক। আমার সাইকেলে বাচ্চাগুলো ওঠে, আমি মুখে কিছু বলি না ঠিকই, কিন্তু আমার বুক ফেটে যায়। আর গিটার আমি কাউকেই ছুঁতে দিইনি এখনও। আশা করি তুমি বুঝবে…’ থমথম করে উঠল চারিদিক হঠাৎ করেই। পিনপতনের শব্দ শোনা যাবে এমন এক নিস্তব্ধ আবহাওয়ায় বুলবুল আচমকা ডুকরে উঠে চলে গেল। আর সামুয়েল কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। সে কি একটু বেশিই কর্কশ হয়ে পড়েছিল বুলবুলের প্রতি? এতটা কঠিন স্বরে ওকে বলা বোধহয় উচিত হয়নি। কিন্তু ছোঁড়া তির আর বলা কথা কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? অগত্যা থম মেরে বসে রইল সামুয়েল।

পরদিন স্কুলের জন্য সকলে হাজির হলেও বুলবুল এলো না। ওর মাকে জিজ্ঞেস করায় জানালেন, ওর নাকি শরীরটা ভালো লাগছে না। সামুয়েল সমস্ত বুঝেও চুপ করে রইল। স্কুল শুরু হল সময় মতো। কিন্তু বাচ্চারা বুঝতে পারছিল, তাদের সামুয়েল দাদার মন ঠিক নেই আজ। সেই প্রাণোচ্ছল মানুষটার কী যেন হয়েছে। আজ তাই স্কুলশেষে গান শেখা হল না ওদের। সামুয়েল সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে কোথায় যেন চলে গেল। এমনকি দুপুরেও খেতে এলো না সে। অভিজিৎ ফোন করার চেষ্টা করল বেশ কয়েকবার। প্রত্যেকবারই আউট অফ রিচ্‌ বলছিল। বুলবুল চুপচাপ রয়েছে এসব দেখেশুনে। রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিল সামুয়েলের ওপর। স্কুল যেতে কি ও বাধ্য নাকি? নাকি এই স্কুলে পড়লে, পাস করলে রেজাল্ট পাওয়া যায়? এ তো এমনি এমনি স্কুল। খেলাচ্ছলে শেখা। আর তাই তো ও গিটার শিখতে চেয়েছিল। কী এমন দোষ হয়েছে তাতে? ও কি সামুয়েলের গিটার নষ্ট করে ফেলত? বাচ্চা নাকি ও? রাগ, অভিমান মিলে মিশে জমাট বাঁধছিল বুলবুলের বুকে। যে মেয়ে সারাদিন বকবক করে সে সকাল থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে—এও তো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বুলবুলের মা ওকে চেপে ধরল এবার। ‘নিশ্চই তুই ছেলেটাকে উল্টোসিধে কিছু বলেছিস! নইলে তো ও এমন নয়। তোর আর বুদ্ধি হবে না। একটা ছেলে পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে আছে…আর তুই ওকে কোথায় দেখভাল করবি, তা না!’ মায়ের বকা খেয়ে বুলবুলের রাগ, অভিমান গলে কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ল। অভিজিৎ ওকে টেনে নিয়ে গেল ওর ঘরে। তারপর বোনের থেকে গিটারের কাহিনী জেনে নিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। মনে হয়, সামুয়েল এই গ্রাম ছেড়ে যাবে না। অন্তত যাওয়ার আগে তাকে কিছু না কিছু বলে যাবে। আছে কোথাও এদিক, ওদিক।

বুলবুল চোখ মুছে দাদাকে জানাল, ‘তুই একবার বাইক নিয়ে ওই পাহাড়ের দিকে যা। সামুয়েলদা নিশ্চই ওখানে গিয়ে বসে আছে’। অভিজিৎ ব্যস্ত হয়ে বাইকে স্টার্ট দিল তখনই। আর বুলবুলের প্রত্যাশা মতো টিলার দিকে একটা বড় পাথরের আড়ালে সামুয়েলের সাইকেলটা দেখতে পেল ও। চেনা বাইকের আওয়াজে সামুয়েলও বেড়িয়ে এলো কোনো ফাঁক থেকে। অভিজিতকে দেখতে পেয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে ওকে টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। সেখানে তখন একঝাঁক প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে। রঙের খেলা দেখতে দেখতে নাকি ওর দুপুরে খাওয়ার কথা মনে নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অভিজিৎ।

দূর থেকে অভিজিতের পিছন পিছন সামুয়েলকে সাইকেলে আসতে দেখে বড় করে শ্বাস নিল বুলবুল। থাক বাবা! আর গিটার শিখে তার কাজ নেই। সামুয়েল চলে গেলে কী হত? সারাদিন ছেলেটা খায়নি বলে সন্ধেবেলা অভিজিতের মা পরোটা আর নারকেল দিয়ে ঘুগনি বানিয়েছিল। তৃপ্তি করে খেলে সামুয়েল। ওর খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কতখানি খিদে ছিল ওর পেটে। রাতে যথারীতি গিটার নিয়ে বসে টুংটাং করছিল ও। বুলবুলকে ঘুরঘুর করতে দেখেই ডাক দিল। ‘এই মেয়ে! এদিকে এসো। আমার কথায় রাগ করেছ? এসো। আজই তোমাকে গিটারের প্রথম পাঠ শেখাই’। বুলবুলের সব রাগ, অভিমান জল হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। খুব মনোযোগ দিয়ে সামুয়েলের কাছ থেকে গিটার শিখতে শুরু করল ও। দুচারদিনের মধ্যেই বুলবুলের শেখার ক্ষমতা আর এত সহজে গিটারের প্রাথমিক কলাকৌশল আয়ত্ত্ব করতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সামুয়েল। আর তাই মনে মনে এক প্রতিজ্ঞা করল নিজের কাছে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন